X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

একরাম ট্র্যাজেডি

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০৬ জুন ২০১৮, ১৪:১৮আপডেট : ০৬ জুন ২০১৮, ১৪:২২

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা একরামের মৃত্যুর সময়কার অডিও’র প্রভাব এখনও মিইয়ে যায়নি। আলোচনা চলছে, সরকারও বলছে, একরামুল হক একরাম গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনায় তদন্ত হচ্ছে, এ ঘটনায় জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
ক্রসফায়ার, যা সাম্প্রতিককালে, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ নামে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে, তার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় ঘটে ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর। সারাদেশে নির্বিচার সংখ্যালঘু নির্যাতন,আওয়ামী লীগ কর্মীদের ঘরবাড়ি ছাড়া করার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা ধরে নিয়ে অপরাধী দমনের নামে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী হত্যার এক রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল ক্রসফায়ার। পুলিশ ও র‌্যাবের পাঠানো প্রায় সব গল্পই ছিল একরকম। প্রথম সেনা নামিয়ে অপারেশন ক্লিন হার্ট, পরে ২০০৪ সালে এলিট ফোর্স র‌্যাব গঠন করে এই অভিযানকে আরও অলংকৃত করা হয়। সেটিই এখন নতুন নাম পেয়েছে বন্দুকযুদ্ধ।
পাকিস্তান আর ভারতে অবশ্য ‘ফেইক এনকাউন্টার’ নামের এই গল্প অনেক আগে থেকেই পরিচিত। ২০১৫ সালে ফাউন্টেনইঙ্ক নামে ভারতের একটি জনপ্রিয় অনলাইনে একটি বড় প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। Fake encounters and real tragedies নামের সেই লেখায় বলা হয়– Encounters deaths have become a standard in police practice, receiving tacit support from the state and the judiciary.

প্রশ্নটা এখানেই। আইনের শাসনের কথা বললে, রাষ্ট্র ও তার বিচার বিভাগ এই গল্প মেনে নিতে পারে না। মাদকের বিস্তার ঘটলে বা আইনশঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হলে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনেক সময় কঠোর অবস্থান নিতে হয়। আইন তো বলে যেকোনও মূল্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাই পুলিশের কাজ এবং বেশিরভাগ সময় তা করতে হয় কঠিন সব পরিস্থিতির মধ্যে। এই কঠোরতা কখনও কখনও এমন সব বাহিনীকে নিষ্ঠুরতার পথেও নিয়ে যায়।

তবে এনকাউন্টার, ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ যাই বলা হোক না কেন, তা গণতান্ত্রিক সমাজে আইনের শাসনের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ। একরামের ঘটনায় ১০ জন লেখক, কবি এবং শিল্পী যে বিবৃতি দিয়েছেন সেখানেও এই প্রসঙ্গটি এসেছে। তারা বলেছেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় এমন মৃত্যু কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। সংবিধানে প্রদত্ত জীবনের অধিকার এভাবে কেড়ে নেওয়া যায় না। তারা বলেছেন, এই অভিযানে প্রতিদিন অনেক মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন। যা পুলিশ বন্দুকযুদ্ধে নিহত বলে বর্ণনা করছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থায় এমন মৃত্যু কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।

এখানেই বড় ভূমিকা বিচার বিভাগের। আমাদের বিদগ্ধ সমাজ বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে সরব। যারা সরব তারা অনেকে ক্ষমতায়ও ছিলেন, তখনও এই কাণ্ড হয়েছে। আমরা যতটা সরব এখানে ঠিক ততটাই যেন নীরব বা নিষ্ক্রিয় ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে। পৃথিবীর কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চয়ই দায়বদ্ধতার বাইরে নিজেদের নিয়ে যায় না।

সত্যি বলতে কী, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার ও পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু যেমন আমাদের গণতন্ত্র ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি অসম্মান প্রদর্শন, তেমনি এসব অপরাধের বিচার করতে না পারা আমাদের বিচার ব্যবস্থার ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। কোন অপরাধী, সে যতবড় অপরাধীই হোক না কেন, তাকে বিচার পাওয়ার অধিকার দিতেই হবে। বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদেরও বিচারিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই সাজা দিয়েছে। একই প্রক্রিয়া আমরা দেখেছি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রেও। এছাড়া আমরা বিশ্বাস করতে চাই যে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা আছে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অপরাধ দমনে।

যারা মাদকের কারবারি, বা ব্যবহারকারী, যারা সহিংসতা করে, জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যায়, তাদের হৃদয়ে ভয় ঢুকাতে হবে। কী সে ভয়? আইনের ভয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নয়। জনগণের আস্থা অর্জনে পুলিশ ও র‌্যাবকে আন্তরিক হতে হবে। পুলিশ নাগরিকের প্রাত্যহিক জীবনে এক ধরনের সামাজিক বিচারের সেবা দিয়ে থাকে। যেকোনও বিপদে মানুষ পুলিশকে খোঁজে। মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু বলা হয় পুলিশকেই। পুলিশের ভাবমূর্তি যত বেশি অমলিন রাখা যাবে, সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা তত বেশি ভালোভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব। বিনা বিচারে হত্যা পুলিশের ভাবমূর্তিকে বিনষ্ট করে।

নারায়ণগঞ্জের সাত খুন বা ইকরাম হত্যাকাণ্ড, দুটোই বড় প্রশ্নের মুখে ফেলেছে এলিট ফোর্স র‌্যাবকে। কিন্তু র‌্যাব সব কাজ খারাপ করছে, এমন কথা বলাও অন্যায়। র‌্যাবের কাছে তার অভিযানের যৌক্তিকতা যেমন খুঁজি, তেমনি তার সমালোচনাও যৌক্তিক হবে,সেটা প্রত্যাশিত।

দেশের আইনশৃঙ্খলার অবস্থা খারাপ হতেই পারে। যেকোনও পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এবং সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা অনেক বড়। কিন্তু সরকার যেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে না যায়। তাহলে তারা ন্যায্য-অন্যায্য অনেক ঘটনা ঘটাবে, অনেক সুবিধা নিতে ব্যস্ত হবে। আমাদের দেশের এই বাস্তবতা আমরা নানা সময় দেখেছি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় রাজনৈতিক সরকারের। একরাম ট্র্যাজেডি আমাদের সেই বার্তাই দিচ্ছে।

সাধারণ মানুষের ন্যূনতম শ্রদ্ধার আসনে পুলিশ বা র‌্যাব বাহিনীর অবস্থান ধরে রাখতে হলে বাহিনীকে তার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ধরে রাখতে হবে। বিপথগামী কোনও সদস্যকে বাহিনীর শক্তি দিয়ে আগলে রাখার প্রবণতা গ্রহণযোগ্য নয়। সামগ্রিক বিচারে যেকোনও দুর্বৃত্ত বাহিনী সদস্যের বিরুদ্ধে ত্বরিত বিশ্বাসযোগ্য কোনও ব্যবস্থা গ্রহণে এসব বাহিনী বিভাগ আগ্রহী—সেই বার্তা মানুষের কাছে নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আস্থার জায়গা অর্জন করতে হবে।

লেখক: এডিটর-ইন-চিফ, জিটিভি ও সারাবাংলা

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নির্দেশের পরও হল ত্যাগ করছেন না চুয়েট শিক্ষার্থীরা, বাসে আগুন
নির্দেশের পরও হল ত্যাগ করছেন না চুয়েট শিক্ষার্থীরা, বাসে আগুন
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ