X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্রবাউল

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
০৪ জুন ২০১৮, ১৭:২৮আপডেট : ০৪ জুন ২০১৮, ১৭:৩২

মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান রবীন্দ্রবাউল শব্দটি বহু ব্যবহৃত এবং বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রচলিতও বটে। এমনকি একতারা হাতে নৃত্যরত রবীন্দ্রনাথের ছবিও দেখা যায়, যা অতি অবশ্যই কাল্পনিক। রবীন্দ্রনাথ ভাবুক ছিলেন, বাউল ছিলেন না আদৌ। তাঁর আত্মনিমগ্নতা এবং নিতান্তই গভীর আত্মোন্মচনের গানের মধ্যে বাউল-দর্শনের একটা আবহ ছিল। এটা হয়তো তাঁর সহজাত। তাঁর জীবনদেবতা কখনোই লালনের অধর মানুষ অথবা বাউলের মনের মানুষ নয়। তবু, তার মাত্র ১৯ বছর বয়সে রচিত ও মঞ্চস্থ, বাল্মিকীপ্রতিভা গীতিনাট্যটিতে, স্বয়ং বাল্মিকী চরিত্রের, দস্যুরাজ থেকে বৈরাগ্যে রূপান্তরের মধ্যেই যেন রবীন্দ্রনাথের বাউল ভাবের উন্মোচনের সংকেত শোনা গেছে। তবু তিনি সচেতনভাবে অ-বাউল।
রবীন্দ্রনাথ, জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে শিলাইদহতে আসেন ১৮৯০ সালে। সেই বছরই লালন সাঁইজি ফকির ইহলোক ত্যাগ করেন। ফলে দুজনের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার বিষয়টি তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু ভাবুকজনের কাছে তো চোখের দেখাটাই বড় কিছু নয়, বরং ভাবানুভূতির সংযোগটাই বড়। রবীন্দ্রনাথ যখন জমিদার হিসেবে শিলাইদহে আসেন, তখন তাঁর বয়স প্রায় ত্রিশ। কিন্তু এর আগেও বেশ কয়েকবার তিনি শিলাইদহে বেড়াতে এসেছেন, এবং কিছুদিন করে অবস্থান করেছেন। সে সময় তাঁর লালন সাঁইজির সঙ্গে দেখা হতেও পারে। এ সম্পর্কে বিভিন্নজনের লেখায় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে তাকে দলিল হিসেবে মেনে নেয়া যায় কিনা, বলা কঠিন।

রবীন্দ্রনাথের গহীন-গোপন-আপন-নির্জনতার গানের সংখ্যা অনেক। বিপুল বলাই ঠিক। তবে তার প্রায় কোনোটিই বাউল গান নয়। সচেতনভাবেই তিনি বাউল হতে চাননি। বিভিন্ন বিচিত্র ধারার আধুনিক গান রচনা করতে করতে তিনি প্রায়ই গহীন নিমগ্নতায় প্রবেশ করেছেন। তাঁর প্রেম এবং পূজার গানের যে বিভাজন তিনি নিজে করে গেছেন গীতবিতান-এ, তাও অনেক সময় দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। অনেক প্রেমের গানই শুনতে শুনতে কোথায় যেন পূজার আভাস চলে আসে ভাষার দ্বৈত অর্থ হয়ে। আসলে প্রেমিকের কাছ প্রেমাষ্পদ, কখন রূপের কখন অরূপের, তা ভাবুক কবির কাছেও হয়তো অনির্ণীত হয়ে উঠেছিল। তিনি যেভাবে, ওই পর্যায়ের প্রচুর সংখ্যক গানকে, প্রেম ও পূজা হিসেবে পৃথকীকরণ  করেছেন, তা আর কারো পক্ষে করা সম্ভবই ছিল না। জীবনকালেই তিনি এ কাজটি করে না গেলে, মহাসংকট সৃষ্টি হতোই। মজার ব্যপার হলো, রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিককার গানে রাগের মিশ্রণ তো ছিলই, কীর্তন এবং রামপ্রসাদী সুরের অনুসরণও পাওয়া  যায়। কিন্তু বাউল সুরের প্রভাব তাঁর গানে নেই বললেই চলে।

বঙ্গভঙ্গরদ আন্দোলনের সময়, কিছুটা অনুরুদ্ধ হয়ে, তিনি যেসব গানের বাণী রচনা করেছেন, তার প্রায় সবক’টিই, প্রচলিত বাউলাঙ্গের গানের ওপরে আধারিত। বাল্যকালে, ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়, অথবা কলকাতার রাস্তায়, যে বাউলগান তিনি শুনেছিলেন তার প্রভাব তার মনে গেঁথে গিয়েছিল। তাই তিনি যখন লিখলেন, ‘আমার সোনার বাংলা – আমি তোমায় ভালোবাসি’,  তখন তার জন্যে, গগন হরকরার, ‘আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’ এই গানের সুরের প্রায় পরিপূর্ণ ছায়াটাই গ্রহণ করেছেন। শিলাইদহে আসার পর, অনেক লালনশিষ্য এবং অন্যান্য বাউল-ফকিরদের সংস্পর্শে এসে বাউল গানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বাউল জীবন তিনি কখনো খুব কাছ থেকে দেখেননি। বাউল গানের যত কাছাকাছি তাঁর ভাবজগতের অবস্থান, বাউল জীবনের ঠিক ততটাই বা তার চেয়ে বেশি বিপরীতে তার বাস্তব জগতের অবস্থান।

আগেই বলেছি, রবীন্দ্রনাথ বাউল-ফকির নন। কিন্তু বৈষ্ণব বাউল বা সুফি ফকিরি  দর্শনের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় তার জীবনদেবতার দর্শন। তিনি যেখানে বুকের ভিতরে পথ কেটেছেন, সেই পথেই তিনি এক স্বাপ্নিক রবীন্দ্রবাউল। যেন এক সুফিসত্তার প্রতিবিম্ব।

লেখক: কবি ও কলামিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দিলেন এক ব্যক্তি
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দিলেন এক ব্যক্তি
দুই জনপ্রতিনিধির নাম বলে সাভারে সাংবাদিকের ওপর কেমিক্যাল নিক্ষেপ
দুই জনপ্রতিনিধির নাম বলে সাভারে সাংবাদিকের ওপর কেমিক্যাল নিক্ষেপ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
গরমে পুড়ছে খুলনা বিভাগ
গরমে পুড়ছে খুলনা বিভাগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ