X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতীকী নয়, পরিচ্ছন্নতা চাই প্রতিদিনের

প্রভাষ আমিন
২৪ এপ্রিল ২০১৮, ১৪:৫৬আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০১৮, ১৪:৫৮

প্রভাষ আমিন দেড় কোটি মানুষের চাপে পিষ্ট আমাদের প্রিয় এই শহর ঢাকা। বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশের জনসংখ্যা এর চেয়ে অনেক কম। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এই শহর সামলানো যে কারও জন্য কঠিন; শুধু কঠিন নয়, প্রায় অসম্ভব। এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে ঢাকাকে উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ভাগ করার পরও দুই ঢাকাকে বিশ্বের অনেক বড় দেশের চেয়ে বেশি জনসংখ্যার চাপ সামলাতে হয়। আগে ঢাকার সীমানা ছিল বুড়িগঙ্গা থেকে ফুলবাড়িয়া। দোয়েল চত্বরের কাছে ছিল ঢাকা গেট, এখনও গাছের আড়ালে আছে ভাঙাচোরা সেই গেট। এখন যেমন বড়লোকেরা সাভার-গাজীপুরে বাগানবাড়ি বানায়, আগের নবাবদের বাগানবাড়ি ছিল শাহবাগ আর দিলকুশা। আদি ঢাকায় অনেক আগেই অবহেলিত পুরান ঢাকা। নতুন ঢাকা বাড়ছে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে। দক্ষিণের সীমানা খুব একটা না বদলালেও ঢাকা উত্তরে টঙ্গী ব্রিজ ছুঁয়েছে। বাংলাদেশে সবকিছু যেভাবে রাজধানীকেন্দ্রিক, তাতে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে পূর্বাচল,  গাজীপুর, সাভার,  কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যাবে ঢাকা।
ঢাকা যত দ্রুত বাড়ছে, আমাদের নীতিনির্ধারকদের পরিকল্পনা তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। ঢাকা দ্রুত বড় হচ্ছে, কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে। রাজধানীর খালগুলো দখল হয়ে গেছে অনেক আগেই। যেগুলো আছে, সেগুলোও মৃতপ্রায়। তাই বর্ষা এলেই ঢাকা বদলে যায় ভেনিসে। ঢাকার নিচু সব জায়গা ভরাট করে গড়ে উঠছে সুরম্য সব অট্টালিকা। কিন্তু সেই অট্টালিকার মানুষের গৃহস্থালি বর্জ্য, পয়ঃবর্জ্য কোথায় যাবে; পানি কোথায় যাবে ভাবারই সময় নেই আমাদের। ফলে ঢাকা পরিণত হয়েছে বড় এক ভাগাড়ে। শহরজুড়েই যেন ডাস্টবিন। দীর্ঘদিন অভিভাবকহীন থাকার পর নির্বাচিত নগরপিতা পেয়েছে ঢাকা উত্তর এবং ঢাকা দক্ষিণ। নির্বাচিত হওয়ার পর দুজনই রীতিমত প্রতিযোগিতা করে ঢাকাকে বদলে দেওয়ার নানা উদ্যোগ নিলেন। ঢাকা উত্তরের মানুষের আফসোস বাড়িয়ে দিয়ে আনিসুল হক অকালেই চলে গেছেন। কিন্তু তবু ঢাকাকে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন মরে যায়নি।

তবে পরিচ্ছন্ন ঢাকার স্বপ্ন দেখার দায় শুধু মেয়রদের নয়। ঢাকাকে পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব অনেকটাই আমাদের,  আমার-আপনার সবার। নতুন মেয়ররা এসেই ঢাকায় বেশ কয়েকটি আধুনিক পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করেন। মেয়ররা বানিয়ে দিয়েছেন,  রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও সিটি করপোরেশনের। কিন্তু আমরা যদি সচেতন না হই, তাহলে সিটি করপোরেশনের পক্ষে এই টয়লেটগুলো পরিচ্ছন্ন রাখা প্রায় অসম্ভব। ঢাকার ফুটপাতগুলো খুব পরিকল্পিতভাবে মেরামত করা হয়েছিল। কিন্তু অনেকদিন ধরেই ঢাকার ফুটপাতগুলো ছিল মোটরসাইকেল চালকদের দখলে। তো এই মোটরসাইকেল চালকরা অন্য গ্রহ থেকে ঢাকায় আসেন না। তারা ঢাকারই বাসিন্দা। কিন্তু ফুটপাত যে পথচারীর, এই ধারণাটাই যেন নেই তাদের। আবার সেই চালক যখন নিজে পথচারী হয়ে যাবেন তখন তিনিই গালি দেবেন মোটরসাইকেল চালকদের। এই চালকদের ঠেকাতে চমৎকারভাবে ফুটপাতগুলোর দুই পাশ খুঁটি দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। কাল দেখলাম এই খুঁটির মাঝখান দিয়ে অনেক কসরত করে অ্যাক্রোবেটিক স্টাইলে ঢুকে পড়ছেন মোটরসাইকেল চালকরা।

ঢাকার রাস্তাগুলো যেন এখন মরণফাঁদ। প্রতিদিনই ঘটছে কোনও না কোনও দুর্ঘটনা। কারো হাত যাচ্ছে, কারো পা যাচ্ছে; কারো জীবন যাচ্ছে। চালকদের অদক্ষতা,  খামখেয়ালি,  বেপরোয়া গতি,  ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের কারণেই ঘটছে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা। কিন্তু পথচারীদের অসচেতনতাও কম দায়ী নয়। আন্ডারপাস বা ওভারপাস থাকার পরও রাস্তার মাঝখান দিয়ে আমরা পেরুতে চাই। জীবনের চেয়ে সময়ের মূল্য কারো কারো কাছে বেশি হয়ে যায়। আন্ডারপাসগুলো একেকটা ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলেছি আমরা। কলাটা খেয়েই ছোলাটা ছুড়ে ফেলা, ডাবের বাড়তি অংশ যেখানে সেখানে ফেলে রাখা আমাদের স্বভাবের অংশ। যেখানে সেখানে ময়লা ফেললে যে মশার বংশবৃদ্ধি হয়; আমরা আক্রান্ত হই কখনও ডেঙ্গু, কখনও চিকুনগুনিয়ায়; আমরা যেন তা ভুলেই যাই। কিন্তু মশার অত্যাচার বেড়ে গেলে আমরা মেয়রদের গালিগালাজ করি। কিন্তু ভাবিই না মশার বংশবিস্তারের দায় অনেকটাই আমাদের।      

নতুন মেয়ররা নির্বাচিত হওয়ার পর ঢাকায় রাস্তার পাশে পাশে অনেক ডাস্টবিন লাগিয়েছিলেন। কিন্তু বেশি দিন সেগুলো টেকেনি। শুরুর দিকে দেখা গেছে ডাস্টবিন ফাঁকা, আশপাশে ময়লার ভাগাড়। আস্তে আস্তে সেই ডাস্টবিনগুলোও হারিয়ে গেছে। এখন গোটা শহরই খোলা ডাস্টবিন। সিটি করপোরেশন প্রতিদিন সকালে আমাদের বাসা থেকে ময়লা নিয়ে যায়। ভ্যানে করে ময়লা জড়ো করা হয় স্থানীয় ডাস্টবিনে। তারপর বড় গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় বড় ভাগাড়ে। কিন্তু আমাদের অনেক আধুনিক দুটি ফ্ল্যাটের মাঝের অংশ দেখলে বোঝা যাবে আমরা কতটা নাগরিক হয়ে উঠতে পেরেছি। টুপ করে জানালা দিয়ে আমরা ময়লাটা ফেলে দেই। যেন কেউ দেখছে না। কিন্তু আমি তো দেখছি। এভাবে ময়লা ফেলে ফেলে আমরা বন্ধ করে দেই ম্যানহোল, মেরে ফেলি খাল। এভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকলে মেয়রের বাপেরও সাধ্য নেই ঢাকাকে পরিষ্কার রাখে।

বাংলা নববর্ষের আগের দিন চৈত্র-সংক্রান্তিতে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন একটি অভিনব কর্মসূচি পালন করেছিলেন। প্রতীকী এই কর্মসূচিতে অংশ নেন প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। নিবন্ধনই করেছিলেন ১৫ হাজার ৩১৩ জন। এ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য গিনেস বুকে নাম লেখানো। গত বছর ভারতে ৫ হাজার ৫৮ জন একসঙ্গে প্রতীকী পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ইচ্ছা ভারতকে টপকে যাওয়ার। তবে সাঈদ খোকন এ কর্মসূচির আরেকটি লক্ষ্যেও কথা বলেছেন,  জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো। এটিই আসলে আসল লক্ষ্য হওয়া উচিত। কারণ, নাগরিকদের মানসিকতা না বদলালে একদিনের প্রতীকী কর্মসূচি পালন করে কোনও লাভ হবে না।

নাগরিকদের অবশ্যই দায়িত্ব আছে। ময়লাটা আমরা ঠিক জায়গায় ফেলবো, রাস্তাটা আমরা নির্ধারিত জায়গা দিয়েই পার হবো, ফুটপাতটা আমরা খালি রাখবো। এটা নাগরিকদের সচেতনতার অংশ। সচেতনতা যত বাড়বে, ঢাকা তত পরিষ্কার হবে। এই ঢাকা, প্রিয় ঢাকা আমার, আপনার, সবার। নাগরিকদের সচেতনতা আমরা কামনা করতে পারি, কিন্তু বাধ্য করতে পারি না। কিন্তু মেয়রের দায়িত্ব ঢাকাকে পরিচ্ছন্ন রাখা, বাসযোগ্য রাখা এবং এই কাজটা প্রতিদিনের। একদিনের প্রতীকী কর্মসূচিতে বিশ্বরেকর্ড হয়তো হবে, কিন্তু ঢাকা পরিচ্ছন্ন হবে না। পরিচ্ছন্ন ঢাকার জন্য একদিনের প্রতীকী কর্মসূচি নয়, চাই প্রতিদিনের চেষ্টা।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ