X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাড়ে ছয়টা মিথ্যা ও ত্রিপুরার বিপ্লব!

আহসান কবির
০৭ মে ২০১৮, ১৯:২১আপডেট : ০৭ মে ২০১৮, ১৯:৫৮

আহসান কবির মোবাইলের যুগে এক লোক দোকানে গেছে ‘মেমোরি’ কিনবে বলে। দোকানে গিয়েই তার মাথা নষ্ট। বিজ্ঞানীদের মেমোরির দাম সবচেয়ে কম। মাত্র পঞ্চাশ ডলার। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী কিংবা শিক্ষকদের ‘মেমোরি’র দাম একশ ডলার। শুধু রাজনীতিবিদদের ‘মেমোরি’র দাম পাঁচশ ডলার। লোকটা দোকানির কাছে জানতে চাইলো—কারণ কী? দোকানির উত্তর—বিজ্ঞানীরা জীবদ্দশায় তাদের মেমোরি প্রায় শেষ করে ফেলেন গবেষণার কাজে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষকদের মেমোরিরও অনেকটা ব্যয় হয় তাদের পেশায়। রাজনীতিবিদদের ‘মেমোরি’ শুধু ‘ইনটেক’ থাকে। জীবদ্দশায় সেটা তেমন কোনও কাজেই লাগে না!
রাজনীতিবিদ, নেতা, মন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানদের নিয়ে রসিকতা কম নেই। সবকিছু যে সত্য, তারও অকাট্য প্রমাণ হয়তো থাকে না, তবু অনেক ‘গালগপ্প’ প্রচলিত হয়ে যায়। ফরাসি প্রেসিডেন্ট চার্লস দ্য গল একসময়ে সেনাবাহিনীর জেনারেল ছিলেন। তার শারীরিক উচ্চতা ছিল চোখে পড়ার মতো। বিরোধীরা তাকে বলতো—‘দয়া করে দোতলা থেকে একতলায় নেমে মানুষ দেখুন!’ আর দ্য গলের অমর মন্তব্য—রাজনীতিটাকে পুরোপুরি রাজনীতিবিদদের হাতে ছেড়ে দেওয়াটা একটা ভয়াবহ ব্যাপার ঘটাবে! রাশিয়ান একনায়ক জোসেফ স্টালিন নির্বাচন ও ভোটাভুটিকে প্রায়শই ব্যঙ্গ করতেন। বলতেন, যে ভোট দেয়, সে কোনও সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। যারা ভোট গোনে তারাই সিদ্ধান্ত নেয় কে যাবে ক্ষমতায়! নিকিতা ক্রুশ্চেভ ছিলেন আরও এক ডিগ্রি সরেস। তার মন্তব্য—‘দুনিয়ার সব জায়গায় রাজনীতিবিদরা একরকম। হয়তো রাজনীতিবিদরা আপনাকে একটা সেতু বানিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেবে এবং পাবলিক সেটা বিশ্বাসও করবে। কিন্তু পাবলিক একদিন দেখবে যেখানে সেতু বানানোর কাজ শুরু হয়েছে, সেখানে আসলে নদীটাই নেই!’ তার মতে—‘‘নির্বাচন ‘চোরাই মাল’ বিক্রি করার জন্য জাঁকজমক করে আয়োজন করা উন্নত মানের নিলাম অনুষ্ঠান ছাড়া আর কিছু নয়।’’ আর তাই মার্কিন এক অভিনেতার মন্তব্য—নির্বাচনে কে ভালো লোক, সেটা খুঁজে বের করার বৃথা চেষ্টা করবেন না। তাকেই বেছে বের করুন, যে কম ক্ষতি করবে।
আসলে কে যে কম ক্ষতি করবে, আমজনতা অনেক সময় সেটা বুঝতেই পারে না। হিটলার জার্মানিতে একদা খুবই জনপ্রিয় ছিলেন, অথচ সেই তিনিই কয়েক লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হারার পর জার্মানিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। হিটলারের মতো আরও এক নৃশংস মানুষ ছিলেন উগান্ডার ইদি আমিন দাদা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ যখন স্বাধীনতার জন্য অকাতরে প্রাণ দিচ্ছে তখন মিল্টন ওবোটেকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে উগান্ডার ক্ষমতা দখল করে নেন ইদি আমিন। প্রথম প্রথম উগান্ডার মানুষ ইদিকে ত্রাণকর্তাই ভাবতো। এটাকে পুঁজি করে তিনি নিজেকে আকাশের পাখি, মাটি ও বনের পশু এবং সমুদ্র নদীর মাছদের অধীশ্বর ঘোষণা করেন! জীবনে কোনোদিন স্কুলে গেছেন কিনা সন্দেহ থাকলেও ইদি আমিন নিজেকে সেনাবাহিনীর ফিল্ড মার্শাল ও ডক্টরেট ডিগ্রিধারী বলে জাহির করা শুরু করেন। তিনি নতুন করে নামজারি করেন। তার নাম হয়ে যায়—মহামহিম, আজীবন রাষ্ট্রপতি, ফিল্ড মার্শাল আলহাজ ডক্টর ইদি আমিন দাদা! খুব গরিব ঘরে জন্ম হয়েছিল ইদি আমিনের। ব্রিটিশ উপনিবেশ কায়েমের পেটোয়া বাহিনী আফ্রিকান রাইফেলে যোগ দেন। তার নৃশংসতার কারণেই তাকে সাধারণ সৈনিক থেকে ইফেন্ডি বা লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। মিলটন ওবোটে তাকে ক্যাপ্টেন ও মেজর পদবিতে পদোন্নতি দেন। ক্ষমতা দখলের আগেই নিজেকে মেজর জেনারেল ঘোষণা করেন। ইদি আমিনের নৃশংসতার কারণে উগান্ডায় কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। বাসার ফ্রিজে নাকি মানুষের কাটামাথা ও কলিজা রাখতেন। ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের দেশ ছাড়া করার আগে তাদের কাঁধে চড়ে অফিসে আসতেন ইদি আমিন। তার পা ছিল অনেক বড়। এই মাপে কোনও জুতো পাওয়া যেতো না বলে অর্ডার দিয়ে তাকে জুতো বানানো হতো! দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে তার সাফল্যের কারণে (ভদ্রলোক আসলে যুদ্ধে অংশগ্রহণই করেননি) তিনি ব্রিটেনের রানির কাছে ভিক্টোরিয়া ক্রস দাবি করেছিলেন। তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হলে রানিকে তিনি একজোড়া জুতা উপহার পাঠিয়েছিলেন আর নিজ দেশের (উগান্ডার) সেনাবাহিনীতে ভিক্টোরিয়া ক্রস চালু করে প্রথমটা তিনিই নিয়েছিলেন। হিটলারকে 'বীর' হিসেবেই দেখতেন ইদি আমিন। বিরোধী মতের লোকদের হত্যা করার আগে বলতেন—এদের ছেড়ে দিয়ে দেখা যেতে পারে। এরা কখনোই বুলেটের আগে দৌড় শেষ করতে পারবে না। সমালোচকদের বলতেন, আমি নয় বছর বক্সিং চ্যাম্পিয়ন ছিলাম, তাই প্রতিপক্ষকে বক্সিং দিয়েই ঘায়েল করবো।
আমাদের দেশের আরেক স্বৈরশাসক এরশাদ সাহেব অবশ্য রাজনীতিতে অনেক অঘটন ও মন্তব্যের জন্ম দিয়েছেন। হয়তো সকালে উপজেলা ও সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা দিতেন, আবার সন্ধ্যায়ই সেটা পরিবর্তন করতেন। কয়েক শতবার তিনি কথা দিয়ে কথা না রাখার কিংবা ঘোষণা দিয়ে ঘোষণা প্রত্যাহারের ঘটনা ঘটিয়েছিলেন।
হাল আমলের আরও একজন উল্টাপাল্টা ও মিথ্যা বলার দায়ে পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি তার ৪৬৬ দিনের শাসনামলে তিন হাজারের বেশি মিথ্যা বলেছেন। ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ছয়টা মিথ্যা কথা বলে থাকেন ট্রাম্প। এ পর্যন্ত ১১৩টি মিথ্যা নাকি তিনি বারবার বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ মানুষ ট্রাম্পকে মনে করেন 'উন্মাদ'। অথচ এই 'উন্মাদ'কেই তারা রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন।
তবে অদূর ভবিষ্যতে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দে সম্ভবত  ট্রাম্পকেও ছাড়িয়ে যাবেন। দুই মাস হয়েছে বিপ্লব মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। ১৯৭১ সালে তার বাবা মা ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তো এই বিপ্লব এক এক করে ভুলে ভরা বোমা ফাটাচ্ছেন। যেমন আমাজন নদী নাকি আফ্রিকায় অবস্থিত। বিখ্যাত পর্যটক হিউয়েন সাং নাকি সাংবাদিক ছিলেন। আর চানক্য সেন নাকি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। তিনি এখানে থেমে গেলেও ভালো করতেন। কিন্তু দুম করে একদিন বলে বসলেন, মহাভারতের যুগেও নাকি ইন্টারনেট আর প্লাস্টিক সার্জারি ছিল। বিপ্লবকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন ‘পাগল’। মমতাকে দুই ঘণ্টা করে মন্দিরে সময় কাটানোর উপদেশ দিয়েছেন বিপ্লব। সিভিল সার্ভিসে নাকি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা তেমন কোনও কাজে লাগে না। তাদের তফাতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বিপ্লব সাহেব বলেছেন, সিভিল সার্ভিসের জন্য অপরিহার্য হচ্ছে সিভিল ইঞ্জিনিয়াররা। লেখাপড়া করিয়া কেন মরিব দুঃখে? মৎস্য ধরিব খাইব সুখের সার্থক প্রতিভূ হচ্ছেন বিপ্লব। তিনি বলেছেন, লেখাপড়ার চেয়ে পাড়ার মোড়ে পান আর চা দোকান দেওয়া অনেক ভালো! তারচেয়ে ভালো নাকি গরু কিনে পালন করা আর দুধ দুইয়ে সেটা বিক্রি করা। দশ লাখ টাকা পর্যন্ত নাকি গরুর দুধ বেচে আয় করা সম্ভব।
যাহোক, অতিষ্ঠ হয়ে ২০১৮ সালের ২ মে বিপ্লবকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। কী কথা হয়েছে তাদের মধ্যে সেটি দুজনই ভালো জানেন। তবে ভারতের মিডিয়াগুলো বলছে, বিপ্লবকে মুখের লাগাম টানতে নির্দেশ দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।
আসলে যুগে যুগে কালে কালে এমন রাজা, নেতা, মন্ত্রী বা রাজনীতিবিদ ছিলেন। তারা আছেন এবং থাকবেনও। উল্টাপাল্টা কথা বা ঘটনার জন্ম দিয়ে তারা বিখ্যাত হয়ে আছেন। ভবিষ্যতেও আমাদের এমন কথাবার্তা শোনার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকতে হবে। পুরাকালে যে এমন ছিল না, তা নয়। সম্রাট শাহজাহানের একটা ঘটনা শুনে বিদায় নেই।
পারস্য সম্রাটের একজন দূত এলেন সম্রাট শাহজাহানের সঙ্গে দেখা করতে। দূত শর্ত দিলেন তিনি সম্রাট শাহজাহানকে কুর্নিশ করবেন না। শাহজাহানও কম যান না। তিনি তার রাজদরবারের এক ছোট দরজা দিয়ে দূতকে ঢুকতে বললেন, যেন তাকে মাথা নিচু করে ঢুকতে হয়। দূত সেটা বুঝলেন এবং ঢোকার সময় মাথা নিচু না করে ঢুকে উল্টোভাবে ঢুকলেন। দূতের পেছনটা দেখে ক্ষেপে গেলেন সম্রাট শাহজাহান। চিৎকার করে জানতে চাইলেন,  কে পাঠিয়েছে এই গর্দভকে?
পারস্যের দূত বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিলেন, পারস্যের সম্রাট খুব বিচক্ষণ। তিনি জানেন কাকে কোথায় পাঠাতে হয়।  

লেখক: রম্যলেখক

/এসএএস/এমএনএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ