X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদ বিষয়ক একটি লিফলেট

রেজানুর রহমান
১৬ জুন ২০১৮, ১৩:০৬আপডেট : ১৭ জুন ২০১৮, ১৩:২৬

 

রেজানুর রহমান ঢাকা এখন প্রায় ফাঁকা। যেন এক জাদুর শহর। যেন জাদুর মতোই ভেলকি দেখিয়ে ঈদের ছুটিতে নাড়ির টানে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে শহরের অধিকাংশ মানুষ। কেউ একা আবার কেউ দলে-বলে ঢাকা ছেড়েছে। যানজটের পাশাপাশি নানান ঝামেলায় পড়েও সবার হাসিমাখা মুখে গভীর আগ্রহ, কখন ফিরবো গ্রামে... এসব বিষয় নিয়েই আমাদের সোবহান সাহেব তার এক বন্ধুর সঙ্গে পার্কের বেঞ্চিতে বসে আলাপ করছিলেন। সোবহান সাহেবের বন্ধুর নাম আমজাদ হোসেন। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। পার্কে হাঁটতে এসেই সোবহান সাহেবের সঙ্গে পরিচয়। পার্কে আসা-যাওয়া করতে করতেই দু’জনের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। এখন ব্যাপারটা এমন হয়েছে যে কোনও কারণে মন খারাপ হলেই একজন অন্যজনকে ফোন করেন। তখন হয় পার্কের বেঞ্চিতে বসে কথা বলেন, না হয় ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে কথা সেরে নেন।

ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল আমজাদ হোসেনের। সেজন্য সোবহান সাহেবের কাছ থেকে বিদায়ও নিয়েছিলেন। বিদায় নেওয়ার সময় সোবহান সাহেবের জন্য অনেক হা হুতাশ করেছেন। হা হুতাশ করার কারণ হলো সোবহান সাহেব এবার ঈদে গ্রামের বাড়ি যেতে পারছেন না। অবশ্য সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। বাসের টিকেট পাওয়া নিয়ে বাধলো বিপত্তি। সোবহান সাহেব তার ছেলের বাসায় থাকেন। ছেলে ব্যবসায়ী। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। যদিও বাসের টিকেট জোগাড় করা ছেলের পক্ষে কোনও ব্যাপারই না। তবু এটাকেই কেন যেন গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হলো। বাসের টিকেট পাওয়া যাচ্ছে না। কাজেই এবার আমরা ঢাকায় ঈদ করবো। ছেলের একটি ঘোষণায় সব পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায় সোবহান সাহেবের। মন খারাপ। তাই পার্কে এসে বসেছেন। একবারও ভাবেননি আমজাদ হোসেনের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। অথচ তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন– ভাই আপনি? গ্রামে যান নাই... আমি তো ভাবছিলাম... আমজাদ হোসেন বিষণ্ন মুখে হাসি ছড়িয়ে বললেন, না, শেষ পর্যন্ত গ্রামে যাওয়া হলো না।

কেন, কেন? উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করলেন সোবহান সাহেব। আমজাদ হোসেন শুকনো মুখেই আবার হাসি ছড়িয়ে বললেন, বয়সের একটা মূল্য আছে, সেটা মানেন তো...।

বয়সের মূল্য মানে? অবাক কণ্ঠে জানতে চাইলেন সোবহান সাহেব। আমজাদ হোসেন আবারও শুকনো মুখে হাসি ছড়িয়ে বললেন, আপনাকে একটা কথা বলি, মনোযোগ দিয়ে শোনেন। মানুষের জীবনে বয়সটাই হলো আসল। যেমন ধরুন, চল্লিশের পর শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়ে কর্মদক্ষতার জোর বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে... ঠিক কিনা?

আমজাদ হোসেনের প্রশ্ন শুনে সোবহান সাহেব মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ কথা ঠিক...।

আমজাদ হোসেন আবার বলতে শুরু করলেন, পঞ্চাশের পর সৌন্দর্যের কোনও দাম নাই। যতই সাজুগুজু করেন না কেন চোখের নিচে কালি পড়বেই...। আবার ধরেন ষাট বছরের পর পুরনো চেয়ারের দাম নাই। কারণ, আপনি রিটায়ার করেছেন। চেয়ার তো আপনার কথা শুনবে না। সত্তর বছর বয়সের পর বুড়ো আর বুড়িকে নিয়ে এই বাড়ি আর ওই বাড়ির মধ্যে ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে যায়। কারণ, ছেলেমেয়েদের অনেকে বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে চায় না। আর আশি বছর বয়সে আপনার যদি অনেক টাকাও থাকে তাহলেও দাম পাবেন না। কারণ, আপনাকে অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে চলতে হবে। বলেই থামলেন আমজাদ হোসেন। সোবহান সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আমার কথাগুলোর মানে কি আপনি বুঝতে পারছেন?

সোবহান সাহেব ভেবে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ আমি বুঝতে পেরেছি... আমরা দু’জনই এখন আছি সত্তরের ঝামেলায়। এই বাড়ি আর ওই বাড়ির ঠেলাঠেলি...। আমজাদ হোসেন মৃদু হেসে বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন, আমরা আছি সত্তরের ধাক্কায়। না ঘরকা, না ঘাটকা! এই শুনলাম ঈদের ছুটিতে গ্রামে যাচ্ছি। মন খুশিতে ভরে গেলো। কতদিন গ্রামে যাই না। ইট-কাঠের এই শহর আর ভালো লাগে না। ওমা হঠাৎ শুনি গ্রামে যাওয়ার প্রোগ্রাম ক্যানসেল...।

কেন, কেন..., প্রোগ্রাম ক্যানসেল হলো কেন? সোবহান সাহেব প্রশ্ন করলেন। আমজাদ হোসেন বললেন, কারণ কিছু না। টিভিতে বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলা দেখতে হবে, তাই গ্রামে যাওয়ার প্রোগ্রাম ক্যানসেল...।

আমজাদ হোসেনের কথা শেষ হতে না হতেই সোবহান সাহেব বললেন, ওমা সেকি গ্রামেও তো বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলা দেখা যাবে। বাংলাদেশের গ্রাম কি আর সেই গ্রাম আছে? অনেক বদলে গেছে...।

আমজাদ হোসেন মন খারাপ করে বললেন, এই কথা কে কাকে বুঝাবে বলেন। শুনতেছি বাসার ভেতর বড় পর্দায় বিশ্বকাপের খেলা দেখা হবে। সেজন্য ব্যাপক আয়োজন চলতেছে। বাসার ভেতরই দুইটা দল তৈরি হয়ে গেছে। একদল ব্রাজিল, অন্যদল আর্জেন্টিনা। ভাই আপনি কোন দল? ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা? সোবহান সাহেব মুখে বিরক্ত মুখে বললেন, আমি দুই দেশের একটাও না।

তাহলে কি জার্মানি?

না।

তাহলে জাপান?

না। আমি বাংলাদেশের পক্ষে...।

সোবহান সাহেবের কথা শুনে আমজাদ হোসেন হাসতে হাসতে বললেন, বাংলাদেশ তো ভাই ফুটবল বিশ্বকাপে নাই... কাজেই আপনি তো...।

সোবহান সাহেব বললেন, আমি জানি বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ফুটবলে নাই। তবুও আমি বাংলাদেশের পক্ষেই কথা বলবো। কেন বলবো জানেন? কারণ, আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের বাংলাদেশ একদিন না একদিন ফুটবলের বিশ্বকাপে খেলবে...।

সোবহান সাহেবের কথা শুনে আমজাদ হোসেন সহানুভূতির সুরে বললেন, ভাই আমি আপনার কথার সঙ্গে একমত। ক্রিকেটের বিশ্বকাপে আমরা খেলতে পারলে ফুটবলের বিশ্বকাপেও খেলতে পারবো। কিন্তু ভাই আমরা কি সেজন্য প্রস্তুত? এই ঈদের কথাই ধরেন তো... কে না জানে ঈদে শহরের মানুষ গ্রামে যাবে! কাজেই পথে যানবাহনের চাপ বাড়বে। এজন্য রাস্তাঘাট পরিষ্কার রাখতে হবে। এটাই তো স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু তা কি মানছি আমরা? পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেকোনও ফ্যাস্টিভ্যালে দ্রব্যমূল্যের দাম কমে যায়। আর আমাদের দেশে ঘটে তার উল্টোটা। দাম বেড়ে যায়। আপনি ক্রিকেটের কথা বললেন। সেখানেও তো পক্ষপাতিত্ব কাজ করে। ছেলেদের ক্রিকেট আর মেয়েদের ক্রিকেটের সুযোগ সুবিধার মধ্যে আসমান আর জমিন পার্থক্য। আর ফুটবলের কথা বললেন না? আমাদের দেশে খেলা হিসেবে ফুটবল কি যথার্থ পরিচর্যা পায় বা পাচ্ছে?

আমজাদ হোসেন আর সোবহান সাহেবের মধ্যে মোটামুটি একটা তর্কযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। হঠাৎ তাদের সামনে একজন তরুণ এসে দাঁড়াল। বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দিয়ে বললো, স্যার আপনারা যদি অনুমতি দেন তাহলে কিছু কথা বলতাম...। তরুণকে দেখে আমজাদ হোসেন ও সোবহান সাহেব দুজনই কিছুটা অবাক হয়েছেন। সোবহান সাহেব তরুণকে জিজ্ঞেস করলেন– আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন? কি কথা?

স্যার একটু বসি।

হ্যাঁ বসেন।

সোবহান সাহেবের অনুমতি নিয়ে ঘাসের ওপর বসলো তরুণ ছেলেটি। তার হাতে ধরা লিফলেট সাইজের অনেক কাগজ। তারই একটা সোবহান সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দিল।

সোবহান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন– কী আছে এই কাগজে। তরুণ ছেলেটি মুখে হাসি ছড়িয়ে বললো, স্যার কাইন্ডলি যদি একটু পড়ে দেখেন...।

সোবহান সাহেব কাগজটা পড়লেন এবং পড়াশেষ করে আমজাদ হোসেনের হাতে তুলে দিলেন। আমজাদ হোসেন পড়া মুখস্থ করার মতো করে কাগজের লেখাগুলো পড়তে শুরু করলেন,

প্রিয় দেশবাসী ঈদ মোবারক। ঈদ মানেই খুশি ঈদ মানেই আনন্দ। আপনাদের এই খুশি আর আনন্দে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো যুক্ত করেছেন কি?

ক. ফিতরা কাকে দিচ্ছেন? ফিতরাদানের ক্ষেত্রে নিয়ম মানছেন তো?

খ. নিজের জন্য নতুন কাপড় কিনেছেন, আপনার প্রতিবেশীর খোঁজ রাখছেন তো?

গ. ঈদে বিদেশি টেলিভিশন অনুষ্ঠান বর্জন করে দেশের পক্ষেই থাকুন। দেশের টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখুন। বিভিন্ন পত্রিকার ঈদ সংখ্যা হতে পারে ঈদের সেরা উপহার। কাজেই এ ব্যাপারেও আন্তরিক থাকুন!

লিফলেটের কথাগুলো অনেক ভালো লাগলো সোবহান সাহেবের। তরুণ ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন– তোমার নাম কী?

ছেলেটি মৃদু হেসে বললো– আমার নাম সবুজ।

তুমি কী করো?

কলেজে পড়ি।

তুমি হঠাৎ এই লিফলেট বিলি করছো কেন? তুমি কি একা এই কাজ করছো?

সোবহান সাহেবের কথা শুনে সবুজ বিনীত ভঙ্গিতে বললো, না আমি একা নই। আমাদের একটা বন্ধু সার্কেল আছে। ঢাকা শহরের ২০টি এলাকায় আমরা বন্ধুরা এই লিফলেট বিলি করছি।

সবুজের কথা শুনে সোবহান সাহেব অভিভূত কণ্ঠে বললেন, বাবা, আমরা কি তোমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি?

সবুজ যেন প্রথমে বুঝতে পারেনি। তাই অবাক হয়ে জানতে চাইল, আপনারা মানে...।

এবার আমজাদ হোসেন বললেন, আমরা তোমাদের এই লিফলেট বিতরণের কাজে যুক্ত হতে চাই। সঙ্গে নিবে আমাদেরকে।

সবুজ খুশি হয়ে বললো, তাহলে তো বেশ ভালোই হয়। আসুন, আসুন আমার সঙ্গে... বলেই সোবহান সাহেব ও আমজাদ হোসেনের হাতে কিছু লিফলেট তুলে দিলো সবুজ। তারপর ওরা তিনজন একসঙ্গে সামনের দিকে পা বাড়ালো...।

প্রিয় পাঠক, লিফলেটের লেখাগুলো আরও একবার উল্লেখ করতে চাই। ফিতরা কাকে দিচ্ছেন? ফিতরাদানের ক্ষেত্রে নিয়ম মানছেন তো? নিজের জন্য নতুন কাপড় কিনেছেন। আপনার প্রতিবেশীর খোঁজ খবর রাখছেন তো? ঈদে বিদেশি টেলিভিশন অনুষ্ঠান বর্জন করুন দেশের টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখুন। বিভিন্ন পত্রিকার ঈদ সংখ্যা হতে পারে ঈদের সেরা উপহার।

প্রিয় পাঠক, পবিত্র ঈদের শুভেচ্ছা নিন। ঈদ মোবারক।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো।

আপ-এআর

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইরান ইস্যুতে তৃতীয় বৈঠকে বসছে ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা
ইরান ইস্যুতে তৃতীয় বৈঠকে বসছে ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা
নেপাল ও ভুটান সফরে গেলেন পররাষ্ট্র সচিব
নেপাল ও ভুটান সফরে গেলেন পররাষ্ট্র সচিব
নাহিদের আগুন বোলিংয়ে হারলো মোহামেডান
নাহিদের আগুন বোলিংয়ে হারলো মোহামেডান
উৎসব থমকে যাচ্ছে ‘রূপান্তর’ বিতর্কে, কিন্তু কেন
উৎসব থমকে যাচ্ছে ‘রূপান্তর’ বিতর্কে, কিন্তু কেন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ