X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

ইফতারের রাজনীতি, রাজনীতির ইফতার

আবদুল মান্নান
১৫ জুন ২০১৮, ১১:২০আপডেট : ১৫ জুন ২০১৮, ১৬:০১

আবদুল মান্নান দেখতে দেখতে পবিত্র রমজান শেষ হয়ে গেলো। এখন ঈদের প্রস্তুতির ধুম। ঈদ কেনাকাটাও শেষ প্রায়।  ঢাকা শহর হতে প্রায় সত্তর আশি লাখ মানুষ নাড়ির টানে নিজ গ্রাম বা শহরে ফিরে গেছে। একটি পার্বন বা ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে একসঙ্গে এতো মানুষের শহর ছাড়া হওয়ার নজির বিশ্বে আর কোনও দেশে নেই। যাওয়াতে ঝুঁকিও কম ছিল না। তবে বড় ধরনের কোনও দুর্ঘটনার খবর এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। রমজানের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় হচ্ছে দিন শেষে রোজাদারদের ইফতার। সন্ধ্যায় সময় হলে সকল রোজাদার সামর্থ অনুযায়ী কোনও খাদ্যদ্রব্য মুখে দিয়ে দিনের শেষে রোজা খুলেন। বলা হয় সময়ের আগে ইফতারির সামনে বসে থাকলেও নাকি পুণ্য হয়। কোনও কারণে কেউ রোজা না থাকলেও তিনিও ইফতারে শামিল হতে পারেন। আবার কোনও ক্ষেত্রে দেখা যায় অন্য ধর্মাবলম্বীরাও ইফতারে যোগ দিতে বেশ উৎসাহবোধ করেন। ক’দিন আগে আমার কন্যা লন্ডন হতে ফোন করে জানালো তাদের ক্যাম্পাসের মসজিদে তারা তাদের অন্যান্য ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থী ও এলাকার মানুষকেও এক শুক্রবারে ইফতারে শামিল হতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। লন্ডনে এখন ইফতারের সময় সন্ধ্যা সাড়ে দশটায়। ওই দিন অন্য ধর্মের প্রায় শ’দুয়েক মানুষ তাদের সাথে ইফতারে শামিল হয়ে ইফতারের আনন্দ উপভোগ করেছিল। এই উদ্যোগ ছিল অনেকটা পাশ্চাত্য জগতে ইসলাম সম্পর্কে যে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণ সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করার একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস। বলা যেতে পারে এই ইফতার ছিল একটি জনসংযোগের বা সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য আয়োজিত ইফতার।  উল্টোটাও আছে। ভারত ও বাংলাদেশে বেশ কিছু বৌদ্ধ বা সনাতন ধর্মাবলম্বী প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলো নিয়মিত মুসলমানদের জন্য ইফতারের আয়োজন করে। উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক হানাহানির যুগে এমন আয়োজন সৌভ্রাতৃত্বের একটি ভালো লক্ষণ।  সৌদি আরবসহ অন্যান্য আরব দেশে বহুদিন ধরে চালু আছে করপোরেট ইফতার। বড় বড় মসজিদে, যেমন পবিত্র মক্কা ও মদিনার দুই হেরেম শরিফে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রমজান শুরু হওয়ার আগ হতেই দুই হেরেমের সামনে ও ভেতরে বিরাট বিরাট এলাকার দায়িত্ব নিয়ে থাকে, যেখানে তারা রোজাদারদের ইফতার সরবরাহ করবে।  তাদের ইফতারে সাধারণত থাকে শুকনা ফল, যেমন কিশমিশ, বাদাম, আখরোট আর দূধের ঘোল, যার নাম লাবাং। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের গ্র্যান্ড মসজিদে প্রতিবেলা পঁচিশ হাজার মানুষকে ইফতার সরবরাহ করা হয়। ছুটির দিনে সেই সংখ্যা পঁয়ত্রিশ হাজার পর্যন্ত হতে পারে। এই বিশাল আয়োজন সরকারিভাবে হয়ে থাকে। ঢাকা শহরে যেহেতু ইফতারের সময় প্রচুর মানুষ যানজটে পড়ে, তাই বেশ কিছু করপোরেট হাউস ওই আটকে পড়া মানুষদের ইফতার সরবরাহ করে থাকে। এটিও একটি জনসংযোগমূলক কাজ, ভালো কাজ।

ইফতার আবার রাজনীতির জন্যও ব্যবহার হতে দেখা যায়। এই ইফতারগুলো রাজনৈতিক দলগুলো অথবা তাদের নেতারা স্বস্ব উদ্যোগে আয়োজন করে থাকেন।  সরকারিভাবেও এই ইফতারের আয়োজন হয়ে থাকে। তবে সেসব ইফতার শুধু আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য। প্রধানমন্ত্রী প্রায় গোটা দশেক ইফতারের আয়োজন গণভবনে করে থাকেন। প্রতিটি ইফতারে প্রায় পনেরো হাজার মানুষের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়। গাড়ির ড্রাইভার হতে শুরু করে নিরাপত্তাকর্মী কেউই বাদ যান না। অতিথি আপ্যায়নের ব্যাপারে শেখ হাসিনা অনেকটা বাবা বঙ্গবন্ধুর মতো। কেউ যেন না খেয়ে না যায়। প্রধানমন্ত্রীর ইফতারের একটি বড় দিক হচ্ছে ইফতারের আধঘণ্টা আগে তিনি অনুষ্ঠানস্থলে এসে সকল অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। যারা তাঁর সঙ্গে দেখা করার তেমন একটা সুযোগ পান না তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটু কুশল বিনিময় করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন। তাঁর সঙ্গে ঘটনাচক্রে একটি ছবি উঠলে তাতে তারা নিজেকে ধন্য মনে করেন। শেখ হাসিনা কখনও ইফতারের সময় কোনও রাজনৈতিক বক্তব্য রাখেন না। বস্তুতপক্ষে তিনি কোনও বক্তব্যই রাখেন না। ব্যতিক্রম শুধু দলীয় নেতাকর্মীদের জন্য আয়োজিত ইফতার। তাতেও তাঁর একটা পরিমিতিবোধ থাকে। বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতিও নির্বাচিত অতিথিদের জন্য ইফতারের আয়োজন করেন। বিএনপিও ক্ষমতায় থাকুক বা নাই থাকুক নিজেদের মতো করে একাধিক ইফতারের আয়োজন করে। এবার তাদের নেত্রী কারাগারে বলে তেমন আয়োজন দেখা যায়নি। ক্ষমতায় থাকলে বেগম জিয়া তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যেও আওয়ামী লীগের তুমুল সমালোচনা করতে ছাড়েন না। আর না থাকলে বলেন– ‘দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এমন ভয়াবহ হয়েছে যে দেশের রোজাদাররা সামান্য ইফতারটুকু করারও সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে। দেশে এখন নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে’। এটি হচ্ছে ইফতারের রাজনীতিকরণ। এবার বিএনপি ইফতারের আয়োজন না করলেও তাদের সমর্থক দল ও গোষ্ঠীগুলো নানা ধরনের ইফতারের আয়োজন করেছে। সেসব ইফতারে বদরুদ্দোজা চৌধুরী, খোন্দকার মোশাররফ হোসেন, কর্নেল অলি আহম্মদ, মির্জা ফখরুল গং বক্তব্য রেখেছেন। যার মূল বিষয় হচ্ছে বেগম জিয়ার কারামুক্তি, আর তাদের ভাষায় ‘সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণ’। বি. চৌধুরী এক ইফতার অনুষ্ঠানে এক ধাপ উপরে ওঠে বলেন, বেগম জিয়াকে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে পাঠানো হোক। অনেকে প্রশ্ন করেছেন, বেগম জিয়ার পূত্র তারেক রহমান দশ বছর ধরে লন্ডনে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তার কোনও উন্নতি হয়নি বলে তার আইনজীবীরা বাংলাদেশের আদালতে অসংখ্যবার বলেছেন। সেই লন্ডনে বেগম জিয়ার মতো একজন বয়স্ক মানুষের চিকিৎসা নিয়ে কী হবে? বিএনপি’র আর এক বড়মাপের বুদ্ধিজীবী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী অবশ্য বলেছেন, বেগম জিয়ার চিকিৎসা টিমে একজন মনোবিজ্ঞানী থাকা প্রয়োজন। কেন তিনি তা বলেছেন চিকিৎসক হিসেবে তিনি তা ভালো বুঝবেন। তবে ইফতার সামনে রেখে রাজনীতি করার একটি সুখ্যাতি বিএনপি’র সব সময় ছিল।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতবর্ষেও ইফতার নিয়ে রাজনীতি বা রাজনীতির ইফতার কম হয় না। এপিজে আবদুল কালাম যখন সেই দেশের রাষ্ট্রপতি তখন হতে রাষ্ট্রপতি ভবেন ইফতারের আয়োজন শুরু হয়। সেই ইফতারে মুসলমান কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ আমন্ত্রিত হতেন। পরবর্তী রাষ্ট্রপতিরাও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন।ব্যতিক্রম দেখা দিল বিজেপি’র বর্তমান রাষ্ট্রপতি রাজনাথ কোবিন্দের আমলে। এই বছর হতে রাষ্ট্রপতি ভবনে ইফতার বন্ধ। এটি নাকি করা হয়েছে ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য। রাষ্ট্রপতি ভবনের এই আকস্মিক সিদ্ধান্তে ভারতজুড়ে তুমুল আলোচনা শুরু হলো। বিজেপি আর তাদের অঙ্গসংগঠনগুলো এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বললো, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষে এমন একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই। তবে তারা ভুলে গেছেন যে রাষ্ট্রপতি ভবনে হিন্দুদের দিওয়ালি উৎসবে এমন আয়োজন হরদম করা হয়। একশো কোটির বেশি মানুষের দেশ ভারতবর্ষে সাড়ে সতের কোটি (বাংলাদেশের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি) বা ১৪.২ শতাংশ মানুষ মুসলমান। তবে একজন মুসলমান ধর্মীয় নেতা বেশ গুরুত্বের সাথে বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি ভবনে ইফতার অনুষ্ঠানের আয়োজন হলেও মুসলমানদের কোনও লাভ নেই আর না হলেও কোনও ক্ষতি নেই। তবে এই সিদ্ধান্তে এটি প্রমাণিত হলো, কালাম কোবিন্দের তুলনায় অনেক উদার ছিলেন’। যেদিন রাষ্ট্রপতি ভবন হতে এই সিদ্ধান্তাটা জানানো হলো সেই রাতে দিল্লির এক হোটেলের নিজ কক্ষে টিভি খুলে দেখি বিষয়টি নিয়ে সে কী তুলকালাম। প্রায় টকশোতে আলোচকরা অনেকটা নিজ নিজ অবস্থানে অনড় এবং দু’ একজন আলোচক তো পারলে এখনই তার প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইফতার নিয়ে এমন রাজনীতি অভূতপূর্ব।

ইন্দিরা গান্ধী যখন কংগ্রেস প্রধান তখন দলের উদ্যোগে ইফতার আয়োজন শুরু হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর তা বন্ধ হয়ে যায়। এই বছর রাষ্ট্রপতি ভবনে ইফতার বন্ধ হওয়ার পরপরই কংগ্রেসের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি ইন্দিরার পৌত্র রাহুল গান্ধী ঘোষণা করলেন, কংগ্রেস এবার ইফতারের আয়োজন করবে। যেমন কথা তেমন কাজ। ক’দিন আগে কংগ্রেসের ইফতার হয়ে গেলো। তবে সেই ইফতারে সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। কারণ, তিনি সম্প্রতি কট্টোর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএস-এর এক সভায় প্রধান অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন। অনেকের ধারণা, প্রণব বাবু আগামীতে বিজেপি’র হয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে চান। তাকে প্রধানমন্ত্রী না করে কংগ্রেস তার প্রতি অন্যায় করেছিল বলে সম্ভবত  তার বিশ্বাস।  এমন কথাই বলছে ভারতের গণমাধ্যম। রাহুল গান্ধীর ইফতারটি ছিল রাজনৈতিক ইফতার। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও তার পূর্বসূরিদের মতো হোয়াইট হাউসে নির্বাচিত মুসলমান কমিউনিটি নেতাদের জন্য ইফতারের আয়োজন করেছিল। তবে এই ইফতারে নাকি কোনও মুসলমান উপস্থিত ছিলেন না। তেমন খবরই দিয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যম।

বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসেও ইফতারের আয়োজন করা হয় এবার নাকি সবচেয়ে জমকালো আয়োজনটা করে আমাদের ইসলামাবাদ দূতাবাস। এই আয়োজনেও যে একটু রাজনীতি ছিল না তা বলি কী করে। একসময়ের পারিবারিক ইফতার এখন নানামূখী বৈচিত্র্যে ভরপুর। সাহরিতেও বেশ নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।  চট্টগ্রামের এক কমিউনিটি সেন্টারে সাহরির আগে ঘণ্টা দু’ এক গান বাজনা হয়, চলে নাচের অনুষ্ঠান। তারপর সাহরি খেয়ে ‘রোজাদার’রা বাড়ি ফিরেন। ঢাকায় তো তারকা খচিত হোটেলে সাহরি পার্টিতে যোগ দেওয়া এখন একটি ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই লাখ মানুষ ঈদের বাজার করতে কলকাতা গিয়েছেন। যারা এখনও বলেন বাংলাদেশ ফকির মিসকিনের দেশ, মানুষ না খেয়ে থাকে, তারা নির্বোধ অথবা জ্ঞানপাপী। সকলে পরিবারের সঙ্গে নির্ঝঞ্ঝাটে বাড়ি যান, ঈদ করুন আর নিরাপদে কর্মস্থলে ফিরে আসুন। ঈদ মোবারক।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক

 

/এসএএসে/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ