X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

লটকনের রাজ্যে একজন স্বভাব কবির সান্নিধ্য

বিভুরঞ্জন সরকার
২৯ জুন ২০১৮, ১৫:৪৮আপডেট : ২৯ জুন ২০১৮, ১৫:৪৮

 

বিভুরঞ্জন সরকার কিছুদিন আগে সকালে রমনা পার্ক থেকে হেঁটে বাসায় ফেরার পথে লটকন দেখে কেনার ইচ্ছা হলো। লটকন অনেকের মতো আমারও একটি প্রিয় ফল। একটু টক টক বলে লটকন দেখলেই জিভে যেন জল এসে যায়। গোল গোল ছোট্ট ফলটি রসালো এবং নিরাপদ। ভাবলাম এবার যেহেতু একদিনও লটকন খাওয়া হয়নি তাই কিনে ফেলি আধা কেজি। দামটা একটু বেশি মনে হলো। ১৪০ টাকা কেজি হেঁকে শেষে ১২০ টাকায় রফা হলো। লটকন কিনলেন বন্ধুবর আশুতোষ সাহাও। লটকনের দাম মিটিয়ে হঠাৎই আশুদা বললেন, চলেন আমরা একদিন লটকনের রাজ্যে ঘুরে আসি।

লটকনের রাজ্যটা কোথায়?

নরসিংদী। নরসিংদীর বেলাব এলাকায় প্রচুর লটকন হয়।

বেলাব শুনেই মনে হলো সেখানেও আমাদের একজন পরিচিত বন্ধু আছেন। খাতির আপ্যায়নে যার জুড়ি নেই। ভাবেরচরের জাহানুল হক বাবুল। তারা বাবা ছিলেন একজন ত্যাগী কমিউনিস্ট নেতা। কৃষক আন্দোলনের একসময়ের অতি পরিচিত এক নাম শামসুল হক। এলাকায় খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও ব্যক্তিগত সখ্য ছিল। শামসুল হক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি মারা গেছেন। তারই ছেলে বাবুল। আমাদের অনেকেরই প্রিয়ভাজন। বাবুলের কাছে গেলে নিশ্চয়ই লটকনের বাগান দেখা সহজ হবে।

আশুদার গাড়ি আছে। কাজেই দেরি না করে পরের দিনই বেলাব যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। বাবুলের সঙ্গে যোগাযোগ করায় তিনি সানন্দে তাৎক্ষণিকভাবেই আমাদের তার এলাকায় আহ্বান জানালেন। ২৩ জুন সকালেই আমরা নরসিংদীর পথ ধরলাম এবং কোনও ধরনের ঝুটঝামেলা ছাড়াই নির্দিষ্ট গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছলাম। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ধরে ভৈরব ব্রিজের আগে বারৈচা বাসস্ট্যান্ডে বাবুল আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমরা পৌঁছানোর পর প্রথমেই পথের ধারের চায়ের দোকান থেকে গরুর খাঁটি দুধের গরম চা পান। ঢাকায় দুধ-চা এখন আর খাওয়া হয় না। অনেকদিন পর বারৈচা বাজারের দুধ-চা ভালোই লাগলো।

আমাদের কোথায় কোথায় নিয়ে যাবেন,কী কী দেখাবেন, কার কার সঙ্গে কথা বলাবেন তার একটি পরিকল্পনা বাবুল করে রেখেছেন। আমার মনে হলো তার তালিকা ধরে আমরা যদি অগ্রসর হই তাহলে কমপক্ষে দিন তিনেক সময় লাগবে। কিন্তু আমার হাতে সময় মাত্র কয়েক ঘণ্টা! ফলে অনেক কিছু কাটছাঁট করে আমাদের পরিদর্শনসূচি লটকন-দর্শন সীমাবদ্ধ করতে হলো।

কিছুক্ষণ ভেবে বাবুল বললেন,চলেন এমন এক জায়গায় নিয়ে যাই যেখানে লটকন ছাড়াও একজন কবির সঙ্গেও আপনার দেখা হবে। তার কবিতা শুনলেও আপনার ভালো লাগবে। রাজি হয়ে গেলাম। এরমধ্যেই কার কার লটকন বাগান বড় এবং বিখ্যাত তার নানা তথ্যও কানে আসতে লাগলো। লাকপুরের প্রাক্তন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সুলতানউদ্দিন মোল্লা তার লটকন বাগান বিক্রি করেছেন ১৬ লাখ টাকায়। তার মানে ওর চেয়ে বড় লটকন বাগান আর নেই। আমরা কাইল্লার মোড় থেকে ভেতরের দিকে যাত্রা শুরু করলাম চেয়ারম্যান বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিন্তু চেয়ারম্যান বাড়ি শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হলো না। কয়েকশ গজ যেতে না যেতেই আমরা যেন প্রবেশ করলাম লটকন রাজ্যে। গাছে গাছে থোকায় থোকায় লটকন ঝুলে আছে। আশুদা ভীষণ উত্তেজিত। এতো লটকন। খাবে কে? সেই যে পাঁজা পাঁজা স্তূপীকৃত তুলা দেখে একজনের মাথায় প্রশ্ন এসেছিল, এত তুলা ধুনবে কে? গাছে গাছে লটকনের বহর দেখে আমাদেরও মাথা গরম হওয়ার অবস্থা। সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের সামলে নেই। ১৭ কোটি খাওয়ার মুখ যে দেশে সে দেশে কোনও খাবার জিনিসই কি বেশি হতে পারে? আর লটকন তো সারা দেশে সমানভাবে হয় না। নরসিংদী জেলার কিছু অঞ্চলে ইদানীং প্রচুর পরিমাণে লটকন হচ্ছে এবং সারা দেশে ভোক্তা পর্যায়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। অন্য সব ফসলের ক্ষেত্রে উৎপাদক-কৃষক ন্যায্য মূল্য পান না বলে সব সময় অভিযোগ শোনা যায়। কিন্তু লটকন নিয়ে তেমন অভিযোগ শোনা যায় না। লটকন চাষি এবং ব্যবসায়ী সবাইকে খুশি মনে হলো।

গ্রামের সরু কাঁচা রাস্তা দিয়ে একসময় গাড়ি নিয়ে আগানো সম্ভব না হওয়ায় আমরা নেমে পড়লাম। ছায়াঢাকা পাখি ডাকা গ্রামের পথ দিয়ে কিছুটা হেঁটে ঢুকে পড়লাম লটকন বাগানে। পথের দু’ধারেও অশব্য লটকনের সমারোহ আমাদের নজর কেড়েছে। লটকনের কারণেই যেন ওখানকার গ্রামগুলো আমাদের অন্য রকম ভালো লাগলো। স্মার্ট ফোনে ছবি তোলার ধুম। প্রথম যেখানে নামলাম সে বাগানটা ছোট। কয়েকটা মাত্র গাছ। তারপরও বিক্রি হয়েছে ৬০ হাজার টাকায়। এই বাগানের মালিক মো. জয়নাল আবেদিন জানালেন, সামনে এগুতে থাকলে আমরা আরো বড় বড় বাগান দেখতে পাবো। আমরা এগুতে থাকি। শুধু কি লটকন? কাঁঠাল গাছে নানা সাইজের কাঁঠালও কম আকর্ষণীয় নয়। লটকন গাছের মাঝে মাঝে কাঁঠাল গাছ। দু-চারটা কালোজাম গাছও চোখে পড়লো। পাকা জাম গাছের নিচে ছড়িয়ে আছে। খাওয়ার কেউ নেই। অথচ এই ফলটি ঢাকায় ঢুকলেই কত দামি হয়ে যায়!

দ্বিতীয় যে বাগানে ঢুকলাম সেটি বিক্রি হয়েছে ৮ লাখ টাকায়। দুই শতাধিক গাছ এই বাগানে। মো. বাদল মিয়া নামক একজন পাইকারি ব্যবসায়ী বাগানটি কিনেছেন। তার সঙ্গে দেখা হয় এবং কথা হয়। তার কাছে জানতে চাই,এই যে আট লাখ টাকায় বাগানটি কিনলেন, কত মুনাফা থাকবে বলে আশা করেন?

তিনি অকপটে জানালেন,তিনি আশা করছেন এই বাগান থেকে কমপক্ষে ১২ লাখ টাকার লটকন বিক্রি করতে পারবেন।

কীভাবে বাগানের আগাম দাম ঠিক করেন জানতে চাইলে বাবুল মিয়া বলেন, গাছে ফলন দেখে আন্দাজ করি কি পরিমাণ হতে পারে। তারপর কি দামে বিক্রি হতে পারে তার একটা সম্ভাব্য দর ধরে গড় হিসাব বের করে নিই। অনেক বছর ধরে এই ব্যবসায় আছি বলে আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে। এখন খুব বেশি এদিক ওদিক হয় না। আমি অনুমান করে বাগান কিনে আজ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হইনি।

কতদিন লাগবে টাকা তুলে আনতে?

সব মিলিয়ে ৬০/৬৫ দিন। তার মানে লটকনের ব্যবসা দুই আড়াই মাসের। বাকি সময় অন্য কোনও কাঁচামালের পাইকারি কেনাবেচা করেন বাবুল মিয়া। ব্যবসা নিয়ে তার কোনও আক্ষেপ-অভিযোগ নেই। মোটামুটি ভালো আছেন। সুখে আছেন। লটকন গ্রামে মানুষের হাহাকার নেই, বরং এক ধরনের স্বস্তি সবার মধ্যে দেখতে পেলাম। বিষয়টি খুব ভালো লাগলো। দেশের মানুষ সুখে নেই, ভালো নেই বলে যে প্রচারণা কোনও কোনও মহল থেকে চালানো হয়, তারা একবার লটকন রাজ্যে ঘুরে আসতে পারেন। একটি ভিন্ন রকম ফলের উৎপাদনও যে এলাকার মানুষের জন্য কতটা আশীর্বাদ হতে পারে নরসিংদীর লটকন চাষ তার বড় দৃষ্টান্ত।

আট লাখি লটকন বাগানের মালিক কবি আবুল হাশেম। কবি আবুল হাশেম নামেই পুরো এলাকার মানুষ তাকে চেনেন। তিনি খুব বেশি লেখাপড়া জানেন না। অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন। নিজে বললেন ক্লাস টু পাস। কিন্তু অসাধারণ সব কবিতা রচনা করেন তিনি। না, তিনি নিজে খাতা-কলমে লিখতে পারেন না। মুখে মুখেই রচনা করেন এবং রচনার সঙ্গে সঙ্গে সেটা তার মুখস্থ হয়ে যায়। তারপর জমা রাখেন স্মৃতির সিন্দুকে। কী অসাধারণ প্রতিভাধর একজন মানুষ। তার সঙ্গে দেখা করার কথাই বাবুল শুরুতে বলেছিলেন।

আমরা তার বাড়িতে গিয়ে শুনলাম তিনি ঘরে নেই। আশপাশে কোথাও গিয়েছেন। খবর দেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে তিনি এলেন। ছোটখাটো গড়নের লুঙ্গি পাঞ্জাবি পরা একমুখ দাঁড়ি নিয়ে কবি আবুল হাশেম আমার সামনে এসে যখন দাঁড়ালেন, সম্ভ্রমে আমার মাথা একটু নুইয়ে এলো। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছি দেখে তিনি একটু রাগ করলেন। মেহমান বাইরে দাঁড়িয়ে এটা গৃহস্থ কি সহজে মানতে পারেন। তিনি একপ্রকার ঠেলে আমাদের ঘরের মধ্যে ঢোকালেন।

আমি টুকটাক লেখালেখি করি শুনে তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কিন্তু আমি কমিউনিস্ট পার্টির সাপ্তাহিক মুখপত্র একতা’য় কাজ করেছি শুনে তিনি একটু অভিমানের সুরেই যেন বললেন, আপনার সঙ্গে কথা নেই।

আমি একটু থতমত খেলাম। ভাবলাম, আমি একতা ছেড়েছি বলেই বুঝি তার অভিমান। না, একটু পরেই তার অভিমানের কারণটি তিনি নিজেই বললেন। তিনি এখনও পার্টির একজন দরদি। কিন্তু আজ পর্যন্ত একতায় তার একটি কবিতাও ছাপা হয়নি। কবি আবুল হাশেম বলেন, আমরা সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদের কথা বলি। কিন্তু আমরা সমতার নীতি মেনে চলতে পারি না। একতার মতো কমিউনিস্ট পরিচালিত পত্রিকায় গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত কবির কবিতা ছাপা হয় না! শহুরে পরিশীলিত কবির দিকেই একতার টান। ওই কবিতা আমি বুঝি না। কিন্তু আমি যে কবিতা লিখি তা সবাই বোঝেন। তার কবিতায় আছে মানুষের গায়ের গন্ধ। কবি আবুল হাশেমের বেদনাবোধের কারণটা জানা হলো।

নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি বললেন, আমার জন্ম বাংলা ১৩৪২ সনে। সে হিসেবে এখন বয়স ৮২ বছর। দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া হয়নি। রাস্তার ছেঁড়া কাগজ কুড়িয়ে তা বেচেও জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছে। কৃষি কাজ এবং বাগান করে তিনি মোটামুটি ভালো আছেন। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গৌরবের অংশীদার। ভ্যান থেকে পড়ে গিয়ে বুকের পাঁজরে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছেন। তাছাড়া আর কোনও অসুখ-বিসুখ নেই। চা না খাইয়ে ছাড়লেন না কবি আবুল হাশেম। আমাদের অনুরোধে কবি আবুল হাশেম চারটি কবিতা শোনালেন। মুখস্থ। নিজের কবিতা লেখা না থাকলেও তিনি হুবহু মনে রেখেছেন তার সব কবিতা। আবুল হাশেমের সঙ্গে কথা বলা বেশিক্ষণ চালিয়ে যেতে পারলাম না ঢাকা ফেরার তাড়না থেকে।

লটকন বাগান দেখে যতটা আনন্দ পেয়েছি তারচেয়ে ঢের বেশি আনন্দ পেলাম কবি আবুল হোসেনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, তার নিজের কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি শুনে। অল্প সময়ের পরিচয়েই তার সাদা মনের যে পরিচয় পেলাম তা ভুলবো না কোনও দিন। এমন বিনয়ী এবং নিরহংকারী মানুষ আছেন বলেই পৃথিবীটা এখনও এতটা সুন্দর!

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ