X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

ইশারায় বলছে রাজীবের কাটা হাত

শান্তনু চৌধুরী
১৯ এপ্রিল ২০১৮, ১৭:৩০আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০১৮, ১৭:৩১

শান্তনু চৌধুরী পিতা-মাতা হারিয়ে যে ছেলেটি দুই ভাইকে সম্বল করে পরিবারের হাল ধরার জন্য বাঁচতে চেয়েছিলেন তাকে আর বাঁচানো গেলো না। ১৫ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর মারা গেলেন তিনি। রাজধানীর কাওরানবাজার এলাকায় দুই বাসের চাপায় হাত হারানো রাজীব হোসেনের অবস্থা শেষের দিকে এমনতর অবনতি হতে থাকে যে তার চিকিৎসা নিয়ে ব্রিফ করতে গিয়ে স্বয়ং ডাক্তারও কেঁদে ফেলেছিলেন। আর রাজীবের সেই কাটা হাত আজ হয়তো ইশারায় বলছে, কবে থামবে এই মৃত্যুর মিছিল? কবে শান্ত হবে বেপরোয়া বাস চালকরা? আর কতো কতো মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত হলে নিশ্চিত সাজা মিলবে চালকদের? এই প্রশ্নের জবাব হয়তো কারো জানা নেই।
রাজধানীতে যারাই চলাচল করেন তাদের প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব একটা চোখে পড়ে বলে মনে হয় না।  তাই যানজটে নাকাল হয়ে বসে থাকতে থাকতে যেই দৃশ্যটা সচরাচর চোখে পড়ে, প্রতিটি বাসের গায়ে অসংখ্য ঘষার দাগ। চলাচলে পাল্লা দিতে গিয়ে একটির সঙ্গে একটি এমনভাবে ঘষা খায়, ছাল-বাকল যেন উঠে গেছে। দগদগে ঘাঁ’র মতো দেখতে লাগে সেসব। কিন্তু কোনও বিকার নেই চালকদের। এতে করে যে কতজনের প্রাণ ঝরছে তার হিসাব থাকলেও ইয়ত্তা নেই হাত-পা হারানো, পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মানুষদের। এরা হয়তো হিসাবেই নেই। চলতি মাসের অর্ধেক সময়ের হিসাব যদি ধরি, , বড় তিনটি আলোচিত ঘটনা ঘটলো এরই মধ্যে। রাজীবের হাত হারানো আর অবশেষে মৃত্যু। আয়েশা খাতুনের কোমর ভাঙা। রাজধানীর লালবাগ থেকে মেয়েকে নিয়ে ফেরার পথে ধানমন্ডির চন্দ্রিমা মাকের্টের সামনে বিকাশ পরিবহনের দুটি বাসের প্রতিযোগিতার মাঝখানে পড়ে যায় মা-মেয়েকে বহন করা রিকশাটি। দুটি বাস দুদিক থেকে চাপ দিয়ে রিকশাটিকে বেশ কিছু দূর টেনে নেয়। এতে কোমর ভেঙে যায় আয়েশা খাতুনের। চিকিৎসকরা হারিয়েছেন আশা। বলেছেন, আর সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারবেন না আয়েশা। ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের সামনের সড়কে উঁচু বিভাজকের ওপর উঠতে যাওয়ার সময় রুনি আক্তারের ডান পা থেতলে দেয় নিউ ভিশন পরিবহনের একটি বাস। সেই পা ভালো করার মতো টাকা আপাতত রুনি আক্তারের পরিবারের নেই। যেদিন রাজীব হাত হারালেন সেদিনই কাওরানবাজারের অদূরে ১২ বছরের শিশু চালকের গাড়ির চাপায় পা ভাঙে ফুটপাতের চা বিক্রেতা রোকেয়া বেগমের। ওই শিশুর চোখেও গুরুতর জখম হয়। এরই ঘণ্টা তিনেক পর বিএফডিসির সামনে সোহাগ পরিবহনের বাসের ধাক্কায় ধুমড়ে মুচড়ে যায় প্রাইভেটকার। আলোচনার সুবিধার্থে চলতি মাসে রাজধানীর পরিসংখ্যানটি দেখে নিই। মেরুল বাড্ডার এশিয়ান হাসপাতালের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় সুপ্রভাত পরিবহনের বাস পথচারী রুবেলকে ধাক্কা দেয়। পরে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। পল্টন থানার পোস্ট অফিসের পাশের রাস্তা পার হওয়ার সময় অজ্ঞাত পরিচয় এক যুবক গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন। যাত্রাবাড়ীতে  মেয়েকে বিদায় জানাতে এসে অজ্ঞাত বাসের ধাক্কায় এক মায়ের মৃত্যু হয়। কলাবাগানে ব্যক্তিগত গাড়ির ধাক্কায় আহত এক রিকশাচালকের মৃত্যু। পুরান ঢাকার চকবাজার ও ডেমরা থানা এলাকায় পিকাপ ভ্যান ও ব্যাটারিচালিত রিকশার ধাক্কায় দুই শিশুর মৃত্যু। জুরাইনে সড়ক দুর্ঘটনায় হাফিজার রহমান নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু। এমন পরিসংখ্যান হয়তো বাড়বে। কিন্তু মূল কথা হলো গেলো কয়েক বছরে রাজধানী বা রাজধানীর বাইরে যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে তার কোনও প্রতিকার হচ্ছে না। আমি নিজেও বেশ কয়েকবার এমন ঘটনার শিকার হয়েছি। একবার দুটি লেগুনার চাপায় প্রাণ প্রায় যেতে বসেছিল। সড়ক বিভাজকের ওপর একাকী ব্যথায় কাতরাচ্ছিলাম, কেউ এগিয়ে আসেনি। যদিও রাজীব এখন পৃথিবীতে নেই। তবু সেদিনকার তার হাতের ছবিটি যখন ভাইরাল হয়, সেখানে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হাতটি যদি অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিস্থাপন করা যেতো তবে হয়তো অন্যকিছু ঘটতো। এছাড়া একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে সেটিই যেন সাধারণ ঘটনা বলে ধরে নিয়েছে সবাই। এতো এতো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে, কিন্তু প্রতিকার কোথায়? অথচ জাতিসংঘে বাংলাদেশসহ সদস্য দেশগুলো অঙ্গীকার করেছিল ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এমআরআই) তথ্য বলছে, সারা দেশে যত দুর্ঘটনা ঘটে, তার ৭৪ শতাংশই হয় ঢাকায়। এ ছাড়া যত পথচারী নিহত হয় সড়ক দুর্ঘটনায়; তার ৭২ শতাংশই হয় রাজধানীতে। এমআরআই গবেষকদের মতে, রাজধানীতে মানুষ বেশি, যানবাহনও বেশি। তাই এখানে দুর্ঘটনার হারও বেশি। ঢাকায় এখন প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। একটি আদর্শ মহানগরে ২৫ শতাংশ জায়গা সড়কের জন্য থাকা উচিত। কিন্তু ঢাকায় সড়কের জন্য আছে মাত্র ৭ শতাংশ জায়গা। এ কারণে এখানে প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনা ঘটছে। রাজধানীতে কোথায় কোথায় দুর্ঘটনার মাত্রা বেশি, তারও একটি তালিকা করেছে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট। সংস্থাটির গবেষণায় উঠে এসেছে, রাজধানীতে ৫৪টি ঝুঁকিপূর্ণ মোড় আছে, যেগুলোতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। তাতে কেউ নিহত হচ্ছে, কেউ পঙ্গুত্ববরণ করছে, আবার কেউ আহত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের  দেওয়া তথ্যমতে, সড়ক দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়, তা জিডিপির এক  থেকে দুই শতাংশ। গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় যারা মারা যান, তাদের ৬০ শতাংশই কর্মক্ষম। যাদের বয়স ১৫ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে। ফলে দুর্ঘটনায় যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের মৃত্যুর কারণে পুরো পরিবারে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা। এই কথাটি রাজীবের ক্ষেত্রে পুরোপুরি সত্য। কত কষ্টেই না তিনি চেষ্টা করেছেন নিজের পরিবারকে আগলে রাখতে। মাদ্রাসায় পড়া দুই ভাইকে মানুষ করতে। কিন্তু ঘাতক চালক তা করতে দিলো না! স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো. নাসিম রাজীব হোসেনকে দেখতে গিয়ে সুস্থ হলে তাকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তার ভাইদের দায়িত্ব নেবেন। রাজীব নেই, এখন দেখার বিষয় ভাইদের দায়িত্ব নেন কিনা।

এবার আসা যাক গণপরিবহন বিষয়ে। এর চালক, মালিক সত্যিই বুঝি অনেক শক্তিশালী! এমনকি সরকারের চেয়েও! নইলে নানা সময়ে চালানো অভিযানও থেমে যায়। একবার খোদ সেতুমন্ত্রীও অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছিলেন তাদের বিরুদ্ধে। রাজধানীতে মোবাইল কোর্ট চললো, সিটিং সার্ভিস বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হলো। সচেতনতার পাবলিসিটিও চালানো হলো। পরে দেখা যায় সবকিছুই আগের মতোই। দিন নেই, রাত নেই নগরীতে স্বল্প দূরত্বে চলাচলকারী বাসগুলোর প্রতিযোগিতা লেগেই আছে। তাও কোনও সুস্থ প্রতিযোগিতা নয়, কে আর আগে যাবে, অন্যের যাওয়া কীভাবে রোধ করা যাবে সেই চেষ্টা। এতে গাড়ির সামনে মানুষ পড়লো কী অন্যকিছু পড়লো তাতে কিছুই এসে যায় না। চালকরা কেন এতো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। সংবাদপত্র, রেডিও, টিভিতে সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে এতো এতো প্রচার কিছুই কাজে আসছে না। কেউ কেউ হয়তো মজা করে বলবেন, ওরা তো পত্রিকাও পড়ে না, টিভিও দেখে না। তার মানে এই, সচেতন ও প্রশিক্ষিত চালকের অভাব রয়েছে। বিশেষ করে ছোট যানবাহনগুলো যারাই চালান তাদের বেশিরভাগই শিশু, কিশোর। একবার টিভিতে দেখলাম নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সভাপতি অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনও জানালেন চালকদের, বাস মালিকদের কাছে অসহায় সবাই। অনেক সময় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির পরিবার বা আহত ব্যক্তি যথাযথ ক্ষতিপূরণও পান না। প্রথমে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন, পরে নেতাদের ‘ম্যানেজ’ করে ফেলেন। তার মানে অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা বেশ লক্ষণীয়। সেই থেকে তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। চালকরা সংঘবদ্ধ, এটাও তাদের বেপরোয়া হওয়ার বড় কারণ। এছাড়া ভোটের রাজনীতিতে ওরা ক্ষমতাবানদের সহায়তা পেয়ে থাকেন। আমাদের দেশে এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তো বেপরোয়া শ্রমিকদের পক্ষে সরাসরি কথা বলতে শুনেছি। কথিত আছে, তার আশ্রয় প্রশ্রয়ে নাকি পরিবহন শ্রমিকরা বেপরোয়া। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া। ঢাকায় লোক বাড়বে, রাস্তা কম কিন্তু গাড়ি বাড়বে বা বাড়ছে এটা সত্য। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশকে আরও বেশি কঠোর হতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় এরা নিজেরাই গাল-গপ্পতে এতো ব্যস্ত, আশপাশে কী ঘটছে খেয়ালই নেই। আমরা সবক্ষেত্রে রাজনীতির সদিচ্ছার কথা বলে থাকি,এক্ষেত্রেও সেটি খাটে। অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেওয়ার ব্রত যদি রাজনৈতিকরা গ্রহণ করে থাকেন তবে অপরাধ কমবে, অপরাধীরা পার না পেলে অপরাধ কমবে সেটি ধ্রুব সত্য। আমাদের মতো বহুল জনসংখ্যার দেশে শুধু সচেতনতা দিয়ে সমাধান হবে না। মুখের কথার পাশাপাশি দরকার আইনের প্রয়োগও। আবার যারা পথচারী তাদেরও আইনের আওতায় আনা বা নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে। যেখানে পারাপার, হাত দেখিয়ে দ্রুত গতির বাস থামিয়ে দেয়ার মতো প্রবণতাগুলো বন্ধ করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে শোনা যাচ্ছিল, বাসগুলোকে একীভূত করে নির্দিষ্ট কোম্পানির অধীনে চলাচল করতে দেওয়া হবে। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনও বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। সেটি হলেও ভালো ফল আসবে। এখন এতো এতো কোম্পানির অধীনে শত শত বাস চলাচলের কারণে টাকা আয়ের প্রতিযোগিতা থেকে যাত্রী তোলার প্রবণতা বাড়ে। সেখান থেকে বাড়ে দুর্ঘটনা।

বুয়েটের গবেষণা বলছে, সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে দুই ঈদের সময়। সামনে ঈদ। কাজেই এখন থেকে নেমে পড়তে হবে কাজে। রাজীবের কাটা হাত, কাটা মাথা, কাটা পা আর জোড়া লাগবে না। মুখ ফুটে বলবে না কোনও বোল। কিন্তু সেই কাটা হাত ইশারায় আমাদের ডাকছে, বারবার বলছে, এখনই হোক প্রতিবাদ, হোক আইনের প্রয়োগ। আর কোনও কর্মক্ষম রাজীবের স্বপ্ন যেন ভেঙে না যায়। নেশায় মত্ত চালকের খামখেয়ালিপনায় যেন নষ্ট না হয় দেশের সম্পদ।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিতে চাকরি, ৫ ক্যাটাগরির পদে নিয়োগ
সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিতে চাকরি, ৫ ক্যাটাগরির পদে নিয়োগ
অলিম্পিকের আগে জার্মানিতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ শায়েরা-রবিউলদের
অলিম্পিকের আগে জার্মানিতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ শায়েরা-রবিউলদের
জিম্বাবুয়ে সিরিজের প্রস্তুতি ক্যাম্পে ডাক পেলেন সাইফউদ্দিন
জিম্বাবুয়ে সিরিজের প্রস্তুতি ক্যাম্পে ডাক পেলেন সাইফউদ্দিন
সন্ধ্যা নামিলো শ্যাম: গানে ও চিত্রে মুগ্ধতার সমন্বয়
সন্ধ্যা নামিলো শ্যাম: গানে ও চিত্রে মুগ্ধতার সমন্বয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ