X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

মনেপ্রাণে সর্বদা এক বাঙালির নাম বেলাল চৌধুরী

দাউদ হায়দার
০২ মে ২০১৮, ২৩:০৬আপডেট : ০২ মে ২০১৮, ২৩:০৮

দাউদ হায়দার টেলিফোনে আর কেউ বলবে না, ‘ভাই, ভালো আছ?’
এই সম্বোধন এমনই আত্মিক, ভুলিয়ে দিতেন পরবাসের যন্ত্রণা। একাকিত্বের নির্জনতা। কিন্তু বেদনা তাঁর কণ্ঠে। ‘দেশ ছেড়ে বিভূঁইয়ে কী করে বাঁচো? বাঁচা যায়?’ কথাগুলো নির্মম।
ওই যে বলছেন ‘কী করে বাঁচো,’ প্রশ্নের ব্যাপ্তি বিস্তৃত। বলতে চান দেশের মাটি, জলহাওয়া, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, ভাষা ছেড়ে ভিন গোলার্ধে যাপিত জীবন কি খুব সুখকর? স্মরণ করিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথের গান।
এ পরবাসে রবে কে হায়!
কে রবে এ সংশয়ে সন্তাপে শোকে।।
হেতা কে রাখিবে দুখভয়সংকটে-

তেমন আপন কেহ নাহি এ প্রান্তরে হায় রে।।

বলেন, দেশ সর্বদাই আপনমুগ্ধ, দেশে থাকলে এই গান মনে পড়বে না, কেউ গাইবে না। ভাই, ভালো থেকো।’

বেলাল চৌধুরীর কথা বলছি। নিয়মিত কথা হতো ফোনে, নিশ্চয় নয়। বছরে একবার কী দু’বার। শেষ কথা গত বছরের জুনে। কণ্ঠ তাঁর ক্ষীণ। বরলেন, ‘শরীর বিগড়ে যাচ্ছে। গাড়ি পুরনো হলে কলকব্জা মেরামত করেও যুৎসই হয় না। কত আর মেরামত করা যায়। যতই কারও ফুল স্পিডে আর চলবে না।’

এই বলায় বার্ধক্যের হা-হুতাশ। বললেও, তারুণ্যের মেজাজ ষোলআনা।

বেলাল চৌধুরীর নাম প্রথম শুনি রেক্স রেস্তরাঁয়। ১৯৬৭ সালে। গ্রীষ্মের কোনও এক সন্ধ্যায়। দিনতারিখ স্মরণ নেই।

মনে পড়বে অনেকের গুলিস্তান, নাজ সিনেমা হলের (এখনও আছে কি?) বিপরীতে রেক্স রেস্তোঁরা। সন্ধে আটটার পরে খাদক বলতে কবিশিল্পী-সাহিত্যিক। জমজমাট আড্ডা। যদিও সংখ্যায় বেশি নয়। চার-পাঁচটি টেবিলে বিভক্ত। খাদ্য বলতে সিঙ্গাড়া, চা। আড্ডার প্রাণ শহীদ কাদরী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, জামাল খান (পাকিস্তানি খবর-এর সহকারী সম্পাদক, তখন। পরে আমেরিকায় স্থায়ী বসবাস), মুহম্মদ খসরু। হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান মাসে একবার-দু’বার। ফজল শাহাবুদ্দীন সপ্তাহে একদিন।

সেদিন সন্ধ্যায় (বেলাল চৌধুরীর নাম শুনেছিলুম যেদিন), ফজল শাহাবুদ্দীনই বোধ হয় (ঠিক মনে পড়ছে না। ভুল হতে পারে।) ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা নিয়ে এসেছেন। কৃত্তিবাস-এ বেলাল চৌধুরীর কবিতা। বেলালের কবিতাপাঠ, আলোচনা। তর্ক-বিতর্ক। ফজল শাহাবুদ্দীনের মুখেই শোনা গেলো বেলাল চৌধুরীকে নিয়ে একটি চমকপ্রদ গল্প।

রেক্সে আড্ডার পরে (রাত বারোটার পরে রেক্স বন্ধ) আড্ডাবাজরা প্রায়-সারারাত্রি শহরের নান জায়গায় গুলতানি মারেন, সকাল অব্দি। তখন ঢাকার শহর বলতে, আড্ডাধারীদের, পুরানা পল্টন, গুলিস্তান এলাকা, নবাবপুর এলাকা, বড়জোর সদরঘাট। প্রত্যেকে বেকার। ঘরছাড়া।

একসময় আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন বেলাল চৌধুরী। ১৯৬৩ পর্যন্ত (আগস্ট)। বেলাল উধাও। কেউ হদিস দিতে পারেন না। খোঁজাখুঁজি করেও। ধরে নেন, বেলাল চৌধুরীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে ঢুকিয়েছে। কারণ, পুলিশ খুঁজছিল। ভাষা আন্দোলনে ‘দারুণ বিপ্লবী’ কয়েকমাস জেলে কাটিয়েছেন, বিভিন্ন জেলে। কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে আর একবার গ্রেফতার। তো বেলাল নিশ্চয় জেলে।

বয়স হয়েছে, স্মৃতি কাবু। হুবহু সংলাপ মনে নেই। ফজল শাহাবুদ্দীনের সারাংশ এই: ফজল শাহাবুদ্দীন রাত্রি গুলজার করে, ভোরের দিকে, তখনও আঁধার, নবাবপুর রেললাইন (১৯৭২ সালেও ছিল) ক্রস করছেন, দেখেন, একদল মেথর-মেথরানি, সংখ্যায় ১০/১২ জন রাস্তা ঝাড়ু দিতে দিতে এগুচ্ছে। প্রত্যেকের বয়স ত্রিশের নিচে। হঠাৎ শোনা গেলো, মেয়েলি কণ্ঠে, দলের কেউ একজন বলছে, ‘ওই শকিদ’ (শহীদ কাদরী), ‘ওই ফজলা’ (ফজল শাহাবুদ্দীন), ‘ওই আখত্যারে’ (আখতারুজ্জামান ইলিয়াস)। নাম শুনে হতভম্ব। বিশ্বাস হয় না, মেথর-মেথরানির কেউ একজন শহীদ, ফজল, আখতারের নাম জানে। কাছে গিয়ে চিনতেও পারে না কাউকে। একজন ফরসা। মুখভর্তি দাড়ি। চেহারা অনেকটাই বেলালের। সন্দেহ হয় শহীদ কাদরীর। কাছে যেতেই উধাও।

বেলাল চৌধুরীর বোহেমিয়ান চরিত্রের সঙ্গে এই গল্প মানানসই। কিন্তু না, বেলাল ভাই বললেন, ‘পুলিশ খুঁজছিল আমাকে। জেনে, কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়ে ভোর রাতে পলাতক। মুখে দাড়ি ছিল ঠিকই। শহীদ দেখেছিল কিনা, বলতে পারবো না। পালিয়ে ভারতে, মানে, কলকাতায় আশ্রিত। পকেটে কোনও টাকাকড়ি ছিল না। কলকাতার ফুটপাতের জলই ছিল খাওয়া, সুস্বাদু।’

বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীকুলে বেলাল চৌধুরীই পয়লা বোহেমিয়ান। তাঁর মতো কেউ নেই। কৈশোর থেকেই ঘর-ছাড়া।

বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে ঢাকায় দেখা হয়নি কখনও। প্রথম দেখা কলকাতায়, ১৯৭৮ সালে। জানুয়ারি। আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘কলকাতার কড়চা’ লিখে বেরুচ্ছি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অফিসে ঢুকছেন। সঙ্গে সুদর্শন একজন। সুনীল বললেন, ‘আরে! বেলাল তোমাকেই খুঁজছে। অন্নদাশঙ্কর রায়কে দু’বার ফোন করেছি দু’দিন বলেছেন, ‘তোমাকে রাত আটটার পরে পাওয়া যাবে।’

বেলাল? বেলালকে চেহারায় চিনি না। অনেকের নামই তো বেলাল। জিজ্ঞেস করি, ‘বেলাল কি বেলাল চৌধুরী?’

সুনীল বিস্মিত। ‘তুমি চেনো না? দেখোনি কখনও?’

পরের ঘটনা বিস্তারিত পরে লিখব।

কলকাতায় নির্বাসিত (২১ মে। ১৯৭৪ থেকে) হওয়ার পর থেকে, এক-দুই মাসেই বেলাল চৌধুরী সম্পর্কে এত গল্প শুনেছি, তার জীবনযাপন, বোহেমিপনার, গুরুদেব কল্পনা করি।

রহস্য কী? কলকাতায় গিয়ে (বেলাল চৌধুরীর মুখেই শোনা।) বছর দুই নিজের পরিচয় দেন তিনি।  

ছিলেন মেদিনীপুরের কাঁথিতে এক আশ্রিত। সকালসন্ধে স্বাত্ত্বিক পুরোহিত। রাত্রি একটু ঘন হলে পুরোহিত নেই। একবার পাওয়া গেল এক নামি শুড়িখানায়। পুরোহিত চিৎপটাং। ‘দুই সুন্দরী যুবতী, আমাকে চোখেমুখে জল দিয়ে সুস্থ করছিল’। বললেন অম্লান বদনে।

ষাটের দশকের মধ্যপর্বে কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় কবিতায় লেখেন, ‘‘কলকাতা শাসন করে চারজন যুবক’। শাসন সন্ধ্যা থেকে। শাসক করেন সুনীল-শক্তি-শরৎ ও বেলাল।  ১৯৮৬, সেপ্টেম্বর। বেলাল ভাইয়ের টেলিফোন, ঢাকা থেকে। কবে আসছেন, কোথায় থাকবেন। জানান। আমরা হাঁটছি। পার্ক স্ট্রিট (এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে) দিয়ে। গন্তব্য কলা মন্দির। যেতে-যেতে, পার্ক সার্কাসের খ্রিস্টান কবর দেখিয়ে বললেন, এই কবরস্থানের একটি সমাধিতে থাকতাম, ঢাকা থেকে এসে। দেখতে গেলুম তার ‘বাসস্থান’। নেই। সেই কবর, তথা সমাধি, অন্য কোনও খ্রিস্টানের। মার্বেল পাথরে তৈরি। বেলাল চৌধুরী দশ বছরও কলকাতায় স্থায়ী নন। কিন্তু কলকাতাকে তছনছ করেছেন। কলকাতার অলিগলি নখদর্পণে। কলকাতাকে শাসন করেছেন। ‘কলকাতার শাসক ও রাজপুত্র’ বলেন তার বন্ধুরা। গুণগ্রাহীরা।  বেলাল ছাড়া কলকাতা অন্ধ, নিষ্প্রভ। ওঁর মতো বোহেমিয়ান, প্রেমিক আর কেউ নেই। ওঁর মতো মানবিক, বিশ্বমানব, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মাধর্মের ঊর্ধ্বে, পরোপকারী, বন্ধুবৎসল, অরাজনীতিক, হৃদয়বান বেলাল চলে গেলে আমরা এতিম।’’

দশ বছরে বেলাল চৌধুরী গোটা ভারতে ভ্রামণিক, ১০০ বছরেও কোনও ভারতীয় নয়।

বেলালের ভারতের আজকের ভারত নয়। শেষ দেখায়, (৬ জানুয়ারি ২০১৪। কলকাতা) ‘ভাই, ভারত আর আগের ভারত নেই’। 

মনেপ্রাণে সর্বদা বাঙালি। এই বাঙালি ছাড়া আর কেউ বলবে না,  ভাই।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
শপথ নিলেন আপিল বিভাগের নতুন তিন বিচারপতি
শপথ নিলেন আপিল বিভাগের নতুন তিন বিচারপতি
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
সারা দেশে আরও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি
সারা দেশে আরও ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ