X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

জামিন পেলেও মুক্তি পেলেন না

বিভুরঞ্জন সরকার
১৯ মে ২০১৮, ১৩:৪৫আপডেট : ১৯ মে ২০১৮, ১৩:৪৮

বিভুরঞ্জন সরকার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। ১৬ মে এই রায় দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ওই মামলায় পাঁচ বছরের সাজার বিরুদ্ধে তার করা আপিল হাইকোর্টে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিএনপি নেত্রী জামিন পেলেও এখনই মুক্তি পাচ্ছেন না। তার বিরুদ্ধে আরও অনেক মামলা রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি মামলায় তাকে আসামি দেখানো হয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিচারিক আদালত রায় দিয়েছেন গত ২৮ ফেব্রুয়ারি। সেদিন থেকেই কারাগারে আছেন খালেদা জিয়া। তার জন্য নাজিমুদ্দিন রোডে বিশেষ কারাগার নির্মাণ করা হয়েছে। বেগম জিয়ার আইনজীবীরা প্রথম দিন বলেছিলেন এবং আশা করেছিলেন যে স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই তাকে মুক্ত করা সম্ভব হবে। কিন্তু দ্রুতই তারা বুঝতে পারেন যে বেগম জিয়ার মুক্তি খুব সহজে হওয়ার নয়। আইনি প্রক্রিয়ায় সরকার তাকে একবার  যখন কারাগারে ঢুকাতে সক্ষম হয়েছে তখন তার জেলজীবন দীর্ঘ করার উপায় বের করা থেকে সরকার বিরত থাকবে বলে মনে হয় না।

বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবী মওদুদ আহমেদ আপিল বিভাগের রায়ের পর বলেছেন,খালেদা জিয়ার মুক্তি পেতে কিছুটা বাধা আছে। কারণ নিম্ন আদালতে থাকা ছয়টি মামলায় তাকে আসামি দেখানো হয়েছে। এরমধ্যে তিনটি কুমিল্লায়,ঢাকায় দুটি এবং একটি মামলা আছে নড়াইলে। এই সবগুলো মামলায় জামিন না পেলে মুক্তি পাবেন না খালেদা জিয়া। তার বিরুদ্ধে মোট মামলা আছে ৩০ টির বেশি,কয়েকটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। মওদুদ আহমেদ একদিকে বলেছেন, ‘আমাদের মাঝে খুব শিগগির তিনি ফিরে আসবেন’। আবার তিনিই অভিযোগ করেছেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তি বিলম্বিত করতে সরকার নানা কৌশলে চেষ্টা করছে ও করবে। সরকারের এই চেষ্টা মোকাবিলায় বিএনপির কৌশল কী তা কারো জানা নেই’।

কারাগারে বেগম জিয়া গুরুতর অসুস্থ বলে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে। তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়ার দাবিও জানিয়ে আসছে বিএনপি। কিন্তু সরকার পক্ষ বলছে, বেগম জিয়া আগে থেকেই অসুস্থ। তিনি আর্থাইটিসের রোগী। হাঁটু,কোমরে তার ব্যথা সব সময়ই থাকে। জেলে গিয়ে হয়তো সমস্যা একটু বেড়েছে। কারা কর্তৃপক্ষ তার কিছু পরীক্ষা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করেছেন। সেসব পরীক্ষায় বেগম জিয়ার অসুস্থতা গুরুতর কিছু নয় বলেই জানা গেছে।

দলীয় চেয়ারপারসনকে নিয়ে বিএনপি এখন বেশ অস্বস্তির মধ্যেই আছে। তাদের ধারণা, যাই হোক না কেন আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত বেগম জিয়াকে জেলে নেবে না। তাদের এই ধারণার পেছনে কারণ হিসেবে তারা ভেবেছিল বেগম জিয়াকে জেলে নিলে একদিকে দেশের মধ্যে বড়ো আন্দোলন গড়ে উঠবে, অন্যদিকে দেশের বাইরে থেকেও সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ আসবে। কিন্তু বাস্তবে এর কোনোটাই হয়নি। বেগম জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপির পক্ষে বড়ো কোনও আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। বেগম জিয়ার প্রতি মানুষের হয়তো কিছু সহানুভূতি আছে কিন্তু তার মুক্তির জন্য আন্দোলনে নেমে সরকারের রোষানলে পড়তে চায় না কেউ। তার বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির মামলা দেওয়া হয়েছে তার টাকার পরিমাণ খুব বেশি নয় বলে কোনও কোনও মহল থেকে সামান্য টাকার মামলায় দেশের  একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ফাঁসানোর সমালোচনা করা হয়েছে। কিন্তু খালেদা জিয়া দুর্নীতি করেননি সেটা বিশ্বাস করার মতো লোকও কম। আদালত কর্তৃক প্রমাণিত একজন ‘দুর্নীতিবাজ’ নেত্রীর মুক্তি চেয়ে দেশের বাইরে থেকেও কেউ সরকারকে অনুরোধ করেনি। বিদেশি কূটনীতিকদের কাছ থেকেও সরকার এব্যাপারে কোনও অনুরোধ পেয়েছেন বলে শোনা যায় না।

বেগম জিয়ার এখন জেল থেকে বেরিয়ে আসার উপায় দুইটি। এক. তাকে আইনি প্রক্রিয়ায় আদালত থেকে জামিন নিতে হবে। নতুবা দুই. সরকারের সঙ্গে একটা সমঝোতার মাধ্যমে তার মুক্তি হতে পারে। কোনোটাই সহজ কাজ নয়। ছয় মামলায় জামিন নিতে কতদিন সময় লাগতে পারে বলা মুশকিল। তবে সরকারের সঙ্গে বিএনপির গোপন সমঝোতা নিয়ে হাওয়ায় নানা রকম কথা ভাসে। তবে সেসব কথা তথ্যনির্ভর এবং বিশ্বাসযোগ্য কিনা তা বলা কঠিন।

বেগম জিয়ার মুক্তি পাওয়া-না পাওয়ার ওপর বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি অনেকখানি নির্ভর করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার নানা কৌশলেই বিএনপিকে চাপের মধ্যে রাখতে চায়। আদালতের রায় যে সরকারের কাজ কিছুটা সহজ করে দিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।

বিএনপি বলছে, বেগম জিয়াকে মুক্ত না করে তারা নির্বাচনে যাবে না। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এখন এমন পূর্বশর্ত দিলেও বিএনপি হয়তো শেষপর্যন্ত তাতে অটল থাকবে না। নির্বাচনে না যাওয়ার কোনও ভালো বিকল্প হয়তো বিএনপির থাকবে না। দল টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই হয়তো বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হবে। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, বিএনপি যে নির্বাচনি রাজনীতি থেকে আর বাইরে থাকতে চায় না, তার নমুনা দেখা গেছে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে।

বিএনপির জনসমর্থন আছে। কিন্তু রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে দলটি এখন এলোমেলো অবস্থায় আছে। দলীয় প্রধান কারাগারে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়েছে তারেক রহমানকে। কিন্তু তারেক এখন দেশের বাইরে। তিনি একজন দণ্ডিত আসামি। আদালতের ভাষায় তিনি পলাতক। আগামী নির্বাচনের আগে তার দেশে ফেরার সম্ভাবনা কম। তারেক রহমানকে বিএনপির কেউ কেউ দলের ভবিষ্যৎ কান্ডারি ভাবলেও তিনি ইতোমধ্যেই দলের জন্য বিরাট বোঝা হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশি পাসপোর্ট জমা দিয়ে তারেক ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন – বিএনপি এটা স্বীকার করার পর তারেক রহমান নতুন বিতর্কের মুখে পড়েছেন। তার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

দলের শীর্ষ দুই নেতার দলের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড থেকে প্রায় অনুপস্থিতির সুযোগে দলের মধ্যে নেতায় নেতায় বিরোধ নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। বাইরে যতোই দাবি করা হোক না কেন যে দল এখন আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ, কিন্তু ভেতরের খবর আলাদা। দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস কমছে বলে মনে হয় না। কারো কারো বিরুদ্ধে সরকারের হয়ে কাজ করার অভিযোগও আছে।

সব মিলিয়ে আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে। নির্বাচনের আগে বেগম জিয়া মুক্তি পেলে পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূলে আসতে পারে। তবে তিনি মুক্তি পেলেও নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নিতে  শারীরিকভাবে  কতটুকু সক্ষম থাকবেন, সেটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে দলটিকে চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হবে।

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি বিজয় দেখেছিল। তারা ধরে নিয়েছিল বেগম জিয়ার প্রতি সহানুভূতির জোয়ারে তারা ভেসে যাবে। কিন্তু খুলনায় নৌকার জয় বিএনপির অতিআস্থায় আবার কুঠারাঘাত করলো। এখন নির্বাচনে অনিয়মের যতো অভিযোগই আনা হোক না কেন, খুলনা সিটি এখন নৌকার, আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে। বিএনপি যে একের পর এক দুর্গ হারাচ্ছে – এটা দলের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে এবং সেভাবেই কর্মকৌশল ঠিক করতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ