X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘মিডনাইট জাজেজ অব পাকিস্তান’

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০৭ জুন ২০১৮, ১৪:৩৫আপডেট : ০৭ জুন ২০১৮, ১৪:৩৬

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী আমাদের দেশের পত্রপত্রিকায় কলামিস্টরা পাকিস্তান সম্পর্কে তেমন কোনও কিছু লেখার চেষ্টা করেন না। পাকিস্তানের চেয়ে ভারতীয় বিষয়ের ওপরই বেশি লেখালেখি হয়। ভারত অবশ্য নিকট প্রতিবেশী, পাকিস্তান এখন দূরের দেশ। আবার পাকিস্তানের ঘটনা খোলাসা করে আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়ও না। কারণ, পাকিস্তান লৌহযবনিকার অন্তরালে সব ঘটনাকে আড়াল করে রাখে।
পাকিস্তানে এখন নির্বাচনি ডামাঢোল বেজে উঠেছে। গত ৩১ মে পাকিস্তান পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ২৫শে জুলাই পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। ২৮ মে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ এবং বিরোধী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি সমঝোতার মাধ্যমে সাবেক প্রধান বিচারপতি নাসিরুল মুলককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছে। এখন বিশ্বে পাকিস্তান একমাত্র দেশ, যারা দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করছে। সাদা চোখে দেখলে পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা সত্যিই দৃষ্টিনন্দন আর প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের গত সপ্তাহে প্রদত্ত একটা সাক্ষাৎকার নিয়ে আলোচনা পেশ করছি, যাতে পাকিস্তানের প্রকৃত রাজনৈতিক অবস্থাটা পরিষ্কার হয়ে যায়। নওয়াজ শরিফ বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ডন পত্রিকার প্রতিনিধিকে মুলতানে এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন এবং ১২ই মে ডন-এ এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছে। এটি প্রকাশিত হওয়ার পর চতুর্দিকে শোরগোল শুরু হয়েছে এবং ডন পত্রিকার ওপরও কিছুটা চাপ সৃষ্টি হয়েছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তান প্রেস কাউন্সিল ডন পত্রিকার সম্পাদকের কাছে নোটিশ পাঠিয়ে বলেছেন, নওয়াজের সাক্ষাৎকার ছাপিয়ে পত্রিকাটি নীতিমালা ভঙ্গ করেছে। কিন্তু কোথায় কীভাবে নীতিমালা ভঙ্গ হলো তার কোনও সুনির্দিষ্ট বিবরণ দেয়নি। শুধু বলেছে তাদের তথ্য দেশের জন্য অবমাননাকর এবং পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব অখণ্ডতাকে খাটো করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। অবশ্য অনুরূপ কথাবার্তা তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশ গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না তারা গণমাধ্যমকে লাগাম পরানোর জন্য অনুরূপ অভিযোগ তোলার চেষ্টা করে।

নওয়াজ শরিফ খুবই নির্যাতিত প্রধানমন্ত্রী, জেনারেল পারভেজ মোশাররফ তাকে দেশ থেকে একবার বহিষ্কারও করেছিলেন। তিনি দীর্ঘ পাঁচ বছর সৌদি আরবে নির্বাসিত জীবনযাপন করেছিলেন। বাজপেয়ি যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী তখন নওয়াজ শরিফও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তারা উভয়ে চেষ্টা করেছিলেন উভয় দেশের মাঝে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার। যেটি পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সুনজরে দেখেননি।

তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর কোনও উল্লেখযোগ্য কাজ করতে পারেননি তিনি। সেনাবাহিনী এবং সুপ্রিম কোর্ট পদে পদে বাধা প্রদান করে দেশ পরিচালনায় অক্ষম করে তুলেছিলেন তাকে। ১২ মে’র সাক্ষাৎকারে নওয়াজ শরিফ সেই কাহিনিই বলেছেন সবিস্তারে। নওয়াজ শরিফ দুঃখ করে বলেছেন, পাকিস্তানে দৃশ্যত একটা সরকার দেশ চালাচ্ছে বলে মনে হলেও অদৃশ্যভাবে আরও একাধিক সরকার রয়েছে, যাদের হাতে মূল ক্ষমতা থাকে। তিনি বলেছেন ‘যদি দুটি বা তিনটি সরকার সমান্তরালে চলতে থাকে, তাহলে আপনি দেশ চালাতে পারবেন না। এটি বন্ধ হতে হবে। দেশে একটি সরকারই থাকবে, যা সাংবিধানিক’। এমন একটা তথ্য ফাঁস করে নওয়াজ শরিফ হাটে হাঁড়ি ভেঙেছেন, যা হজম করা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের পক্ষে খুবই কঠিন হয়েছে।

২০০৮ সালে ভারতের মুম্বাইতে পাকিস্তানের লস্কর-ই-তৈয়বা হোটেল তাজমহল এবং ওবেরয়, রেলওয়ে স্টেশন ও শপিংমলে হামলা চালিয়ে ১৬৬ জন মানুষ হত্যা করেছিল। ওই হামলা প্রসঙ্গে নওয়াজ শরিফ বলেন, এখনও সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো, যাদের নন-স্টেট অ্যাকটর বলা হচ্ছে, তারা সক্রিয়। ‘আমাদের কি উচিত হয়েছে তাদের সীমান্ত পার হতে এবং মুম্বাইয়ে ১৫০ লোক হত্যা করতে দেওয়া’। ওই ঘটনার বিচার প্রসঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা কেন বিচার শেষ করতে পারলাম না। রাওয়ালপিন্ডির সন্ত্রাসবিরোধী আদালতে বিচারইবা কেন থেমে গেল? অথচ পাকিস্তান তখন ওয়াদা করেছিল হামলার সঙ্গে জড়িতদের ধরবে এবং তাদের বিচারে সোপর্দ করা হবে।’

নওয়াজ শরিফ আরো বলেন, ‘নন-স্টেট অ্যাকটরেরা বোম্বেতে যাদের জন্য যুদ্ধ করল সেটা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। এ কথা পুতিনও বলেছেন, চীনের প্রেসিডেন্টেরও একই অভিমত’। নওয়াজ শরিফকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যাওয়ার কারণ কী ছিল? তিনি এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা ও বৈদেশিক নীতি টেনে বলেন, ‘আমরা আমাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছি। বহির্বিশ্ব আমাদের ব্যাখ্যা গ্রহণ করেনি’। তৃতীয় দফা ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়া সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে নেওয়াজ শরিফ বলেন, ‘এতে তার কোনও অনুশোচনা নেই। এমন কি তিনি যদি পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসেন, আগের চেয়ে ভিন্ন কিছু হবে না। সংবিধানকেই সবার উপরে স্থান দিতে হবে’। মোশাররফের সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমরা একজন স্বৈরাচারের বিচার করেছি। এর আগে অনুরূপ স্বৈরাচারের কেউ বিচার করেননি।’

নেওয়াজ শরিফের আগে সরকার ছিল আসিফ আলী জারদারির। তখন পিপিপির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইউসুফ রাজা গিলানি। তাকে নির্মমভাবে বিতাড়িত করেছিল নেপথ্য সরকার। তার কাছ থেকে একটা সাক্ষাৎকার নেওয়ার কেউ উদ্যোগ নিলে আরও বহু প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসবে। অবশ্য কতটুকু রাজি হবেন দেখার বিষয়, যেখানে তার নিজের ছেলেও নিখোঁজ ছিল তিন বছর। মার্কিন ও আফগান বাহিনী পাকিস্তানের গিলানির অপহৃত পুত্রকে জীবিত উদ্ধার করেছে আফগানিস্তান থেকে। এখন মিলিটারিরা ক্ষমতায় এলে বিশ্বদরবারে বিপদগ্রস্ত হতে হবে, তাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এখন ক্ষমতা দখল করে না। তারা নিজেরা বিভিন্ন কলাকৌশলে নির্বাচিত সরকারকে অকার্যকর রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকেন। অনুরূপ কাজে এখন তাদের হাতিয়ার হলো বিচার বিভাগ।

সেনাবাহিনীই তাদের অনুগত লোকদের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন। সেনাবাহিনীই এসব বিচারপতির নিয়োগপত্র প্রেসিডেন্টকে দিয়ে মধ্যরাতে স্বাক্ষর করায়। এজন্য এখন পাকিস্তান হাইকোর্টে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মিডনাইট জাজেজ অব পাকিস্তান বলে থাকে। মোশাররফের পর কোনও প্রধানমন্ত্রীই এযাবৎ সুপ্রিম কোর্টের কোপানল এড়িয়ে চলতে পারেননি। পেছনে কিন্তু কলকাঠি নাড়ে সেনাবাহিনী।

আমেরিকার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট ছিলেন এডামস। তিনি তার দায়িত্ব জেফারসনকে বুঝিয়ে দেওয়ার আগের রাতে অনুরূপ কিছু তার অনুগত লোককে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছিলেন। এডামসের কুমতলব ছিল জেফারসনকে অকার্যকর করা। আমেরিকার ইতিহাসেও এই জজগুলোকেও মিডনাইট জাজেজ বলা হতো। এডামস-এর অনুগতদের মাঝে জন মার্শালও ছিলেন। তিনি জেফারসনকে বহু কষ্ট দিলেও আমেরিকার বিচার ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করেছিলেন। জেফারসন আর প্রধান বিচারপতি জন মার্শালের দ্বন্দ্বই আমেরিকার গণতন্ত্র ও বিচার ব্যবস্থাকে সুন্দর পরিকাঠামো প্রদান করেছিলেন।

জেফারসন নির্বাচকমণ্ডলীর শুভবুদ্ধিতে বিশ্বাস করতেন। কাজেই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু মার্শাল মানুষের চেয়ে আইনকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। তাই তিনি বিশ্বাস করতেন, সম্ভব হলে আইন গণতন্ত্রের আবেগ প্রবণতাকে মেনে নেবে। কিন্তু প্রয়োজন হলে নিয়ন্ত্রণ করবে। দুর্ভাগ্য যে পাকিস্তানের মিডনাইট জাজেজদের মধ্য থেকে কোনও জন মার্শালের আর্বিভাব হয়নি। সেনাবাহিনীর প্রতি অকৃত্রিম অনুগত্যই তাদের কাজ। সুতরাং দেশটাতে কোনও নির্বাচিত সরকারই কার্যকর হচ্ছে না দীর্ঘদিনব্যাপী।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ