X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভারতে তৃতীয় শক্তির উত্থানের প্রচেষ্টা

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
৩১ মে ২০১৮, ১৪:০১আপডেট : ৩১ মে ২০১৮, ১৪:০৪

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী জাতিকে শৃঙ্খলা শিখাবার জন্য স্বাধীনতা হরণ করতে হয় না। জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে ইন্দিরা গান্ধী কিন্তু তাই করেছিলেন। ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় ভারতের স্বাধীনতার শেষ জীবিত স্থপতি জয়প্রকাশ নারায়ণ কয়েকটা বিরোধী দলকে একত্রিত করে ভারতীয় জনতা দলের জন্ম দিলেন ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেসকে প্রতিরোধ করার জন্য। নির্বাচনে জয়প্রকাশ নারায়ণ সফল হলেন। রায়বরেলিতে স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধী রাজ নারায়ণের মতো একজন সাধারণ প্রার্থীর কাছে ৫০ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হলেন।
ইন্দিরা গান্ধী অনুভব করলেন সম্ভবত তার পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। অনেক সহকর্মী শাহ কমিশনের সামনে হয় ইমার্জেন্সির ভয়াবহতা সম্পর্কে অজ্ঞতা না হয় ইন্দিরা ও সঞ্জয়ের আদেশ পালনের অজুহাত তুলে ধরেছিলেন। আর যাই হোক, ইন্দিরা কিন্তু মানুষের হৃদয় জয় করার মন্ত্র জানতেন। না হলে শাহ কমিশনের বিচার মঞ্চকে তিনি তার প্রচার মঞ্চে পরিণত করতে পারতেন না।
কংগ্রেস এবং ইন্দিরা গান্ধীর অনুরূপ দুর্দিনে তার পাশ্বে দাঁড়িয়েছিলো খুবই শক্তভাবে কর্ণাটক রাজ্যের সাধারণ মানুষ। কর্ণাটকের চিকমাগালুর আসনের কংগ্রেস দলীয় এমপি ডি বি চন্দ্র গৌড়া তার আসনটি ছেড়ে দিয়ে দলীয় সভানেত্রী ইন্দিরাকে লোকসভায় ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। ইন্দিরা জানতেন এ আসনে জিতে এলে তার গায়ে হাত দেওয়া সহজ হবে না। তার নৈতিক বিজয় চূড়ান্ত হবে। তা-ই হলো। তিনি ৭০ হাজার ভোটের ব্যবধানে উপনির্বাচনে জিতলেন।

তারপর ডাইনির কড়াই উল্টে গেলো। ইন্দিরার সঙ্গে রাজনীতির পাশা খেলায় মোরারজি দেশাই, চৌধুরী চরণ সিং কেউ পারলেন না। আর শেষ পর্যন্ত ১৯৮০ সালের অন্তর্বর্তী নির্বাচনের দিকে দেশকে নিয়ে গেলেন তিনি এবং পরবর্তী লোকসভার নির্বাচনে জিতে ১৯৮০ সালে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে এলেন।

এখনও কংগ্রেস খুবই নাজুক পরিস্থিতির মাঝে দিন কাটছে। বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পণ করেছেন ভারত থেকে কংগ্রেসকে বিতাড়িত করবেন। তিনি তার এ শপথ রক্ষার জন্য দীর্ঘ ৭০ বছরের লালিত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে ফেলতে দ্বিধা করছেন না। কিন্তু এবার কর্ণাটকের বিধানসভা নির্বাচনের পর নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহকে স্তব্ধ হতে হলো। এমএলএ বেচাকেনার মতো নিন্দিত কাজ করতে পারলেন না বলে কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী পদে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থী ইয়াদুরাপ্পা শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করে সরে যেতে বাধ্য হলেন।

সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ থাকলেও কর্ণাটক বিধানসভার আস্থা ভোটের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট অনমনীয় মনোভাব দেখালেন। যে কারণে নরেন্দ্র মোদি অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কর্ণাটকে বিজেপিকে ক্ষমতায় টিকাতে পারলেন না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়া কংগ্রেসকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। দেবগৌড়া এখন জনতা দল (সেক্যুলার)-এর প্রধান। তারা বিধানসভার নির্বাচনের পর কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে সরকার গঠনের জন্য রাজ্যপালকে এমএলএদের নামের তালিকা দিয়েছিলেন। ১১৬ জন এমএলএ থাকার পরও রাজ্যপাল জোটকে সরকার গঠন করতে ডাকেননি, ১০৪ সদস্যের বিজেপিকে সরকার গঠন করতে অনুমতি দেন এবং ইয়াদুরাপ্পাকে শপথ প্রদান করেন।

রাজ্যপাল ইয়াদুরাপ্পাকে ১৫ দিন সময় দিয়েছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের জন্য, কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেরে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। স্বল্প সময়ের মাঝে কেনাবেচাও সম্ভব হয়নি আর ইয়াদুরাপ্পাও টেকেনি। এখন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন দেবগৌড়ার জ্যেষ্ঠ সন্তান জনতা দলের এইচ ডি কুমারস্বামী। কংগ্রেস কুমারস্বামীকে মুখ্যমন্ত্রী করে সকল দলকে এই বার্তা দিল যে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বৃহত্তম স্বার্থে মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিতেও দ্বিধা করে না। ভবিষ্যৎ জোট রাজনীতির জন্য এ বার্তাটি কিন্তু খুবই ফলপ্রসূ হবে।

পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রশেখর রাও, মহারাষ্ট্রের শরৎ পাওয়ার কংগ্রেস প্রধান রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব মানতে নারাজ। শরৎ পাওয়ার তো রাহুলের ঠাকুরমা ইন্দিরার মন্ত্রিসভার মন্ত্রী ছিলেন বহুদিন। শরৎ পাওয়ার নরসীমা রাও, রাজীব গান্ধী, মনমোহন সিংয়ের মন্ত্রিসভারও মন্ত্রী ছিলেন। এত প্রবীণ মানুষ রাহুলের নেতৃত্ব মানেন কি করে?

২০১৯ সালের মার্চ এপ্রিল মাসে ভারতের লোকসভা নির্বাচন। ভারতের রাজনীতিতে বহুদিন ধরে কংগ্রেসের নেতৃত্বে একটি জোট এবং বিজেপির নেতৃত্বে অন্য একটি জোট বিদ্যমান রয়েছে। মূলত এই দুই জোটই ভারতীয় রাজনীতিতে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। ভারতের আবার রাজ্যে রাজ্যে শক্তিশালী আঞ্চলিক দল রয়েছে, যারা কেউ কেউ এ দুই জোটের বাইরেও অবস্থান করছে।

এবার ধীরগতিতে দুই জোটের বাইরে থাকা দল ও শক্তিশালী ব্যক্তিদের নিয়ে তৃতীয় একটা জোট গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। তার নেপথ্যে নায়ক সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় । প্রণব মুখোপাধ্যায়কে আগামী মাসে আরএসএসএ’র একটা অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তিনিও অনুষ্ঠানে যোগদানের সম্মতি জানিয়েছেন। সাধারণভাবে বলা যায় এটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। বিজেপির লালকৃষ্ণ আদভানী, মুরলী মনোহর যোশীরাও নাকি তলে তলে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে রয়েছেন। কর্ণাটকের দেবগৌড়া (প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী) আর উড়িষ্যার পট্টিনায়কেরাও নাকি প্রণব বাবুকে সহায়তা করছেন।

বিজেপির প্রবীণ বহু নেতা নরেন্দ্র মোদির প্রতি সন্তুষ্ট নন। তারা তার সময়ে চূড়ান্ত অবহেলার সম্মুখীন হয়েছেন। নরেন্দ্র মোদি তার একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কোনও সিনিয়র নেতাকেই কী দলে কী সরকারে সম্পৃক্ত করেননি। সুতরাং নরেন্দ্র মোদির ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে প্রতিশোধ নিতে চাওয়া বিচিত্র নয়।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও প্রণব বাবুর সম্পর্কে ভালো। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক’দিন আগে বলেছেন ভারত এবার একজন বাঙালি প্রধানমন্ত্রী চায়। তিনি এ কথা বলে কি তার কথা বুঝাতে চেয়েছেন না প্রণব বাবুর কথা ইঙ্গিত করেছেন তা এখনও স্পষ্ট নয়। উত্তর প্রদেশের বহুজন সমাজবাদী দলের মায়াবতী এবং সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তারা উভয়ে বিবাদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারলে নরেন্দ্র মোদির হাত থেকে রাজ্যকে উদ্ধার করতে পারবেন না। এ জন্য দেখা যাচ্ছে যে মায়াবতী নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে ফুলপুর ও গোরখপুর লোকসভা নির্বাচনে এসপি প্রার্থীকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছেন। বিজেপি প্রার্থী এ দুই লোকসভা আসনে প্রচুর ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন।

গত ২৮ মে তারিখে উত্তর প্রদেশের কৈরানা লোকসভা আসন ও নুরপুর বিধানসভা আসনে উপনির্বাচন হয়েছে। আমার এ প্রবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত ফল প্রকাশিত হয়নি। ৩১ মে ফল প্রকাশিত হবে। মোজাফ্ফরপুরের কৈরানার লোকসভা কেন্দ্রের এবং বিজনৌর জেলার নুরপুর বিধানসভার উপনির্বাচনে শুধু মায়াবতীর দল ও অখিলেশের দল এক হয়নি, সেখানে লোকদল ও কংগ্রেসও তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। বিজেপির বিরুদ্ধে একক প্রার্থী।

কৈরানার লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হয়েছেন লোক দলের অবাসুম হাসান আর নুরপুর বিধান সভার প্রার্থী হয়েছেন এসপির মঈনুল হাসান। উভয় কেন্দ্রে মুসলিম ভোটের আশায় মুসলিম প্রার্থী করলেও হিন্দু ভোট গত লোকসভা ও বিধানসভার নির্বাচনের মতো একরোখা করে তুলতে পারলে তো বিজেপি প্রার্থীই জিতে যাবে। এখানে মোদি ম্যাজিকের পরীক্ষা হবে সঠিকভাবে। বিজেপি প্রার্থী যদি হেরে যায় তবে ধরে নিতে হবে উত্তর প্রদেশে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন আর বিজেপি ধরে রাখতে পারবে না। উত্তর প্রদেশে লোকসভার আসন ৮০টি আর ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিলো ৭১টি।

ভারতের আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি জোট নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থী প্রোজেক্ট করবে। বিরোধীরা যদি শক্তিশালী প্রার্থী প্রোজেক্ট করতে না পারে তবে বিজেপিকে পরাজিত করা কঠিন হবে। মহারাষ্ট্রে শরৎ পাওয়ার পশ্চিম বাংলার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তেলেঙ্গনার চন্দ্রশেখর রাও- এরা রাহুলের নেতৃত্ব মানবেন না।

কয়দিন পূর্বে সোনিয়া গান্ধীকে সাংবাদিকেরা জিজ্ঞেস করেছিলো আপনাদের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী কে? সোনিয়া বলে ছিলেন মনমোহন সিং এখনও শক্ত সামর্থ্য রয়েছেন। তিনিই আমাদের প্রার্থী, তার অবর্তমানে রাহুলই প্রার্থী হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির প্রেস্টিজ রয়েছে। এখানে ভারতের প্রেস্টিজই নরেন্দ্র মোদির প্রেস্টিজ কিন্তু মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হলে ভারতের প্রেস্টিজ ছাড়াও তার আন্তর্জাতিক বলয়ে নিজস্ব প্রেস্টিজ রয়েছে। সুতরাং বলা যায় মনমোহন সিং ভারতের একজন অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তিত্ব। সততার প্রশ্নে তিনি তর্কাতীত। কিন্তু জটিল রাজনীতির মারপ্যাচে তিনি অনেকটা অসহায়।

জোট রাজনীতি খুবই জটিল। তের বাড়ির এক উঠান ব্যবহারের মতো কঠিন। ভারতের গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যকে সমুজ্জ্বল রাখার জন্য প্রণব বাবুকে প্রার্থী করাই হবে উত্তম। সম্ভবত তার ব্যাপারে কোনও বিতর্ক হবে না। মহারাষ্ট্রের শিবসেনাও তাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সমর্থন দিয়েছিল। কংগ্রেসের বিষয়টা সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় নেওয়া উচিত হবে। আর না হয় পুনরায় ভারতের গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য নরেন্দ্র মোদির জাঁতায় পিষ্ঠ হয়ে বিপর্যস্ত হয়ে যাবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
করোনার পরে মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
করোনার পরে মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ