X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

গণতন্ত্র ও বাংলাদেশের ‘দরদি বন্ধু’ যুক্তরাষ্ট্র

মো. জাকির হোসেন
০৩ জুলাই ২০১৮, ১৫:৩০আপডেট : ০৩ জুলাই ২০১৮, ১৭:৫৩

মো. জাকির হোসেন বাংলাদেশকে নিয়ে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জারকথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ির বাংলাদেশ’ আজ রূপ-মাধুর্য-ঐশ্বর্যে এতটাই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে যে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের নিত্য-নতুন প্রস্তাব আসছে। বাংলাদেশের রূপ-মাধুর্যের গোপন রহস্য কোনও প্রসাধনী কিংবা বঙ্গজননীর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়। বরং আকর্ষণের মূল রহস্য হলো ঈর্ষণীয় আর্থসামাজিক অগ্রগতি, অপার প্রাকৃতিক, খনিজ ও সমুদ্রসম্পদের সম্ভাবনার হাতছানি, কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, বিরাট অভ্যন্তরীণ শ্রম ও বিপণন বাজার আর বিশাল কর্মক্ষম মানবসম্পদ। সিএনএন মানির পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০১৯ সালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিক দিয়ে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসবে বাংলাদেশ। গোল্ডম্যান স্যাকসের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি আশু সম্ভাবনার সর্বোচ্চ ১১টির মধ্যে রয়েছে। জেপি মর্গান এক-কদম এগিয়ে দেশটিকে অগ্রসরমান দেশগুলোর মধ্যে ফ্রন্টিয়ার ফাইভে উন্নীত করেছেন। সিটি গ্রুপের উৎসাহব্যঞ্জক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন থ্রিজি অর্থাৎ থ্রি গ্লোবাল গ্রোথ জেনারেটর গ্রুপে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ভাষ্য, বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান, যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান পত্রিকা, ব্রিকস খ্যাত অর্থনীতিবিদ (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন ও সাউথ আফ্রিকার অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিষয়ে আগাম ধারণাদাতা) জিম ও’ নেইলসহ দেশি-বিদেশি অনেক সংস্থা ও অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশের অপার অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বিষয়ে মত দিয়েছেন। তাদের মতে, ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৫০ সালের মধ্যে পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমকক্ষ হয়ে ওঠার অমিত সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের।
উল্লেখ্য, ২০২১-এর ৪ বছর আগেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের দৌড়ে সবাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলার কোনও অসুখ-বিসুখ হলে, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে, কোথাও খুন হলে, নির্বাচনে অনিয়ম হলে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের ঘুম হারাম। দুশ্চিন্তা-উদ্বেগে মুখে খাবার রুচে না। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলার অসুস্থতা, নির্বাচনে অনিয়মের খবর বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কালবিলম্ব না করে  মার্কিন রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। কখনও কখনও সমবেদনা জানাতে, ‘নসিহত’ করতে, ‘গণতন্ত্র ফেরি’ করতে, ক্ষুব্ধ-মর্মাহত এ কথা জানাতে, সহায়তার প্রস্তাব দিতে রাষ্ট্রদূতের পাশাপাশি মার্কিন মন্ত্রী, সহকারী মন্ত্রীরা ১৩ হাজার ২৪৭ কিলোমিটার আকাশপথ পেরিয়ে পদধূলিতে বাংলার জমিনকে ধন্য করতে বাংলাদেশে ছুটে আসেন। যানবাহনের ওপর কারও কুদৃষ্টির কারণে যেন তা দুর্ঘটনায় না পড়ে, সেজন্য যানবাহনের মালিককে বাহনের জুতসই জায়গায় অনেক সময় ছেঁড়া জুতা-স্যান্ডেল ঝুলিয়ে রাখতে দেখা যায়। এমনকি ফসলের ক্ষেতে কু-দৃষ্টি প্রতিরোধ করতে ক্ষেতের মালিককে কাকতাড়ুয়ার সঙ্গে বদনজর প্রতিরোধী নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়। দরদি বন্ধু হতে অতি আগ্রহী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশের ব্যাপারে এতটাই সংবেদনশীল যে, সন্তানকে মা-বাবা থেকে আলাদা করে কারাগারসম শেল্টারে বন্দি রাখার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মানবাধিকারবিরোধী অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে সারা বিশ্ব যখন উদ্বিগ্ন-একাট্টা, মার্কিন ফার্স্টলেডি মেলানিয়া যখন ট্রাম্পের অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে তার উদ্বেগকে মেলে ধরতে স্বামীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, তখন বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের উদ্বেগ বাংলাদেশের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা আর মমত্বেরই বহিঃপ্রকাশ।

বাংলাদেশের ওপর যেন কারও কুনজর না পড়ে, সেজন্য মার্শা বার্নিকাট  বাংলাদেশ সরকারকে বিরামহীন ‘কু-নজর’ প্রতিরোধক নানা গণতান্ত্রিক প্রেসক্রিপশনও দিয়ে যাচ্ছেন।

এক্সিলেন্সির কাছে ‘খুব জানতে ইচ্ছে করে’ আমেরিকার নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ের পেছনে রাশিয়ার কারসাজিকে নির্বাচনি অনিয়ম মনে করেন কি? যুক্তরাষ্ট্র যে এখন আর  ‘পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের’ তালিকাভুক্ত নয়, সে খবর রাখেন কি? যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ২০০৬ সাল থেকে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে গণতন্ত্রের র‌্যাংকিং প্রকাশ করে আসছে। ক্যাটাগরি চারটি হলো পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, হাইব্রিড শাসন ও কর্তৃত্বপূর্ণ শাসন। ২০১৬ সালে ১৬৭টি দেশকে নিয়ে প্রকাশিত র‌্যাংকিংয়ে বিশ্বের মাত্র ১৯টি দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র চালু ছিল। ৫৭টি দেশে গণতন্ত্রের অবনমন ঘটেছে। এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবনমন হয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের র‌্যাংকিংয়ে প্রায় আড়াইশ’ বছরের পুরনো আমেরিকান গণতন্ত্রের পদাবনতি হয়েছে। দেশটি ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’ থেকে ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ শ্রেণিতে নেমে গেছে। ২০১৭-এর সূচকে ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের’ দেশগুলোর তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ারও নিচে নেমে গেছে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ট্রাম্পের তুরুপে আড়াইশ’ বছরের পুরনো আমেরিকান গণতন্ত্র পূর্ণ গণতন্ত্র থেকে এক লহমায় ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রে অবনমন ঘটলো। কত ঠুনকো আমেরিকান গণতন্ত্র!

স্থানীর সরকার নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের বক্তব্য এখতিয়ার ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। কূটনীতিকদের কার্যপরিধি, দায়দায়িত্ব, সুযোগ-সুবিধা ও দায়মুক্তি সংক্রান্ত মূল আন্তর্জাতিক আইন হলো ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন (চুক্তি)। এছাড়া আনুষঙ্গিক কিছু আইনও রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কূটনীতিকদের কাজ হলো– এক. গ্রহীতা রাষ্ট্রে প্রেরক রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করা; দুই. আইন মোতাবেক গ্রহীতা রাষ্ট্রে প্রেরক রাষ্ট্র ও তার নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষা করা; তিন. গ্রহীতা রাষ্ট্রের সরকারের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করা; চার. গ্রহীতা রাষ্ট্রে বিদ্যমান যেকোনও অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা এবং তা নিজ রাষ্ট্রের সরকারকে অবহিত করা; এবং পাঁচ. প্রেরক রাষ্ট্র ও গ্রহীতা রাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বৃদ্ধি করা ও তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, কারিগরি ও বৈজ্ঞানিক সম্পর্কের প্রসার ঘটানো। আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রদূতদের কোনোভাবেই কোনও রাষ্ট্রের নির্বাচন-রাজনীতি নিয়ে বক্তব্য রাখার কিংবা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময়ের সুযোগ নেই। তদুপরি খুলনা ও গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বার্নিকাটের বক্তব্য একপেশে।

এ বিষয়ে তিনি সরকার, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থার অভিমত না নিয়ে কেবল বাছাই করা কিছু 'নষ্ট' সুশীলের অভিমত আর দুই-একটি পত্রপত্রিকার উদ্দেশ্যমূলক খবরের ওপর ভিত্তি করে নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করেছেন। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় তথা সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ এবং ভোটারদের অবমাননা। ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন কূটনীতিকদের আচরণ ও নিষিদ্ধ কার্যাবলির তালিকার ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ আইন নয়। কালের পরিক্রমায় কূটনৈতিক রীতি-প্রথা ও নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কূটনীতিকদের জন্য প্রযোজ্য আচরণবিধি গড়ে উঠেছে। এসব আচরণবিধি বিধিবদ্ধ করা না হলেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে এ নিয়ে বই প্রকাশিত হয়েছে। ১৯১৭ সালে Sir Ernest Satow-এর লেখা বই A Guide to Diplomatic Practice এবং ২০১৬ সালে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক Paul Behrens-এর বই Diplomatic Interference and the Law প্রণিধানযোগ্য। এ বই দুটিতে গ্রহীতা রাষ্ট্রে বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে যোগাযোগ, গ্রহীতা রাষ্ট্রের সরকারের সমালোচনা, সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ ও প্রকাশ্যে বিবৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে কূটনীতিকদের সীমাবদ্ধতার বিষয় বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। Paul Behrens তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পোলিশ রাষ্ট্রদূত জার্মানির সমালোচনা করে বক্তব্য দিলে যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশমন্ত্রী লিখিত পত্র দিয়ে পোলিশ রাষ্ট্রদূতকে হুঁশিয়ার করেন যে মার্কিন বন্ধুরাষ্ট্রকে সমালোচনা করে বক্তব্য প্রদান কূটনীতিকের কাজের আওতাভুক্ত নয়। ১৯৮৪ সালে ফ্রান্সে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত Evan Galbraith কমিউনিস্টপন্থীদের ফরাসি সরকারে যোগ দেওয়ার সমালোচনা করে বলেন, সবাই জানে কমিউনিস্টরা সোভিয়েত পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে। Evan Galbraith-এর বক্তব্যের পর ফরাসি প্রধানমন্ত্রী Pierre Mauroy তাকে ডেকে পাঠান এবং তার বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য বলে হুঁশিয়ার করে দেন। ২০০০ সালে ইন্দোনেশিয়ায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত Robert Gelbard ইন্দোনেশিয়ার সরকারকে দেশটির সেনাবাহিনী প্রধান হিসাবে Agus Wirahadikusumah-কে নিয়োগদানের চাপ সৃষ্টি করলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী Mahfful তাকে বহিষ্কারের হুমকি দিয়ে প্রতিহত করেন। ২০০৭ সালে জিম্বাবুয়ের বিদেশমন্ত্রী Mumbengegwi একদল পশ্চিমা কূটনীতিককে ডেকে হুঁশিয়ার করে দেন, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী জিম্বাবুয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ। ফিজিতে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শ্রীনিবাসন ফিজিতে অবস্থিত ভারতীয় মন্দিরে আগুনে বোমা নিক্ষেপের প্রতিবাদে ও সমস্যার সমাধানকল্পে ফিজির সংবিধানে আদিবাসীদের জন্য বিশেষ অগ্রাধিকারমূলক বিধান সংযোজনের বিষয়ে প্রকাশ্য বিবৃতি দেওয়ার পর তাকে ফিজি থেকে বহিষ্কার করা হয়। নেপালে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত রাকেশ সুদ নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্র’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করায় নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে কূটনীতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন বলে সমালোচনা করেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক কূটনীতিক পিনাক রঞ্জন টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে প্রতিবাদকারীদের ‘তথাকথিত পানি বিশেষজ্ঞ’ এবং প্রতিবাদকে ‘ভারত ফোবিয়া’ আখ্যায়িত করলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি এর পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, ‘হাইকমিশনারের বক্তব্য কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বিচ্যুতি’।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের অযাচিত ও হস্তক্ষেপমূলক মন্তব্যে যারা খুশিতে তালিয়া বাজাচ্ছেন তারা জেনে রাখুন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্বাচিত ব্যক্তিদের অপসারণ, হত্যা কিংবা অনির্বাচিত শাসকদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সাহায্য-সহযোগিতা জুগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধ মানে শান্তি এ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে কোনও আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই বিশ্বের নানা প্রান্তে ঠাণ্ডামাথায় খুন ও ড্রোন হামলা, আবুগারিব ও গুয়ান্তানামো কারাগারে বন্দিদের ওপর মানব মর্যাদাহানিকর নৃশংস নির্যাতন, জঙ্গি দমনের অজুহাতে আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্য ও অফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সার্বভৌমত্বে নগ্ন হস্তক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাক্ষ্য দেয় না। জঙ্গিবাদের অন্যতম জন্মদাতা ও আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র– এটি দিবালোকের মতোই পরিষ্কার। আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে প্রক্সি যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধকে ‘জিহাদ’ আখ্যা দিয়ে আল-কায়েদা ও তার প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে অস্ত্র-অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য-সহযোগিতার কথা কে না জানে? আইএস সৃষ্টিতে ও লালনে যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে খোদ মার্কিন সাংবাদিক, গবেষক, লেখকরা তথ্য-প্রমাণাদিসহ অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন। সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে, এ মিথ্যা অজুহাতে ইরাক আক্রমণ করে ইরাকে তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় হত্যা-ধর্ষণসহ যে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, গুচ্ছবোমা ব্যবহার করে ইরাকের প্রতি দশজন মানুষের মধ্যে একজনকে ক্যান্সারের হুমকিতে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, তার দায়ভার আমেরিকার নয় কি?

ইরাক, আফগানিস্তানসহ বিশ্বের অনেক দেশে আত্মঘাতী হামলায় যে হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করছে তা আমেরিকার অবিমৃশ্যকারিতার জন্যই নয় কি? মোটামুটি স্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যে ‘আরব বসন্তের’ নাম করে রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করে যেভাবে লণ্ডভণ্ড করা হলো, আর এ লণ্ডভণ্ড মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক শূন্যতার হাত ধরে যে আইএসের উত্থান ঘটানো হলো, তার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দায়ী নয় কি? আমেরিকার নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্য তছনছ হওয়ার আগে যে মানুষগুলোর অন্ন,বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার ন্যূনতম নিশ্চয়তা ছিল, সে মানুষগুলো সব হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অজানা আশঙ্কায় মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় সমুদ্র পেরিয়ে কুকুর-বিড়ালের মতো তাড়িত হয়ে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর এক সীমান্ত থেকে আরেক সীমান্তে ভিক্ষুকের মতো যে হাত পাতলো তার জন্য আমেরিকার অনুশোচনা হয় কি? ‘আয়লান ট্র্যাজেডি’র জন্য আমেরিকা মর্মাহত কি? আল-কায়েদা ও তালেবান দমনের নাম করে আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়ে পুরোদস্তুর অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করা ছাড়া আমেরিকা কী আর কোনও গণতান্ত্রিক সফলতা অর্জন করতে পেরেছে?

আওয়ামী লীগকে পরাস্ত করতে যারা বিদেশিদের বাংলার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিচ্ছেন, তারা যাদের রক্ত ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়েছে তাদের কী জবাব দেবেন?

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমএনএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ