X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

'মুক্তিযুদ্ধের বাংলায় রাজাকারের ঠাঁই নাই'

লীনা পারভীন
২৮ মে ২০১৮, ১৪:১৯আপডেট : ২৮ মে ২০১৮, ১৪:২৬

লীনা পারভীন একটা সময়ের খুব জনপ্রিয় স্লোগান ছিল এটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিলে কত শতবার উচ্চারণ করেছি এই লাইনগুলো। দিয়েছিলাম একটি চেতনার জায়গা থেকে। ছিল এক অদম্য দেশপ্রেম, রক্তগরম করা তেজ আর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা। এ ঘৃণা আমরা কোথায় পেয়েছিলাম?
আমার জন্ম হয়েছিলো একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে। তাই পরাধীনতার মর্ম বুঝার শক্তি বা সামর্থ্য কোনোটাই আমার হয়নি কিন্তু ভেতরে জন্মেছে এক ধরনের বিশ্বাস, যে বিশ্বাস আমাকে শিখিয়েছে কেন মুক্তিযোদ্ধারাই এ মাটির শ্রেষ্ঠ সন্তান, কারা এ দেশের জন্মকে আজও মেনে নিতে পারেনি। কে দেশপ্রেমিক আর কে নয়, কেমন করে দেশপ্রেমিক বা দেশদ্রোহীকে চিনে নিতে হয়। এসব শিক্ষাই পেয়েছি পরিবার থেকে। আমার পরিবার আমাকে একটি দেখার চোখ তৈরি করার রাস্তা বেছে নিতে সাহায্য করেছে। বাবা মায়ের কাছ থেকে শুনেছি কেমন করে পেয়েছি এই স্বাধীনতা। পরিবারের সদস্যকে হারিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির চক্রান্তের কারণে। আমার মা তার দুধ খাওয়া সন্তানকে কোলে নিয়ে দিনের পর দিন পালিয়ে বেড়িয়েছেন নিজেকে পাকিস্তানি আর এদেশীয় রাজাকারদের হাত থেকে বাঁচাতে। শুনেছি বাড়িতে বাড়িতে নারীরা মুখে কালি মেখে বসে থাকতো যাতে করে কারও চোখে না পড়ে যায়। চোখে পড়ে গেলেই সর্বনাশ। রাজাকাররা তুলে নিয়ে ফেলে দিত পাকিস্তানি হায়নাদের সামনে।

 

বড় হয়ে বই, পত্রিকা পড়ে, স্কুলে পাঠ্য বইয়ে ইতিহাস পড়তে গিয়ে শিখেছি, জেনেছি, চিনেছি অনেক কিছু। প্রচণ্ড বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও দেশে ছিল প্রগতিশীল চিন্তার বিকাশ। ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, বিদ্যালয়গুলোতে দেশপ্রেমিক শিক্ষক, 'প্রকৃত শিক্ষিত' শিক্ষক বলতে যা বুঝায় তাদের সংখ্যা ছিল বেশি এবং তারা কেবল পরীক্ষার জন্যই পড়াতেন না, সঙ্গে দিতেন একটা উন্নত জীবনবোধ ও জীবনকে দেখার মতো শিক্ষা।

 

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সমাজের সবজায়গাতেই নেমে এসেছে এক ভয়ঙ্কর অবক্ষয়। এসেছে বিচ্ছিন্নতার চর্চা। আমাদের সন্তানেরা বড় হচ্ছে এক চরম বিচ্ছিন্ন মানসিকতা নিয়ে। তাদের সামনে না আছে ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে জানার সুযোগ, না আছে বৃহত্তর অর্থে জীবনের অর্থ খুঁজে নেওয়ার মতো রাস্তা। তারা এখন জন্ম নিয়েই পরিচিত হচ্ছে বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে কিন্তু অন্ধকারে থেকে যায় নিজ দেশের বাস্তবতা। তাদের চিন্তার জগৎ প্রসারিত হচ্ছে বৈশ্বিক পরিবর্তনের মাধ্যমে কিন্তু বাদ পড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

আমি বলছি না তারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে কিন্তু সে যদি হয় বাংলা ভাষা শিখার আগে ইংরেজি বা হিন্দি শিখার মতো তাহলে অবশ্যই আপত্তি আছে। সন্তানদের আগে বুঝতে হবে নিজের দেশকে। জানতে হবে এ দেশটির একটি জন্ম ইতিহাস আছে, সে ইতিহাসে কার কী ভূমিকা এবং কাদের জীবনের বিনিময়ে আজকের এই মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ তারা পেয়েছে। শ্রদ্ধার জায়গাটি গড়ে তুলতে হবে সেই বীরদের জন্য, আর ঘৃণা করতে শিখতে হবে 'রাজাকার' 'আলবদর' মতাদর্শের লোকদের।

অতি সম্প্রতি কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে তর্ক-বিতর্কের অবতারণা সেখানেও আছে হতাশার দৃশ্য। কোটা সংস্কার বা বাতিল সে তর্ককে পাশে রেখেও যে বিষয়টি আতঙ্কিত করে সেটি হচ্ছে একদল তরুণ একজন মন্ত্রীর প্রচারিত একটি বক্তৃতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজেদের হাতে শরীরে রাজাকার লিখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেলো। কী ভয়ঙ্কর বিষয়। যে রাজাকার শব্দটি এদেশে সবচেয়ে ঘৃণার এবং পরিত্যাজ্য, সে শব্দটিকেই কিনা আমাদের তরুণ প্রজন্ম বেছে নিলো প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে? কেমন করে সম্ভব? এই 'রাজাকার' শব্দটি কেবল একটি শব্দ নয়, এটি একটি অধ্যায়, ইতিহাসের কলঙ্কিত একটি অংশ। এই শব্দটি উচ্চারণে কিছু মানুষ নয় হিংস্র পশুর চেহারা ভেসে আসে আমাদের সামনে। মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের জন্য এটি একটি আতঙ্ক, ঘৃণা ও ৭১-এ স্বজন হারানোর এক ভয়ঙ্কর স্মৃতিকে বয়ে বেড়ায়। আর আমাদের প্রজন্ম কিনা সেই শব্দটিকেই ভালোবেসে ফেলেছে? কিন্তু কেন? তারা কী জানে এই রাজাকারেরাই ছিল আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধের শক্তি? তারা কী জানে না এই রাজাকারেরাই হত্যা করেছে আমাদের শত শত বুদ্ধিজীবীকে?

 

এ কেমন করে সম্ভব? আমাদের তরুণ প্রজন্ম যদি 'মুক্তিযোদ্ধা' ও 'রাজাকার'-এর মধ্যে পার্থক্য না করতে পারে তাহলে কী দাঁড়াবে সামনের দিনগুলোতে? আমরা জানি সরকারের অনেক পরিকল্পনা আছে সর্বস্তরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পৌঁছে দেওয়ার। স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ছড়িয়ে দেওয়ার সঠিক ইতিহাস কিন্তু এর মাঝেই যে সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে তা ঠেকার উপায় কী? এর পেছনে কী আমাদের প্রগতিমনা রাজনৈতিক শক্তিদেরও দায় নেই? তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি সামাজিক কার্যক্রমও এখন মাইক্রোস্কপিং। নেই কোনও কমিটমেন্ট বা দায়বদ্ধতার জায়গা। নেই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যক্রম। আগের দিনে রোকনুজ্জামান দাদা ভাইয়ের মতো সমাজসেবকরা ছিলেন, যারা নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন সমাজের মেরুদণ্ড গঠনের কাজে। আজকে কই সেসব ঐতিহ্য? এখন আমাদের সবাই ব্যস্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক সাফল্য লাভের প্রতিযোগিতায়। অন্যদিকে মৌলবাদী শক্তি কি বসে আছে? একটু সচেতনভাবে খেয়াল করলেই বুঝা যাবে তারা সক্রিয় আছে নানা কৌশলে। তাদের প্রকাশনা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যক্রম অত্যন্ত শক্তিশালী।

সমাজে যখন সুস্থ চিন্তার বিকাশের রাস্তা না থাকে তখন সেখানে এসে জমা হয় অসুস্থ ও পচাগলা চিন্তার প্রক্রিয়া। আমাদের তরুণ সমাজ আজকে প্রচণ্ড মাত্রায় ইহলৌকিক চিন্তার জায়গায় আসক্ত হচ্ছে পারলৌকিক চিন্তার পেছনে। যে মানুষ ঠিকমতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে না, ইসলামের সঠিক নির্দেশনায় যে জীবনাচারণের বর্ণনা আছে সেগুলোর ধারে কাছেও নেই, সেই লোকও এখন আরেকজনকে ইসলাম নিয়ে বয়ান দিতে ভালোবাসে। জাগতিক সমস্ত সুযোগ সুবিধার পেছনে ছুটছে নিরন্তর কিন্তু নিজেকে একজন সহি মুসলিম পরিচয় দিতে উঠেপড়ে লেগে যায়। নামাজ রোজা না করলেই একজনকে নাস্তিক ট্যাগ দিয়ে ফেলছে খুব সহজেই। যেন একজন মানুষের আসল পরিচয় তার ধর্ম দিয়েই নির্ধারিত হয়। সে মানুষটির মানবিকতা, আন্তরিকতা, সামাজিক অবদান বা মানবিক বৃত্তিগুলোর কোনও দামই নেই। এই যে খুব সহজেই কাউকে বাতিল বা গ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা দেওয়ার প্রবৃত্তি এর থেকেই শুরু হচ্ছে বিচ্ছিন্নতার সংস্কৃতি।

যে হারে সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে, গুজব ছড়ানোর যে সংস্কৃতি শুরু হয়েছে এর থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকারি বেসরকারি এবং ব্যক্তিপর্যায়ে এখনই সচেতনতা এবং প্রস্তুতির সময় এসেছে। সমাজকে বিকৃতি থেকে রক্ষা করতে হলে দরকার সর্বমহলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এগিয়ে আসা। তরুণ সমাজকে বুঝাতে হবে 'রাজাকার' হতে চাওয়ার মধ্যে কোনও বীরত্ব নেই। এই দেশে রাজাকার হতে চাওয়া প্রজন্মের কোনও স্থান নেই। আমরা রাজাকার প্রজন্মের হাতে এই দেশকে ছেড়ে দিতে পারি না।  এর জন্য মুক্তিযোদ্ধারা বিনা দ্বিধায় জীবনে দেয়নি। এই দায় থেকে আমাদের মুক্তি নেই। আবেগে হলেও রাজাকার হতে চাওয়া যায় না। এই বোধের থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। মুক্তিযুদ্ধের এই বাংলায়, শেখ মুজিবের বাংলায় কোন 'রাজাকার' ঠাঁই পেতে পারে না, দেওয়া যায় না।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইয়াবাসহ ইউপি চেয়ারম্যানের ছোট ভাই গ্রেফতার
ইয়াবাসহ ইউপি চেয়ারম্যানের ছোট ভাই গ্রেফতার
‘কত সাহায্য চাওয়া যায়? আমাকে এখন দেহ ব্যবসা করার কথাও বলে’
রানা প্লাজার ভুক্তভোগীর আক্ষেপ‘কত সাহায্য চাওয়া যায়? আমাকে এখন দেহ ব্যবসা করার কথাও বলে’
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
বাংলাদেশের স্পিন বিভাগে পার্থক্য তৈরি করতে চান মুশতাক
বাংলাদেশের স্পিন বিভাগে পার্থক্য তৈরি করতে চান মুশতাক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ