X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিপদের নাম ফেসবুক

সাইফুল হাসান
২৫ এপ্রিল ২০১৮, ১৫:৩৩আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০১৮, ১৫:৩৯

সাইফুল হাসান ফেসবুক, পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। প্রায় ২০০ কোটি বা তারও বেশি মানুষ এই প্ল্যাটফর্মটির সঙ্গে যুক্ত। পাশাপাশি টুইটার, ইন্সটাগ্রামের মতো আরো অনেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আছে, তবে এর কোনোটিই ফেসবুকের মতো জনপ্রিয় নয়।
প্রযুক্তি জীবনকে সহজ ও আনন্দময় করেছে। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, যোগাযোগ, সচেতনতা তৈরিতে প্রযুক্তি বিশ্বজুড়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। প্রযুক্তির কল্যাণে জীবন সহজ হলেও, জটিলতা কমেনি, বরং বেড়েছে।
শুধুই জটিলতা নয়; বরং তারও বেশি কিছু। যা আমাদের জাতীয়,সামাজিক ও পারিবারিক জীবনকে হুমকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে বা দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ ও অবারিত হওয়ায় অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা, বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা, মিথ্যা প্রচারণা, সহিংসতাসহ নানা নেতিবাচক বিষয়ের সঙ্গে মানুষকে লড়াই করতে হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর সাহায্যে নানা ইস্যুতে ঘৃণা উস্কে দেওয়া সহজ হয়েছে। একদিকে মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়ছে, অন্যদিকে বিভক্তি এবং বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে আরও বেশি।

বিশেষ করে ‘ফেসবুকে’। ইতিবাচক বহু ঘটনা এবং পরিবর্তন ফেসবুকের মাধ্যমে সাধিত হওয়ার পরও বলতেই হচ্ছে প্ল্যাটফর্মটি নেতিবাচক বহু ঘটনায় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এজন্য অনেক সময় আমাদের এতো বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে, যা কখনও কেউ কল্পনাও করেনি। এমনকি মার্ক জুকারবার্গও নয়।

বাংলাদেশে ফেসবুকের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। এ এমন এক মোহময় জগত যেখানে সবাই রাজা। সবাই সমান এবং স্বাধীন। তাই এর আবেদনও অন্য যেকোনও প্ল্যাটফর্মের চেয়ে বেশি। প্রতিষ্ঠার পর মাত্র দেড় দশকে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষের ভাবাবেগকে নিয়ন্ত্রণ করছে ফেসবুক। প্ল্যাটফর্মটি এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে, যেখানে হাসি-কান্না, যুদ্ধ, প্রেম, যৌনতা, রাজনীতি, ধর্ম, সস্তা বিজ্ঞাপন, করপোরেট প্রতিযোগিতা, লোভ, হিংসা, প্রপাগান্ডা সব মিলেমিশে একাকার।

জীবনের জন্য প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় সব আছে এখানে। এর আকর্ষণ উপেক্ষা করা কঠিন। ফলে, প্রতিদিন মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাচ্ছে ফেসবুক বা একই রকম অন্য কোনও প্ল্যাটফর্মে। স্ট্যাটাস, কমেন্টস, লাইক, শেয়ার বা ইনবক্সে আটকা পড়ছে জীবন। এতে ব্যক্তিজীবন, সম্পর্ক, আবেগ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা লক্ষ্য করছে না বেশিরভাগ ব্যবহারকারী।

এ বছরের শুরুতে মার্ক জুকারবার্গ ঘোষণা দেন, মানুষে মানুষে সম্পর্ক ও ব্যক্তিগত যোগাযোগ বাড়াতে অ্যাপ্লিকেশনে আরও পরিবর্তন আনবে ফেসবুক। এই ঘোষণার পর, শেয়ারের দামের ব্যাপক পতন হলেও, ঘোষণা থেকে সরে আসেননি মার্ক। বরং ব্যক্তি মানুষের মানবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেন তিনি। ফেসবুকের কারণে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তো বটেই, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় সম্পর্কও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। সম্পর্ক এবং মীমাংসিত অনেক বিষয়ে যৌক্তিক-অযৌক্তিক প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দিয়েছে এই প্ল্যাটফর্ম। যে কারণে, মেডিলিন রেনি নামক একজন অনলাইন লেখক মনে করেন, ‘দ্য বেস্ট সাইন অব এ হেলদি রিলেশনশিপ ইজ নো সাইন অব ইট অন ফেসবুক’।

ফেসবুক মানুষের আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য। একই সঙ্গে গুজব ও হিংসা রটানোয় সন্দেহাতীতভাবে শীর্ষে অবস্থান করছে। প্রতিষ্ঠানটি এত বিশাল ও বিপুল আকার নিয়েছে, ফেসবুক জুকারবার্গের ‘ফ্রাঙ্কেস্টাইনে’ পরিণত হয়েছে। অন্যভাবে বললে, বোতলে ভরা ‘রূপকথার দৈত্য’ যেন ফেসবুক নামে মুক্ত পৃথিবীতে এসেছে। কিন্তু এই দৈত্যকে কীভাবে আবার বোতালে বন্দি করা যাবে সেই মন্ত্র জানা নেই কারো; এমনকি জুকারবার্গেরও। তাই তো তার কণ্ঠে অসহায়ত্ব। সময় চাচ্ছেন ‘দৈত্যটি’কে বাগে আনতে।

ফেসবুক এখন মার্কিন সিনেটের কাঠগড়ায়, সিনেটরদের জেরার মুখোমুখি। গত মার্কিন নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে ফেসবুককে রাশিয়া এবং রিপাবলিকানরা ব্যবহার করেছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। আট কোটিরও বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হয়ে গেছে। এজন্য ক্ষমা চাইলেও, বিপদ জুকারবার্গের পিছু ছাড়ছে না। গত বছর, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দিতে বৌদ্ধ উগ্রবাদী ও মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী ফেসবুককে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু তা ঠেকাতে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে কয়েকদিন আগে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ স্বীকারও করেছেন।

জাতিসংঘের তদন্তকারী ইয়াংহি লি সংবাদ সম্মেলেন করে অভিযোগ করেন, ‘মিয়ানমারে ফেসবুক হিংস্র জানোয়ারের রূপ নিয়েছে। কট্টর বৌদ্ধ নেতারা তাদের ফেসবুক পেজের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়িয়েছেন।’ ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ানও তাদের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানিয়েছে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা শুরুর আগে ফেসবুকে বহু হেটস্পিচ বা ঘৃণামূলক বিবৃতি প্রচার করা হয়েছিল। শুধু মিয়ানমার নয়, সারা দুনিয়াতেই ফেসবুককে ব্যবহার করে একে অপরের বিরুদ্ধে অপপ্রচার,গুজব-হিংসা-ঘৃণা ছড়ানোর ঘটনা ঘটছে।

বাংলাদেশেও রামু, নাসিরনগর, রংপুরে ফেসবুক ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে।  ফলাফল,সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ ও বাড়িতে লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়, তখনও হাজার হাজার ভুয়া আইডি ব্যবহার করে একটি গোষ্ঠী, সরকার, বিচার ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছে এবং চালাচ্ছে। ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্ম এখন শুধুমাত্র ব্যক্তির সুখ-দুঃখ ভাগাভাগির জায়গা নয়। মানুষের মনে দখল নেওয়ার অস্ত্রও। ধর্মপ্রচার অপপ্রচার, ঘৃণা প্রচার, ছায়াযুদ্ধ প্রতিষ্ঠার প্ল্যাটফর্মও।

সাধারণের পাশাপাশি, পক্ষ-বিপক্ষ, বহুপক্ষ, নিরপেক্ষ, মধ্যপক্ষ, ডান-বাম, শ্লীল-অশ্লীল, সরকার, সরকারবিরোধী নানা গ্রুপ ফেসবুকে দৃশ্যমান। এরা এতটাই সক্রিয়, কোনও মতামত তাদের বিপক্ষে গেলে শুরু হয় সংঘবদ্ধ আক্রমণ। এসব আক্রমণ এতটাই পরিকল্পিত যে আপনার বেঁচে থাকা হারাম করে দেবে। এখানে ‘আমিই সেরা’—এই প্রবণতার জয়জয়কার।

আপনার যুক্তি আমার অপছন্দ, অতএব আপনি আমার শত্রু। এখন এই মানসিকতার জয়জয়কার। যুক্তি-পাল্টা যুক্তি নেই, বিতর্ক নেই, আলাপ-আলোচনা নেই,আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে জানিও না কিন্তু নাস্তিক, মোনাফিক, রাজাকার, সরকারের দালাল, বিএনপির চর, মুখোশ পরা জামায়াত-শিবির কর্মী, নিপীড়নকারী ইত্যাদি ট্যাগ লাগিয়ে দিচ্ছি,অবলীলায়। ফেসবুকের কারণেই জানতে পারছি, একসঙ্গে বড় হওয়া প্রগতিশীল বন্ধুটি আমার চূড়ান্ত রকমের নারীবিদ্বেষী, সাম্প্রদায়িক ও বিভেদ সৃষ্টিকারী। চারপাশে এতো দলকানা, নারীবিদ্বেষী, ধর্মান্ধ, ধর্ম প্রচারক, গুজব রটনাকারী ও গুজবে বিশ্বাসী মানুষ আছে–ফেসবুক না থাকলে জানাই হতো না।

ফেসবুক ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ হিসেবেও দারুণ কার্যকর ও উপযোগী। তা ব্যক্তিগত, বাণিজ্যিক, রাষ্ট্রীয় বা যেকোনও স্বার্থসংশ্লিষ্ট হতে পারে। সবশেষ, কোটা সংস্কারের আন্দোলনে, জনমত প্রভাবে সংস্কারের পক্ষ-বিপক্ষ, উভয়পক্ষই ফেসবুকে লড়াই চালিয়েছে। গুজব এবং মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছে ইচ্ছেমতো। একপক্ষ কোটা সংস্কার আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী আন্দোলন হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। অন্যপক্ষ পুলিশের গুলিতে ছাত্রের মৃত্যু, ছাত্রীর পায়ের রগ কাটার গুজব ছড়িয়েছে। এতে উভয়পক্ষই যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এই উপলব্ধিটাই কারো মধ্যে দেখা যায়নি। বরং পক্ষে-বিপক্ষের লড়াইটা এখনও জারি আছে।

ফেসবুক-টুইটারের মতো মাধ্যমগুলো নিজেই এক একটি ‘সীমানাহীন বিশাল রাষ্ট্র’। যার কোটি কোটি ব্যবহারকারী বা ‘নাগরিক’ আছে। যারা ভিন্ন ভিন্ন ভাষা সংস্কৃতি, ধর্ম ও বর্ণের মানুষ। প্ল্যাটফর্মগুলো এতটাই ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী যে, দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠান এদের উপেক্ষা করতে পারছে না। বরং ভার্চুয়াল এই ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে নিত্যনতুন কৌশল তৈরি হচ্ছে দুনিয়াজুড়ে। এসব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে কীভাবে জনগণকে বাগে রাখা যায়, নিজেদের শাসন-শোষণ ও ক্ষমতা সুসংহত করা যায়, সেই চেষ্টায় মত্ত দুনিয়ার তাবত রাষ্ট্র, বহুজাতিক কোম্পানি, করপোরেট প্রতিষ্ঠান এবং শাসকরা।

মনে রাখা ভালো, ফেসবুক গুজব রটানো, সত্য-মিথ্যা খবর প্রকাশ বা শেয়ার, এমনকি বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্যও নয়। যদিও এসব কাজেই এর বেশি ব্যবহার হচ্ছে। ফেসবুক হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশের জায়গা। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত, তথ্য, ফোন নম্বর, নিজের ও পরিবারের ছবি ব্যবহারে স্মার্ট ও সতর্ক হওয়া  জরুরি।

ফেসবুকের মতো মাধ্যমের ইতিবাচক দিকই বেশি। এর সবচেয়ে সুন্দর বিষয় হচ্ছে এখানে সবাই স্বাধীন মতামত প্রকাশ করতে পারে। তবে, চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের ব্যবস্থা না থাকায় এই সুবিধাকে সুযোগসন্ধানী নানা মহল অপপ্রচার, ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজে ব্যবহার করছে। মতামত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা কখনও কখনও স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় আমরা কেউই জানি না। কোটি কোটি আইডি নিয়ন্ত্রণও কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তবে, ব্যবহারকারী হিসেবে নিজেদের সচেতন হওয়া জরুরি। পাশাপাশি, ব্যক্তিগত যোগাযোগ বাড়ানো, অন্য মতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো হচ্ছে এই বিপদ এড়ানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ ও একমাত্র উপায়। তা না হলে, আমাদের মধ্যে বিভেদ আর বিচ্ছিন্নতা বাড়বে। যার সুযোগ নেবে অন্য কেউ। এতে সবারই ক্ষতি। এই সত্য যত দ্রুত বুঝবো সবাই, ততই মঙ্গল।

লেখক: সাংবাদিক

[email protected]

 

 

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কানাডার ইতিহাসে বৃহত্তম স্বর্ণ ডাকাতির ঘটনায় গ্রেফতার ৬
কানাডার ইতিহাসে বৃহত্তম স্বর্ণ ডাকাতির ঘটনায় গ্রেফতার ৬
আইপিএল নিয়ে আফসোস আছে শরিফুলের
আইপিএল নিয়ে আফসোস আছে শরিফুলের
চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন খাতে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী
চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন খাতে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী
নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত পরিদর্শনে বিজিবির মহাপরিচালক
নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত পরিদর্শনে বিজিবির মহাপরিচালক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ