X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

বৈষম্যের বালিতে ঢেকে থাকা আগুন

জোবাইদা নাসরীন
১৩ জুন ২০১৮, ১৭:০৬আপডেট : ১৩ জুন ২০১৮, ১৭:০৮

জোবাইদা নাসরীন আমরা শিক্ষক লাউঞ্জে বসে সেদিনের ফাইনাল খেলাটি দেখছিলাম। খুব বেশি দর্শক নেই। মোটে ৭/৮ জন। খুব বেশি শোরগোলও নেই। তবে যারা দেখছিলেন, তারা খুব মনোযোগ দিয়েই দেখছিলেন। দেখছিলাম সে ২০/২২ বয়সী মেয়েগুলো ক্ষীপ্রতার সঙ্গে দৌড়াচ্ছে আর রান নেওয়ার চেষ্টা করছে।  দুই-একজন টিভি সেটের সামনে বসে থাকলেও পড়ছিলেন পত্রিকা। কারণ একটাই, সেটি  হলো খেলছে মেয়েরা। সেই খেলা নিয়ে এত মাথাব্যথার কী আছে? আর এই লাউঞ্জটির চিত্রই অন্য রকম হতো, যদি এখানে সাকিব, মাশরাফি আর তামিমরা খেলতো। ভেসে আসতো চিৎকার, কানে বাজতো হাততালির শব্দ। বাংলাদেশে এতদিনকার চিত্র ছিল মেয়েরা শুধু দর্শক হয়েই জাতীয় দলের খেলা দেখবে এবং খেলাশেষে কখনও কখনও খেলা জেতার উৎসবে তাদের মুখে রঙ মাখার অজুহাতে তাদের যৌন হয়রানির শিকার হতে হবে।
বিশ্ব ক্রিকেটে ভারত বড় দল। আর এশিয়ার ক্রিকেটে প্রবল পরাক্রমশালী। অপ্রতিরোধ্য। একরকম অপরাজেয়। এবারের চিত্র ব্যতিক্রম। একবারে ব্যতিক্রম, তবে খুবই প্রত্যাশিত। অভাবনীয় ঘটনার সাক্ষী ক্রিকেট অনেকবারই  হয়েছে। কিন্তু এটিকে রাখতে হবে একদম প্রথম দিকে। মেয়েদের এশিয়া কাপ আগে ৬ বার হয়েছে। ৬ বারই চ্যাম্পিয়ন ভারত। কোনোবারই একটি ম্যাচও হারেনি! গত বছর ইংল্যান্ডে ওয়ানডে বিশ্বকাপে রানার্সআপ ভারত। চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি অল্পের জন্য। সেই দলকে হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা। এই জয় ছিল দাপটের, আত্মপ্রত্যয়ের। কিন্তু সেই জয় নিয়ে খুব বেশি আনন্দ মিছিল হয়নি, শোভাযাত্রা হয়নি। পত্রিকাগুলো বড় বড় ছবি ছাপায়নি। সাক্ষাৎকার ছাপায়নি নারী ক্রিকেটারদের। সব কিছুই ছিল চোখে পড়ার মতো।

এশিয়া কাপ জিতেছে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দল। দেশের ক্রিকেট ইতিহাসেরই সবচেয়ে বড় অর্জন এটি। গোটা দেশ উচ্ছ্বসিত মেয়েদের এই সাফল্যে। তবে প্রথমদিন চুপচাপ থাকা এবং পুরো একদিন সমালোচনার মুখে থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) মেয়েদের জন্য ঘোষণা করেছে দুই কোটি টাকা পুরস্কারের। দলের প্রত্যেক খেলোয়াড় পাবেন ১০ লাখ টাকা করে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের মেয়েদের পথচলা খুব বেশি দিনের নয় এবং তাদের গুরুত্ব বোঝা আরও অনেক পরের ঘটনা। পেছন ফিরে তাকালে, দেশের ক্রিকেটে মেয়েদের শুরুটাও ছিল বেশ বন্ধুর। বিসিবি মেয়েদের ক্রিকেটকে একটু গুরুত্ব দিয়ে দেখতে শুরু করেছিল ২০০৬-২০০৭ সালের দিকে। তবে এই নজর দেওয়াও যে নিজেদের আগ্রহে ছিল তা নয়, আইসিসি মেয়েদের ক্রিকেট নিয়ে জোর দেওয়ায় বিসিবিও বাধ্য হয়েছিল নজর দিতে।

তবে সেই নজরও খুব বেশি যে জোরালো ছিল তা নয়। ২০১১ সালের নভেম্বরে দেশের মাটিতে নারীদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে পঞ্চম স্থান দখল করার পর বাংলাদেশ নারীদল পায় ওয়ানডে স্ট্যাটাস। প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে ৮২ রানে হারিয়ে দেয় আয়ারল্যান্ডকে। প্রথম টি-টোয়েন্টি ২০১২ সালের আগস্টে, সেটিতেও জয় আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। জয়ে শুরু হলেও জয় ছিল না নিয়মিত। তার চেয়েও বেশি হতাশার, খেলাই ছিল না নিয়মিত। না আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে, না ঘরোয়া ক্রিকেটে। এই মৌসুমেই যেমন, হয়নি প্রিমিয়ার লিগ। ঘরোয়া ক্রিকেটের দায়সারা একটি সূচি করা হয়, যেটি মানা হয় খুব কম সময়ই। মেয়েদের ঘরোয়া ক্রিকেট এলেই বিসিবির মাঠ সংকট হয়ে ওঠে তীব্র। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, সফরের সুনির্দিষ্ট সূচি নেই। এমনকি ট্রেনিং, ক্যাম্প, অনুশীলনের জন্যও মাসের পর মাস অপেক্ষায় থাকতে হয় মেয়েদের।

দেশের ক্রিকেটে নারী ক্রিকেটারদের বেতন-ভাতা বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনার বয়সও অনেক দিন হলো। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বেতন-ভাতা ও আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধা ছিল নিতান্তই নগণ্য। অবশেষে টনক নড়ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি)। বাড়তে যাচ্ছে মেয়েদের বেতন-ভাতা ও আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধা।  এই  টনক নাড়িয়েছেন খোদ সালমা-রোমানারাই। তাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে। বর্তমানে ১৭ জন নারী ক্রিকেটার বিসিবির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ আছেন বেতনধারী হিসেবে। তাদের বেতন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা। ছেলেদের ক্ষেত্রে এই অঙ্ক সর্বনিম্ন লাখের কোটায়। ছেলেদের জাতীয় লিগে প্রথম স্তরে ম্যাচ ফি ২৫ হাজার টাকা, দ্বিতীয় স্তরে ২০ হাজার। বিসিএলে ম্যাচ ফি ৫০ হাজার টাকা। মেয়েদের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচ ফি ৬০০ টাকা মাত্র!  ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বেতনে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। ‘এ’ প্লাস গ্রেডে থাকা মাশরাফি-মুশফিক-সাকিবরা যেখানে পান ৪ লাখ টাকা, সেখানে জাহানারা-রুমানাদের বেতন মাত্র ৩০ হাজার টাকা। মেয়েদের ‘এ’ গ্রেডের ক্রিকেটাররা পান ২০ হাজার আর ‘বি’ গ্রেডের ক্রিকেটাররা পান ১০ হাজার করে। আন্তর্জাতিক ম্যাচে (ওয়ানডে) ছেলেরা যেখানে পান দুই লাখ টাকা, সেখানে নারী ক্রিকেটাররা পান ৮ হাজার টাকা। নারী ক্রিকেটারদের বেতন কম হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, নারীদের ম্যাচে দর্শক কম হয় এবং স্পন্সরশিপ বাবদ কম অর্থ পাওয়া যায়।

বিশ্বের অন্যান্য ক্রিকেট শিবিরের দিকে দেখলে দেখা যাবে নারী ক্রিকেটারদের উন্নয়নের জন্য সবার আগে এগিয়ে আসে উইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড। ২০১০ সালে তারা কেন্দ্রীয় চুক্তির অধীনে নারী ক্রিকেটারদের নিয়ে যায়। বছরে তাদের উপার্জন ২৫ লাখ টাকা। ইংল্যান্ডের মেয়েরা পায় ৫২ লাখ টাকার কাছাকাছি। পাকিস্তান অনেক কম, তারপরও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। বছরে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টাকার মতো। আর অস্ট্রেলিয়ার নারী ক্রিকেটারদের কথা শুনলে মাথা ঘুরে যেতে পারে, নতুন চুক্তিতে বছরে বাংলাদেশি টাকার অঙ্কে প্রায় সোয়া ১ কোটি টাকা উপার্জন করছেন তারা। সেখানে বাংলাদেশের মেয়েরা মাসের হিসেবে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা ও ‘সি’ ক্যাটাগরিতে সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা উপার্জন করেন। যা বছরে দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ৩ লাখ ৬০ হাজার ও সর্বনিম্ন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।

বলা হয় যে, ক্রিকেট বিশ্বে পঞ্চম ধনী বোর্ড বাংলাদেশের। আইসিসির হিসাব অনুযায়ী, বিসিবির সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৪১০ কোটি টাকা (৫১ মিলিয়ন ইউএস ডলার)। অথচ সেই দেশের নারী ক্রিকেটের এমন হাল। এ নিয়ে নীতি-নির্ধারকদের একই কথা বলেন যে  স্পন্সর আসে না। স্পন্সর না এলে টাকা পাওয়া যায় না।

যে দেশে বয়স দশ হলেই মেয়েদের খেলাধুলা সামাজিকভাবে বন্ধ  যায়, আমি জানি, নিশ্চিতভাবেই জানি  সে দেশ এই মেয়েগুলোর এই  পযায়ে আসতে কতটা সংগ্রাম করতে হয়েছে। কত শত প্রতিবন্ধকতার দেয়াল তাদের টপকাতে হয়েছে। পারিবারিক বাধা, সামাজিকতার চোখ রাঙানি, শারীরিক ও মানসিক সীমাবদ্ধতা, সবকিছুকে জয় করে এগিয়ে গেছে মেয়েরা। এই ঢাকা শহর নয়, এই মেয়েদের বেশিরভাগই মফস্বল থেকে ওঠে এসেছে। বিশেষ করে খুলনা আর বগুড়ায় স্থানীয় কোচদের অক্লান্ত পরিশ্রম, আন্তরিকতা আর একাগ্রতায় সেখান থেকে উঠে এসেছে এক গাদা ক্রিকেটার। অনেক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে ধীর পায়ে হলেও এখন বেশ দৌড়েই এগিয়ে চলছে মেয়েদের ক্রিকেট। সোনার মেয়েরা, তোমাদের জন্য বুকভরা ভালোবাসা।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এনভয় টেক্সটাইলসের ২৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা
এনভয় টেক্সটাইলসের ২৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা
প্রসঙ্গ ‘অলক্তক’
প্রসঙ্গ ‘অলক্তক’
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করতে বাজার কমিটির সহযোগিতা চায় এফবিসিসিআই
অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করতে বাজার কমিটির সহযোগিতা চায় এফবিসিসিআই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ