X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘আশার ছলনে ভুলি’

আমীন আল রশীদ
০৬ মে ২০১৮, ১৩:০১আপডেট : ০৬ মে ২০১৮, ১৩:১৬

আমীন আল রশীদ বৈশ্বিক কূটনীতি যে চিরকাল একই জায়গায় স্থির থাকে না, তার সবশেষ উদাহরণ দুই কোরিয়ার মধ্যে শান্তি স্থাপনের উদ্যোগ। ছয় দশকের শত্রুতা অবসানের ঘোষণা দিয়ে সারা বিশ্ব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন যেদিন (২৭ এপ্রিল, ২০১৮) দুদেশের সীমান্তবর্তী পানমুনজমে পা রাখলেন এবং পরস্পর করমর্দন করলেন; প্রথমে কিম জং উন দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তে এবং তারপর তার হাত ধরে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট উত্তর কোরিয়ার সীমান্তে গিয়ে সহাস্য বদনে ক্যামেরায় পোজ দিলেন––সেটি নিঃসন্দেহে বিশ্বশান্তির ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
এই মাহেন্দ্রক্ষণটি স্মরণীয় করে রাখতে দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান শান্তির স্মারক হিসেবে একটি পাইন গাছও লাগিয়েছেন। তবে এর মধ্যদিয়েই যে দুই কোরিয়ার একীভূত হয়ে যাওয়া বা দুই দেশের মধ্যে চিরস্থায়ী শান্তির বন্দোবস্ত হয়ে গেলো, ব্যাপারটা বোধহয় এত সহজ নয়।  আরও অনেক প্রক্রিয়া যেমন বাকি, তেমনি বিশ্ব শক্তিগুলোর, বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ার মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান এবং উত্তর কোরিয়ার মিত্র চীন ও রাশিয়ার স্বার্থের সমীকরণও বিবেচনায় রাখতে হবে। তবে দূরভবিষ্যতে দুই কোরিয়ার মধ্যে যে ধরনের সম্পর্ক স্থাপিতই হোক না কেন, আপাতদৃষ্টিতে শান্তি স্থাপনের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে স্নায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্বের জন্য একটা বড় মেরুকরণ।

বিশ্বরাজনীতির এমন  মেরুকরণের পরদিনই রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে বাংলাদেশে আসে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দল। যদিও কুতুপালং ক্যাম্পে তারা যে সংবাদ সম্মেলন করেছেন, সেখানে কোনও আশার বাণী তাদের তরফে মেলেনি। অবশ্য তাদের কাছ থেকে খুব বেশি প্রত্যাশাও কেউ করেছেন বলে মনে হয় না।

২৪ সদস্যের এই প্রতিনিধি দলটি ২৯ এপ্রিল সকালে যায় তমব্রু সীমান্তের কোনাবাড়ি শূন্যরেখায়। সেখানে তারা রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের সঙ্গে কথা বলেন। এখান থেকে তারা কুতুপালং ক্যাম্পে যান এবং সেখানেও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা মানুষদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে সংবাদ সম্মেলনে প্রতিনিধিরা এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশকে ধন্যবাদ দিতে অবশ্য ভুল করেননি। যদিও তারা বলেছেন, এই সংকটের সমাধান বিলম্বিত হওয়ার দায় তাদের নয়। তাছাড়া এই সংকট ইস্যুতে কোনও রেজুলেশনও যে শিগগিরই নিরাপত্তা পরিষদে উঠছে না, সে কথাও তারা অকপটে জানিয়ে দেন। প্রতিনিধিদের কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তারা নিশ্চয়ই কিছু একটা করবেন।  কিন্তু কী করবেন তা পরিষ্কার করেননি। করেননি এ কারণে যে তারা নিজেরাও আসলে জানেন না কী করতে পারবেন বা কতটুকু পারবেন।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ক্ষমতা, এখতিয়ার এবং এদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সীমাবদ্ধতার খবর যারা রাখেন, তারা জানেন পরিষদের স্থায়ী ৫ সদস্যের মধ্যে যেখানে দুটি সদস্য দেশই (রাশিয়া ও চীন) রোহিঙ্গা ইস্যুতে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের পক্ষে, অর্থাৎ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যেকোনও ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার বিপক্ষে, সেখানে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদ কার্যকর কিছু করতে পারবে, এমনটি ভাবা খুব বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফরে আসা প্রতিনিধি দলে যখন রাশিয়া ও চীনের প্রতিনিধিরাও আসছেন বলে শোনা গেলো, তখন অনেকে সুড়ঙ্গের শেষপ্রান্তে কিছুটা আলো দেখার পক্ষপাতি ছিলেন। আমাদের দেখতে হবে, এই ইস্যুটি রাশিয়া ও চীন ঠিক কতটা ‍গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে? এই প্রতিনিধি দলে যে ২৪ জন সদস্য এসেছিলেন, তাদের মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী ৫ দেশের মধ্যে যুক্তরাজ্য ছাড়া বাকি ৪টি দেশই তাদের ডেপুটিদের পাঠিয়েছেন। ফলে অনেকেই মনে করেন, নিরাপত্তা পরিষদের এই সফরটি কিছুটা আনুষ্ঠানিকতা এবং এটি ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ টাইপের একটি পদক্ষেপ; যা তারা স্পষ্ট করেছেন কুতুপালং ক্যাম্পে সংবাদ সম্মেলনে।

জাতিসংঘ সনদ দ্বারা সংজ্ঞায়িত যেকোনও ধরনের আন্তর্জাতিক শান্তির হুমকিস্বরূপ পরিস্থিতির তদন্ত, বিবাদের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পদ্ধতির সুপারিশ, সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে অর্থনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি সমুদ্র, বাতাস, ডাক ও রেডিও যোগাযোগ ছিন্ন করা, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার এখতিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের রয়েছে। রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী যে ধরনের জাতিগত নিধন চালিয়েছে, তার অজস্র প্রমাণ থাকার পরও যখন নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করবে কিনা তা নিয়ে নিজেদের দোটানা প্রকাশ করে এবং তাদের সঙ্গে বৈঠকে যখন মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের কাছে ‘আরও বেশি করে’ সহযোগিতা প্রার্থনা করেন, তাতে মনে হতে পারে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকটের ভিকটিম নয়, বরং যেন এই সংকটের দায় বাংলাদেশেরই।

বাংলাদেশ লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়ে দেশের অর্থনীতি, পর্যটন এলাকা কক্সবাজারের প্রাণপ্রকৃতি, বন্যপ্রাণি, পরিবেশ, স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকার যে প্রভূত ক্ষতি মেনে নিয়েছে, মিয়ানমারের কাছ থেকে কোনোদিন সেই ক্ষতিপূরণ আদায় করা তো দূরে থাক, এখন রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ইস্যুই আসল হয়ে গেছে।

মিয়ানমার বারবার এটি বলার চেষ্টা করছে এবং তাদের কাগজপত্রও মোটামুটি এরকমভাবে তৈরি করে যে তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতেই চায়, কিন্তু বাংলাদেশ প্রস্তুত নয়; যার সবশেষ প্রমাণ সু চি’র কথায় স্পষ্ট। তিনি নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলকে বলেছেন, তারা এই ইস্যুতে বাংলাদেশের কাছে আরও বেশি সহায়তা চায়। মানে হলো বাংলাদেশ যথেষ্ট সহায়তা করছে না। খারাপ শোনালেও এটিই নির্মম বাস্তবতা যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের যে শৈল্পিক মিথ্যাচার বা ট্র্যাপের ভেতরে আমরা পড়ে গেছি, সেখান থেকে বের হওয়া কঠিন। প্রশ্ন হলো, কঠিন জেনেই কি আমাদের সরকার রোহিঙ্গাদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্তের জন্য ভাসানচরে আবাসনের ব্যবস্থা করছে? এক লাখ দুই লাখ নয়, সরকারি হিসেবেই এ মুহূর্তে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আছে। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা যেদিন বাংলাদেশে এলেন, সেদিনই প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন যে এ পর্যন্ত দুই থেকে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গেছে এবং সেসব দেশে গিয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। প্রশ্ন হলো, এই আড়াই লাখ মানুষ কী করে বাংলাদেশের পাসপোর্ট পেলো? এর জন্য তো জাতীয় পরিচয়পত্র লাগে, পুলিশ ভেরিফিকেশন লাগে–সেসব কে করে দিলো? সরষের ভেতরেই ভূত?

আবারও কূটনীতির প্রসঙ্গে আসা যাক, নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জোরালো ভূমিকা পালন করতে রাশিয়া, চীন, ভারত ও জাপানের মতো দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য ঢাকা ও নেপিদোর মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বলেও খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। এর দুদিন আগে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকেও শেখ হাসিনা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেও তারা এ বিষয়ে আন্তরিক নয়। ফলে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি।

দেখা যাচ্ছে, গত বছরের আগস্টের পর থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়েছে এবং পক্ষান্তরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের মানবিকতা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। এখানে কূটনীতির অন্যরকম ডাইমেনশন আমরা দেখেছি। কেননা, ভারত ও চীন বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের কাছ থেকে আশানুরূপ সমর্থন মেলেনি। কারণ, মিয়ানমারে চীন ও ভারতের বড় ধরনের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। ফলে এখানে অর্থের কাছে বন্ধুত্ব পরাজিত হয়েছে বলে মনে করা হয়।

কিন্তু কূটনীতি যেহেতু চিরকাল একই  জায়গায় স্থির থাকে না এবং যার সবশেষ বড় প্রমাণ উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, তেমনি মিয়ানমারের সঙ্গে এখন চীনের যে দহরম-মহরম সেটি কতদিন থাকবে বলা মুশকিল। কেননা, রাখাইনের পরে এবার কাচিনেও সেনা অভিযান শুরু করেছে মিয়ানমার এবং সেখান থেকে হাজার হাজার লোক বাস্তচ্যুত হয়ে চীন সীমান্তে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। সুতরাং এই ইস্যুতে চীন-মিয়ানমার সম্পর্কে নতুন  মেরুকরণ তৈরি হয় কিনা বা রাশিয়াও একসময় রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষত্যাগ করবে কিনা, তা জোর দিয়ে বলা কঠিন।

তবে এটা ঠিক, মিয়ানমার যে ধরনের রাষ্ট্র এবং তার যে সরকার কাঠামো, তাতে তাদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের মতো বড় ধরনের ব্যবস্থা না নিয়ে শুকনো কথায় এই সংকটের চিড়া ভিজবে না। পাশাপাশি আমাদের এও মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে যেহেতু জেনেশুনেই পান করেছে, তার জ্বালা তাকে সইতেই হবে। প্রশ্ন হলো, সেটি কতদিন?

লেখক: সাংবাদিক

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ