X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলা গানের সেকাল-একাল

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
১১ মে ২০১৮, ১৩:১৪আপডেট : ১১ মে ২০১৮, ১৩:১৬

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান বাংলা গানের সেকাল একাল অকাল আকাল, এই কথাগুলো চিরকালই চলে এসেছে। এ নিয়ে অসন্তোষের প্রকাশই বেশি। সব সময়ই এক ধরনের মানুষ বলেছেন, আহা কী সময় গেছে! আর সেদিন আসবে না। প্রতিবারই তাদের ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তবে যে কথাটি এখন সত্য, তা হলো  শিল্পীরা কারিগরি সহযোগিতানির্ভর হয়ে পড়ায় সাধনার কথা দিনে দিনে ভুলতে শুরু করেছেন। এমনকি আজ যা গাইবেন, তাও আগে কণ্ঠে তুলে নিয়ে, নিষ্ঠার সঙ্গে প্রস্তুতি গ্রহণের আকাঙ্ক্ষাও তেমন দেখা যায় না। ফলে, পুরো গানটি অন্তরস্থ করে গাইবার যে আপন আবেগ, তা অনুপস্থিত থেকে যাচ্ছে গানে। কথাটি অনেকাংশে সুরের ক্ষেত্রেও তেতো-সত্য। চুরি আগেও হয়েছে, তবে খুব কম। কারণ, উপকরণ এত সহজলভ্য ছিল না। ১৯৯০’র দশক পর্যন্ত, এমনকি ২০০০-এর প্রথম কিছু বছর ধরে, আমরা দেখেছি, একটু খ্যাতিমান যারা, তাঁদের মধ্যে, একটা সৃজন নেশা কাজ করতো। অনেকেই তা নিয়ে ছিলেন খুব খুঁতখুঁতে। তখনও যে সুরের ওপর কোনও রকমে কথা বসিয়ে একটা কিছু গোঁজামিল দাঁড় করার প্রবণতা একদম ছিল না, তা নয়। ‘গীতিকার’দের অনেকেরই ছন্দ-সচেতনতা ছিল না। কখনও কখনও ভাবের সামঞ্জস্য রক্ষা করে পুরোটা একটা কবিতা হয়ে উঠলো কিনা, সে দিকেও দৃষ্টি দেওয়া হতো না। এই অবস্থাটা অবশ্য আমি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বলছি।

যাহোক, যে বিষয় নিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই বিষয়েই ফিরে যাই। সেকাল একাল অকাল আকাল। আমরা যদি, চর্যাপদ, অর্থাৎ বৌদ্ধ নাথগীতিকাকেই প্রথম গীতিকবিতা বলে স্বীকার করে নিই, তাহলে তার অকাল ছিল, অর্থাৎ প্রাথমিক কাল, যখন ‘আলিএ কালিএ’ (স্বরবর্ণ ব্যাঞ্জনবর্ণের জটিলতায়, মতান্তরে অলিগলিতে বা আলো-আঁধারিতে) পথ রোধ করতো। তবে বৌদ্ধ শাসনকালে তার আকাল কখনও আসেনি। আকাল এলো, যখন পুনর্বার আর্যবিজয় ঘটলো এবং ঘোষিত হলো, সংস্কৃত ভাষা ছাড়া অন্য কোনও ভাষায় সাহিত্য রচনা করলে, মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে এবং তার স্থান হবে পুন্নম নরকে। বাংলা কবিতায় এত বড় এবং এত দীর্ঘস্থায়ী আকাল আর কখনও আসেনি। আর তখনকার বাংলা কবিতা মানেই তো গানের কবিতা। সেই দীর্ঘ আকাল পাড়ি দেওয়ার পর, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এরপরেই মধ্যযুগের কাহিনিকাব্য, পুথিকাব্য, যার সবকিছুকে ছাড়িয়ে বৈষ্ণবপদরত্নাবলি। বাংলা গানের সে এক ঐশ্বর্যের মহাভাণ্ডার। চর্যাপদ ছিল সাধনের গান। নাথপন্থী সাধকেরা যা অনেকটা উপমা রূপকের আড়াল রেখে রচনা করেছেন। তারই ধারা যেন পুনঃজাগরিত হতে দেখি, বাউল ফকিরদের গানে। কিন্তু তারও আগে এক মহাসাধকের গান পেয়েছি আমরা। তিনি সাধক রামপ্রসাদ। তাঁর রচিত সুর এক পৃথক নামও পেয়েছে। যার নাম,রামপ্রসাদী।

যাইহোক, বাংলা গানের কবিতায় দ্বিতীয় আকাল আসে, এদেশে ইংরেজ বেনিয়া শাসন পাকাপোক্ত হওয়ার পর। এই সময়ে ইংরেজের অনুগ্রহে একদল দেশীয় বেনিয়ার আবির্ভাব ঘটে। তাদের মধ্যে আগে কখনোই সাংস্কৃতিক বোধের লেশমাত্র না থাকলেও, অর্থাগমের কারণেই তাদের মনে বিনোদিত হওয়ার অধিকার জন্মে যায়। দেশীয় রাজা নবাব জমিদার, যারা আগে গানের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, তাদের অবস্থা ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ে। নব্য বিত্তবানেরা পৃষ্ঠপোষকতা বুঝতো না। ভোগ-বাসনাই ছিল তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। বড় বড় ওস্তাদবৃন্দের প্রাপ্য সম্মান তারা দিতে জানতো না যেমন, তেমনই তাঁদের সংগীত বোঝার মতো মেধাও বেনিয়াদের ছিল না। তাদের সে নিম্নরুচিকে তৃপ্ত করার মতো এক ধরনের গানের জন্ম হয় তখন। বিস্তারিত বিবরণে না গিয়েও বলা যায়, এও ছিল বেশ দীর্ঘ আকাল। তবুও, কালক্রমে এই আকাল ভেদ করে বেরিয়ে আসেন, রামনিধি গুপ্ত বা নিধুবাবু। তিনি টপ্পা গান দিয়েই আবার জাগিয়ে তোলেন সুস্থ শ্রোতামনণ্ডলীকে।

এরপরই রবীন্দ্রনাথ হয়ে পঞ্চপ্রধানের আবির্ভাব। বলে রাখা প্রয়োজন, রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবেও তথাকথিত বোদ্ধাজনেরা, গেলো-গেলো রব তুলেছিলেন। কারণ, রবীন্দ্রনাথ সঠিকভাবেই বুঝেছিলেন যে গান রাজা-জমিদারের বা কিছু সম্ভ্রান্ত পরিবারের গণ্ডিতে আটকে রাখার বিষয় নয়। তিনি লক্ষ করেছিলেন, বাঙালিসাধারণ হিন্দুস্থানি রাগসঙ্গীত, দ্রুপদ- ধামার- খেয়ালে অভিনিমগ্ন না থেকে ফিরে এসেছে, কীর্তন টপ্পার কাছে। তাই হিন্দুস্থানি রাগসংগীতে কথা বসাবার বদলে তিনি নিজস্ব সংগীত সৃষ্টিতে উদ্যোগী হলেন। আজকের বিপুল রবীন্দ্রসংগীতের ভাণ্ডারই প্রমাণ করে, সেদিনের তথাকথিত বোদ্ধারা ভুল ছিলেন। একইভাবে একদল নজরুলসংগীতের বিপুল জনপ্রিয়তা দেখে কিছু সমালোচক, তা সস্তারুচির সৃষ্টি বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আজ শতবর্ষমুখী নজরুলসংগীতের বিপুল গৌরব নিয়ে বেঁচে থাকা এবং আরো বিকশিত হতে দেখে বলা যায়, সেই সমালোচকেরা ভুল ছিলেন।

নজরুল নির্বাক হয়ে যাওয়ার পর একটা অস্থির সময় গেছে। কবিতায় তিরিশি আন্দোলনের ফলে, কবিতাকে গদ্যমুখী করার জন্যে, কবিরা গানোপযোগী কবিতা লেখা ছেড়ে দেন। পক্ষান্তরে  গ্রামফোন রেকর্ডের চাহিদা বৃদ্ধি, বেতারের জন্ম, ছায়াছবি সবাক হওয়া ইত্যাদি কারণে গানের চাহিদা বেড়ে যায়। এই বিপুল ভার এসে পড়ে অল্প প্রতিভাধর কবিদের ওপর। তবে সেই অস্থির সময় ক্ষণস্থায়ী ছিল। কারণ, গানের কবিতা রচনাও নিজেকে বিকশিত করার একটি মাধ্যম হিসেবে গণ্য করেন বেশ কিছু কবি। তাদের মধ্যে দীলিপ কুমার রায়, হীরেন বসু, শৈলেন রায়, অজয় ভট্টাচার্য, প্রণব রায়, পবিত্র মিত্র, স্যামল গুপ্ত, সলিল চৌধুরী, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

আমাদের দেশে আমরা শুরু থেকেই কবিদের পেয়েছি। যেমন, আজিজুর রহমান, সিকান্দার আবু জাফর, আহসান হাবিব, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান প্রমুখ। তবে এখানে অকাল বেশ দীর্ঘস্থায়ী ছিল। কারণ, ওই ক’জন কবিদের পক্ষে সকল চাপ বহন করা সম্ভব ছিল না। তারা লিখেছেনও খণ্ডকালীন কাজ হিসেবে। যারা সার্বক্ষণিকভাবে গীতি রচনায় নিয়জিত ছিলেন, ছন্দ ও অন্ত্যমিলগত দুর্বলতা প্রকট ছিল। তাছাড়া কাব্যসাধনার সঙ্গে তাদের অধিকাংশেরই কোনও সংযোগ ছিল না। পরবর্তীতে প্রকৃত কবিদের আগমনে গানের ভুবন হয়ে ওঠে স্বর্ণপ্রসবা। সেই ধারা চলমান ছিল প্রায় ২০০০ সালের পর পর্যন্ত। তবে আশির দশকের শেষ থেকেই, গান নিয়ে নানা এলোমেলো ছিনিমিনি চলতে থাকে। এখানেও ক্রমে ক্রমে বেনিয়া স্বার্থের সংযোগ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এখন তো করপোরেট কালচার নামে এমন এক সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে, যার সঙ্গে আমাদের শিকড়ের কোনও সম্পর্ক নেই। উন্মূল অবস্থা খুব বেশি দিন চলবে, এমন ভাবারও কোনও কারণ নেই। দেয়ালে পিঠ ঠেকলেই মানুষ রুখে দাঁড়ায়। যার লক্ষণ এখনই অস্পষ্ট হলেও দেখা যাচ্ছে। কারণ, এর মধ্যে কাব্যশিক্ষায় অগ্রসর অনেকেই এগোতে শুরু করেছেন। শিল্পী আমাদের আছে। সুরস্রষ্টারা যদি অনুকরণ বা অন্যের দ্রব্য না বলে গ্রহণের অভ্যেস ত্যাগ করেন এবং সৃজনশীল হন, তাহলেই নবজাগরণ ঘটবে। আমি ঢালাওভাবে, সুরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে দোষারোপ করছি না। দোষহীনদের দেখতে পাই বলেই তো আশাবাদী হতে পারি।

লেখক: কবি ও কলামিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ