X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

গুল, গুজব, গুঞ্জন

আহসান কবির
২৬ এপ্রিল ২০১৮, ১৪:৫২আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০১৮, ১৪:৫৯

আহসান কবির মশা, গাছ আর গুজবের সঙ্গে নাকি মিল আছে। গাছ আর গুজবের ডালপালা ছড়ায়। মশা যত দ্রুত রোগ ছড়ায় তারচেয়ে নাকি বহুগুণ বেশি ছড়ায় গুজব। বাঙালির কাছে তিন ‘গু’-এর কারিশমা অন্যরকম। এই তিন ‘গু’ হচ্ছে– গুল, গুজব এবং গুঞ্জন। বন্ধুদের আড্ডায় গুল বা চাপাবাজি না থাকলে চলে না। নায়ক নায়িকা হবেন কিন্তু তাদের কাউকে নিয়ে গুঞ্জন উঠবে না সেটা এই সময়ে কল্পনাও করা যায় না। আর গুজব? বাতাসের আগে ধায়!
চাপা বা গুল, গুঞ্জন আর গুজবের মধ্যে সংজ্ঞাগত পার্থক্য রয়েছে। যেমন, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সত্যকে কেন্দ্র করিয়া মিথ্যার সমান ব্যাসার্ধ লাইয়া যে বৃত্তচাপ আঁকা হয় তাহাকে চাপা বা গুল বলে। যেমন, আপনার পোষা একটা নেড়ি কুকুর আছে। (এটা সত্য) আপনি যদি বলেন আপনার একটা অ্যালসেসিয়ান আছে তাহলে সেটা চাপা বা গুলবাজি।
যা কিছু রটে তার যৎসামান্য বটে–এই সূত্র ধরে যখন কারও সম্পর্ক নিয়ে পত্রিকায় প্রাথমিক লেখালেখি হয় তখন সেটা গুঞ্জন। যেমন ধরুন এক নায়িকার নাম সঞ্জু বোস। আর তার প্রথম ছবির পরিচালকের নাম দবির চৌধুরী। ওনাদের সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লো। সঞ্জু ঘোষ চোখের পানি নাকের পানি একাকার করে সাংবাদিকদের বললেন,  ‘দবির চৌধুরী আমার বাবার মতো’। তবে বাস্তবতা এই যে বেশ কিছুদিন পরে একদিন পত্রিকার শিরোনাম হলো এভাবে-দবির চৌধুরীকেই বিয়ে করলেন সঞ্জু ঘোষ!

আর গুজব নিয়ে প্রাচীনতম গল্পটা হয়তো অনেকেই জানেন। রানি মা মৃত যমজ সন্তান প্রসব করেছেন। গুজবের ডালপালায় ভর করে দূরতম প্রজার কাছে এই সংবাদ এইভাবে পৌঁছাল যে রানিমা এক জোড়া কালো কাক প্রসব করেছেন! প্রসবের পরপরই ওড়ার চেষ্টা করায় কাক দুটির মৃত্যু হয়েছে। কালো সেই কাক দেখার জন্য প্রজারা দলে দলে ভিড় জমাতে লাগলো রাজমহলের আশেপাশে।

গুজবকে শিল্পের অন্তর্ভুক্তি করার দাবি উঠতে পারে যখন তখন। ইংল্যান্ড ও ইউরোপের দেশগুলোতে গুজবকে নিয়ে অনেক গবেষণা চলে। একবার ইংল্যান্ডের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানী রবার্ট ন্যাপের নেতৃত্বে রিউমার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট খোলা হয়েছিল। গুজবের ডালপালা বা পাখা সবচেয়ে গতিশীল। চার স্তম্ভ বা ভিত্তি না থাকলে নাকি গুজব প্রাণ পায় না। যেমন-

ক. গুজবটা মনে রাখার মতো হতে হবে।

খ. গুজবকে চলমান কোনও ষড়যন্ত্র বা আন্দোলনের অংশ হিসেবে জুড়ে দিলে ভালো হয়।  

গ. কোনও ধর্ম, দল বা গোষ্ঠীর সেন্টিমেন্ট ধারণ করতে হবে গুজবকে এবং

ঘ. আপামর জনসাধারণের প্রচলিত বিশ্বাস বা সেন্টিমেন্টকে আঘাত করে উসকে দিতে পারে এমন জিনিস রটালে সেই গুজব ফল দেয়!

এবার দেশ বিদেশের কিছু প্রচলিত গুজবের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। হিটলারকে নিয়ে অনেক গুজব প্রচলিত ছিল। যেমন, প্রথম মহাযুদ্ধে হিটলার নাকি আহত হয়েছিলেন এবং তার একটি অণ্ডকোষ কেটে ফেলতে হয়েছিল। আত্মহত্যা করার আগে পর্যন্ত তিনি নাকি এভাবেই বেঁচে ছিলেন। দ্বিতীয় গুজবটি ছিল তার গোঁফ নিয়ে। হিটলার চার্লি চ্যাপলিনকে নাকি এতই পছন্দ করতেন যে তার মতো গোঁফ রাখতেন। দ্য ডিক্টেটর ছবিতে চ্যাপলিন যেভাবে হিটলারকে ব্যঙ্গ করেছেন তাতে হিটলারের এমন গোঁফপ্রীতি থাকার কথা না। সবচেয়ে বেশি প্রচলিত গুজব ছিল ক্রিকেট নিয়ে। হিটলার দ্রুত গাড়ি চালানো পছন্দ করতেন। গাড়িতে যাওয়ার সময় দেখলেন লোকজন স্টেডিয়ামে ভিড় করে আছে। দ্বিতীয় দিন ভিড় দেখে জানতে চাইলেন কী হচ্ছে? ড্রাইভার বললো টেস্ট ক্রিকেট। তৃতীয় এবং চতুর্থ দিন স্টেডিয়ামে ভিড় দেখে হিটলার খুব ক্ষেপে গেলেন। পঞ্চম দিন জানতে চাইলেন খেলার ফলাফল কী? ড্রাইভার জানালো টেস্ট ড্র হয়েছে। হিটলার চরম ক্ষেপে ঘোষণা দিলেন, যে খেলা পাঁচদিন খেলার পরও ড্র হয় সেই খেলা জার্মানিতে থাকবে না। মৃত্যুর পরেও গুজব হিটলারের পিছু ছাড়েনি। বলা হতো হিটলার আত্মহত্যা করেননি। তিনি আর্জেন্টিনা পালিয়ে গেছেন এবং সেখানে পঁচানব্বই বছর বয়সে মারা গেছেন!

ভারতে ইন্দিরা ও ফিরোজ গান্ধীকে নিয়ে গুজব ছিল। বলা হতো ফিরোজ গান্ধী মুসলমান। আসলে তিনি ছিলেন পার্সি– যারা অগ্নি উপাসনা করে থাকেন। গুজব ছিল মহাত্মা গান্ধীর দুই নারীভক্তকে নিয়েও। ইন্দিরা গান্ধীর দুই ছেলে রাজীব ও সঞ্জয়কে নিয়েও গল্প গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। যেমন-রাজীব গান্ধী বিমান চালানো আর সঞ্জয় গান্ধীর দেশ চালানোর কথা। একদিন সঞ্জয় গেলেন বিমান চালাতে। ফলাফল বিমান ধ্বংস। এরপর রাজীব গান্ধী আসলেন দেশ চালাতে। ফলাফল দেশ ধ্বংস!

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর এই দেশে সবচেয়ে বেশি গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। গুজব ছড়ানো হয় যে শেখ কামাল ও শেখ জামাল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। শেখ কামাল ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে আহত হয়েছিলেন। নিজ স্ত্রীকে তুলে এনে বিয়ে করেছিলেন। সোনার মুকুট পরিয়ে তাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং হত্যাকাণ্ডের পর নাকি নগদ আড়াই কোটি টাকা পাওয়া গিয়েছিল। পরবর্তীকালে এসব গুজবের সত্যতা মেলেনি। আজও  কেউ কেউ অর্বাচীনের মতো এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

বাংলাদেশে যত গুজব প্রচলিত আছে তার ভেতর চাঁদনির্ভর গুজব খুব শক্তিশালী। যেমন নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে নামার পর নাকি দেখতে পেয়েছিলেন যে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত,পরে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এই গুজব ছিল বড় ধরনের মিথ্যা প্রচারণা। একই গুজব ছিল ভারতীয় বংশোদ্ভূত আরেক নভোচারীকে নিয়ে। বলাবাহুল্য, তিনিও ইসলাম গ্রহণ করেননি।২০১৩ সালে বাংলাদেশের সেরা গুজব ছিল চাঁদে জামায়াত নেতা ও মানবতাবিরোধীর দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ছবি দেখা গেছে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার এক মসজিদ থেকে এই ঘোষণা দেওয়া হয়। সাতকানিয়ার বোয়ালিপাড়া, সামিয়ারপাড়া, খলিফাপাড়াসহ কয়েক গ্রামে এই ঘোষণা ছড়িয়ে পরে। লোকজন বেরিয়ে আসে এবং পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বেধে যায়। এরপর সাতক্ষীরা থেকে শুরু করে আরও কয়েক জায়গায় এই গুজব ছড়ানো হয়। ফলাফল, এক শ্রেণির উত্তেজিত মানুষের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ এবং কমপক্ষে ষাট-সত্তর জন মানুষ নিহত হয়। ডাকাত পড়েছে বলে মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দেওয়া এবং মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলার পর জানা গেলো গুজব। এমন ঘটনাও প্রচুর ঘটেছে।  

ফেসবুকের আরেকটা মজার গুজব হচ্ছে এমন-‘BFF’ লিখুন। যদি ‘BFF’ সবুজ হয়ে যায় তাহলে আইডি হ্যাক হয়নি আর যদি সবুজ না হয় তাহলে আপনার পাসওয়ার্ড বদলে ফেলুন। সর্বশেষ গুজব ছড়িয়েছিল কোটা সংস্কারের কথিত আন্দোলন নিয়ে। আবু বকর নামের এক ছাত্রের মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়লে ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এরপর এক ছাত্রীর রগ কাটা নিয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, রগকাটার দায়ে ছাত্রলীগ বহিষ্কার করে বেগম সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগ নেত্রী এশাকে,পরে আবার তার বহিষ্কারাদেশ তুলে নেওয়া হয়। ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর দায়ে এরপর কয়েক ছাত্রীকে প্রায় মাঝরাতে হলত্যাগ করিয়ে তাদের অভিভাবকের কাছে সোপর্দ করা হয়! ৫৭ ধারায় করা মামলার আসামি না করে গুজবের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে হলত্যাগ করিয়ে এভাবে অভিভাবকদের কাছে সোপর্দ করাটা ভেবে দেখার মতো। গুজবের মতো গুজব ছড়ানোর শাস্তিটা পরবর্তীকালে আবার ‘ভাইরাল’ হয়ে যায় কিনা এখনই তা বলা যাচ্ছে না!

আসলে গুজবের মতো সংক্রামক,তিলকে তাল বানানোর মতো নাকি আর কিছু নেই! গুজবও মানুষের সেন্টিমেন্ট নিয়ে খেলে, মানুষও গুজবের পাখায় ভর করে উত্তেজনার খেলায় মাতে! তাই পরীক্ষার আগে আজও  অনেকে ডিম খায় না গোল্লা বা জিরো পাওয়ার ভয়ে। কেউ খায় জোড়া বা যমজ কলা, যাতে যমজ সন্তান জন্মে। নবজাতককে মধু খাওয়ালে নাকি তার কণ্ঠস্বর সুমিষ্ট হয়, নবজাতক নাকি বড় হয়ে মধুর মধুর কথা বলে। আগে গুজব ছিল ন্যাড়া মাথায় বাজ বেশি পড়ে। আর যদি ন্যাড়া মাথায় বাজ পড়ার পর কেউ মারা যায় তখন সেই সব লাশ নাকি কবর থেকে চুরি হয়ে যায়, চড়া দামে বিক্রি হয়। সীমান্ত পিলার নিয়েও এমন গুজব ছিল। সীমান্ত পিলারের নিচে নাকি ইউরোনিয়াম থাকে, তাই সেসব নাকি চোরাচালানিদের মাধ্যমে বিক্রি হয়। ইদানীংকার গুজব সমস্ত সীমান্ত পিলার নাকি ভারত নিয়ে গেছে। হাল আমলের চলমান গুজব হচ্ছে মোবাইল ফোনের অ্যান্টেনা, ইন্টারনেট এসবের কারণে বজ্রপাত বেশি হচ্ছে।

আসলে সৃষ্টির শুরু থেকে গুজবটাই ছিল শুধু প্রবহমান তথ্য। রানির মৃত সন্তান তাই কালো কাক হয়ে যেত। গুটেনবার্গ কিংবা ছাপাখানার কারণে প্রবহমানতা থেমে যায়,নির্দিষ্ট করে হয়তো কোনও তথ্য ছাপা হতে থাকে। তাই ছাপাখানা তথা মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৮৩ সালে আমেরিকার সব মিডিয়ার মালিক ছিল ৬৯টি কোম্পানি। ২০১৭ সালের হিসেবে মার্কিন মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র সাতটি কোম্পানি।

গুজব সম্ভবত সভ্যতার সমান বয়সী। যে কোনও দেশের মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করা পুরোপুরি সম্ভব কিনা  সেই বিতর্কে না গিয়েও এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, টুইটার বা ফেসবুকের মতো যোগাযোগমাধ্যমে কারও কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।

তাই গুজবের সবচেয়ে বড় পীঠস্থান এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি আর ২০১৭ সালের এপ্রিলের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ফেসবুকের আইডির সংখ্যা ২২ কোটি।

লেখক: রম্যলেখক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ