X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

হিটলার, লেডি ম্যাকবেথ, নিরো, সেনেকা এবং

চিররঞ্জন সরকার
১৭ জুন ২০১৮, ১৭:৪৩আপডেট : ১৭ জুন ২০১৮, ১৭:৪৩



চিররঞ্জন সরকার চরিত্রগুলো ঐতিহাসিক। কিন্তু মনে হয় আমাদের কত পরিচিত। আমাদের প্রতিদিনের সংবাদপত্রের হেডলাইনগুলোর ‘স্রষ্টা’বা ‘নেপথ্য কারিগর’দের সঙ্গে এই চরিত্রগুলোর কী আশ্চর্য মিল!
প্রথমেই হিটলারের কথা স্মরণ করা যাক। আমরা জানি হিটলার ছিলেন নির্বাচিত শাসক। জার্মানির সাধারণ মানুষের মনে হয়েছিল হিটলার হবেন এমন শাসক, যিনি জার্মানদের হৃত সম্মান পুনরুদ্ধার করতে পারবেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত ও অপমানিত জার্মানির পক্ষ থেকে যথোপযুক্ত প্রতিশোধ নিতে পারবেন। হিটলারের বক্তৃতা মাতিয়ে দিয়েছিল পুরো জার্মান জাতিকে।
যদিও সেসব বক্তৃতার অসারতা দেখিয়েছেন চার্লি চ্যাপলিন তার ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ চলচ্চিত্রে। অথচ ফ্যাসিবাদ তো ন্যাশনাল সোস্যালিজমের কথাই বলে। জার্মান জাতির পুনরুত্থানের স্বপ্ন, স্বপ্নই তো সেটা। আর সেই পুনরুত্থানের স্বপ্নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক পুঞ্জীভূত ক্রোধ। ব্যক্তিগত ও জাতীয় ক্রোধ তৈরি করছে সম্মোহ। সেখান থেকেই অ্যাডলফ হিটলার পাচ্ছেন গণতান্ত্রিক সমর্থন, অর্থাৎ ভোট পেয়ে দখল করছেন পার্লামেন্ট। পেয়ে যাচ্ছেন জার্মান জাতিকে সম্পূর্ণ করতলগত করার ক্ষমতা। সেখান থেকেই সৃষ্টি করছেন এক উন্মাদনা ও একনায়কতন্ত্র। ‘হেইল হিটলার’ ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছে সারা জার্মানিতে। যারা বুঝতে পারছেন, জার্মানি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। বিপন্ন বিরোধীরা, বিপন্ন ইহুদিরা। জার্মানিজুড়ে একজনের কাট-আউট, ফ্যুরার স্বয়ং। অন্য কোনও নেতা নেই, অন্য কোনও বিরোধী নেই। বিরোধিতার অর্থ গুপ্তহত্যা। কোনও বিচার নেই। কেননা বিচারালয় নেই। জাতীয় ক্রোধ থেকে সম্মোহ, সম্মোহ থেকে গোটা জার্মান জাতি যেন উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। হিটলার যেন সেই উন্মাদনা ও পাগলামিসৃষ্ট এক দানব!
কী করছিল তখন সোশ্যালিস্ট, কমিউনিস্ট, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা? নিজেদের মধ্যে কলহ করছিল। হিটলারের যখন উত্থান হচ্ছিল, তখন একে অন্যের দুর্দশায় মজা পাচ্ছিল। তারপর তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। যারা কফিনবদ্ধ হলেন তাদের কথা আলাদা। অনেকে দেশত্যাগ করলেন তাদের কথাও বাদ দেওয়া গেলো। বাকি সবাই প্রাণের ভয়ে নাৎসি দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলেন। প্রাণের ভয় বড় ভয়। সেই ভয়কে কাজে লাগিয়েছিলেন হিটলার। একনায়কতন্ত্রীরা গণতন্ত্র মানার ভান দেখিয়ে ক্ষমতা দখল করে, কিন্তু একবার ক্ষমতায় এলে গণতন্ত্র ধ্বংস করা এবং স্বৈরতন্ত্র কায়েম করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী কী ভয়ঙ্করভাবে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও নিধন করেছে, তা বিভিন্ন চলচ্চিত্রে বিদ্যমান। কিন্তু এ-কথাও সত্য, যেখানেই স্বৈরতন্ত্র কায়েম হয়, সেখানে আবির্ভাব হয় একদল নরপশুর। ক্ষমতার অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের যদি গণতান্ত্রিক উদ্দেশ্য ও দর্শন না থাকে, দেখা যাবে, অযোগ্য লোকে ভরে যাবে প্রশাসন, অশিক্ষিত ও অন্ধকার মনের মানুষ যেন পাতাল ফুঁড়ে উঠে আসবে, তখন মধ্যাহ্নে নামবে অন্ধকার। কাক, চিল, শকুন উড়ে বেড়াবে আকাশে।
স্বৈরতন্ত্রে কোনও লিঙ্গভেদ নেই। হিটলার বা মুসোলিনি শুধু পুরুষ বলেই ফ্যাসিস্ট, এমন নয়। নারী শাসক হলে ব্যতিক্রমী কিছু হতো বলে মনে হয় না। যদি ক্ষমতায় না-থাকতে পারা যায়, তা হলে স্বৈরতন্ত্রীর মাংসাশী সাঙ্গপাঙ্গরাই তাকে খেয়ে ফেলবে। এটা এক ধরনের কমপ্লেক্স, যা প্রতিনিয়ত ঈর্ষা, ক্রোধ ও হিংসা তৈরি করতে থাকে। কাছের লোক একটু শক্তি বা ক্ষমতা অর্জন করলে তাকে দল থেকে হয় তাড়িয়ে দিতে হয় না হয় নিশ্চিহ্ন ও নিখোঁজ করে দিতে হয়। স্বৈরতন্ত্রের একটাই আইডেন্টিটি। ক্ষমতা বা পাওয়ার। এটা এক ধরনের ফ্যান্টাসি, যা কোনও যুক্তির ধার ধারে না। নার্সিসিজম্ বা আত্মরতিতে আবদ্ধ এই পরিচয়। ড. জনসন এ জন্যই বলেছিলেন, এই সব ক্ষমতার ফ্যান্টাসি যুক্তিতে ধ্বংস করে দেয় এবং ‘সেটাই হলো উন্মাদের পাঠক্রম, যা আত্মধ্বংসী’ এবং যা শান্ত নির্মল পারিপার্শ্বকে ধ্বংস করে দেয়। আর শাসকের ‘নারী’ হওয়া মানেই রাষ্ট্রের বা রাজ্যের সব মেয়েরা নিরাপদ তেমন হওয়া প্রায় অসম্ভব। পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজ ব্যবস্থায় ‘স্বৈরতন্ত্রী’ শাসকের অস্ত্র হলো লুম্পেন, লেঠেল, গুণ্ডা ও মর্ষকামী বিকৃত রুচি ও নারী-ধর্ষণকারী। ‘স্বৈরতন্ত্রী’র ধর্মই এদের প্রশ্রয় দেওয়া। রাজা ডানকানকে হত্যা করার ক্ষেত্রে লেডি ম্যাকবেথের ভূমিকা এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য।
পল পট যেমন দলকে ব্যবহার করে স্বৈরতন্ত্র চালিয়েছিল, স্বৈরতন্ত্রী শাসকও দলকে ব্যবহার করে নিশ্চয়ই। একা তো সব কিছু করা যায় না! কিন্তু দলের সেই সব লোক শাসকের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকবে, আবার অন্যদেরও সন্ত্রস্ত করে রাখবে। এখানে তাই প্রথমে ব্যক্তি অর্থাৎ স্বৈরতন্ত্রী শাসক, তার পর প্রতীক এবং তার পর স্বৈরতন্ত্রী শাসকের নিজস্ব চার বা পাঁচজনের কোর গ্রুপ। সেখানে লোক বদলাতে পারে, কিন্তু কয়েকজন সব চাইতে নির্ভরযোগ্য সদস্য থাকবেন যেমন গোয়েবল্‌স, হিমলার। পার্টির নিজস্ব বাহিনী থাকবে, গুপ্ত খুনি থাকবে। এদের লেলিয়ে দেওয়া হবে। লেলিয়ে দিতে হবে না, প্রশ্রয় দিয়ে ছেড়ে দিলেই হবে নিরীহ নারী-পুরুষের দিকে। কোনও মাংসাশী প্রাণী পুষতে গেলে তাকে মাংস খাওয়াতে হয়, আলো হাওয়ায় খেলতে দিতে হয়, গরিব ভিখারিকে ভয় পাওয়ানোর ট্রেনিং দিতে হয়। ঠিক সে রকমভাবে কিছু মানুষ ও বুদ্ধিজীবীদের পুষতে হয় এই শাসককে। এ কথা কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রে বলে গিয়েছে। আরও বলেছেন যে গুপ্তচর হলো শাসকের একটি বড় শক্তি। ম্যাকডাফ্ প্রসঙ্গে ম্যাকবেথ বলেছিল, ‘আই হ্যাভ কেপ্ট আ সারভ্যান্ট ফিইড ইন হিজ হাউস।’ স্বৈরতন্ত্রী শাসকের আরও একটি বড়ো অবদান সন্ত্রাসের সঙ্গে সঙ্গে অপসংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দেওয়া এবং মূল্যবোধ ধ্বংস করা।
রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট নিরো স্বৈরতন্ত্র ও স্বেচ্ছাচারিতার আর এক মূর্ত প্রতীক। তার সম্পর্কে সবাই একটি কথাই বলেন, রোম যখন পুড়ছিল, সম্রাট নিরো তখন বেহালা বাজাচ্ছিলেন। এই বেহালা বাজানো স্বৈরতন্ত্রীর এক চূড়ান্ত নার্সিসিজমের প্রতীক অথবা এ-যেন সম্ভাব্য ধ্বংসের ও আত্মহত্যার প্রতীক। এই নিরো প্রকাশ্যে আত্মহত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন দার্শনিক ও নাট্যকার সেনেকাকে। অথচ, সেনেকা ছিলেন তার পরম প্রিয় গৃহশিক্ষক (টিউটর)। ক্যালিগুলার মৃত্যুর পর নিরোর পিতার আদেশ অমান্য করতে পারেননি সেনেকা। তিনি নিরোর গৃহশিক্ষক হতে চাননি, তবু তাকে সে দায়িত্ব নিতে বাধ্য করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে কীভাবে যেন রটে গেলো, সেনেকা সম্রাট নিরোকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছেন। সেই সব ঘটনার পরও নিরো সেনেকাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন, বলেছিলেন, যে যাই বলুক তার প্রিয় গুরুকে তিনি চিরকাল একই সম্মান দেবেন। সে দিনই কিছুক্ষণ পরে আদেশ বের হলো প্রকাশ্যে, স্বজন-পরিজন পরিবৃত হয়ে আত্মহত্যা করতে হবে সেনেকাকে।
স্বৈরতান্ত্রিক শাসকের চিরকালই বিরোধীদের দমন করার একটি-ই অস্ত্র–ষড়যন্ত্র, হত্যার ষড়যন্ত্র, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। রাজতন্ত্রে ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতায় আসার দৃষ্টান্ত অসংখ্য। তথাকথিত গণতন্ত্রেও এ দৃষ্টান্তের অভাব নেই। দলভাঙা, দলগড়া- এটা যেন রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, খেলা ভাঙার খেলা। আওরঙ্গজেব নিজে খুনি ও ষড়যন্ত্রী ছিলেন বলে নিজের ছায়াকে ভয় পেতেন। আর শেক্সপিয়র তার ম্যাকবেথ নাটকে দেখিয়েছেন, লেডি মাকবেথ কীভাবে রাত্রে হেঁটে বেড়াতেন আর অজ্ঞানে, ডানকানের হত্যার দৃশ্যের সংলাপ বলতেন। চিকিত্সক হতবাক হয়ে বলে উঠেছিলেন–এ তো ভয়ঙ্কর নির্মম অপরাধের যন্ত্রণা। আত্মহত্যা করেছিলেন লেডি ম্যাকবেথ। আত্মহত্যা করেছিলেন মহানায়ক অ্যাডলফ হিটলার, রক্তস্রোত বইয়ে দিয়েছিলেন যিনি পৃথিবীতে। কিন্তু থেকে গেছে একটি ভয়ঙ্কর শব্দ, ষড়যন্ত্র!
সেনেকা এই সময় বুঝেছিলেন ব্যর্থতা কাকে বলে। তার প্রিয় ছাত্র এবং সম্রাট নিরোকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার জন্য সেনেকাকে এক ভয়ঙ্কর প্রাণদণ্ড দিলেন। প্রকাশ্যে আত্মহত্যা করতে হবে সেনেকাকে। নিরো রাত্রিবেলা ছদ্মবেশে ঘুরতেন রোমে। নির্জনে পেলেই নিরপরাধকে হত্যা করতেন। নিরোর মতিগতি ভালোই জানতেন সেনেকা। কিন্তু তার কোনও উপায় ছিল না আত্মরক্ষার। প্রথমে হাতের শিরা কেটে ফেললেন সেনেকা, তাতেও মৃত্যু দ্রুত হলো না, তখন হেমলক খাওয়ানোর অনুরোধ জানালেন সেনেকা। কেননা সক্রেটিস ছিলেন তার এক অনন্য আদর্শ, কিন্তু সে মৃত্যুও যথেষ্ট তাড়াতাড়ি হচ্ছে না, তখন বিষবাষ্প গ্রহণ করে মারা গেলেন সেনেকা।
সেনেকা পরিবর্তন প্রসঙ্গে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন–‘সমাজের আলোড়নে উত্পন্ন হয় এক ধরনের অনিশ্চয়তা, তখন মানুষ আশা করে সেটা ভালোর জন্যই হবে, মনের মধ্যে আবার অন্য আশঙ্কা কাজ করে, এই পরিবর্তন ভয়ঙ্কর খারাপ হবে না তো?’
‘বন্দুকযুদ্ধের’ এক ভয়ার্ত পরিবেশে দাঁড়িয়ে আজ সেনেকার প্রশ্নটিই মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, আমাদের ‘উন্নয়ন’, ‘পরিবর্তন’শেষ পর্যন্ত আরও খারাপ কিছু বয়ে আনবে না তো?

লেখক: কলামিস্ট

/এমএনএইচ/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
দুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টিদুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ