X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘ভাতিজা’দের দেশে

আহসান কবির
০৩ জুলাই ২০১৮, ১৬:৩৫আপডেট : ০৩ জুলাই ২০১৮, ১৬:৪২

আহসান কবির ‘ভাতিজা’রা যে দেশে সদর্পে গাড়ি চালায়,গাড়ির তলায় চাপা পড়লেও যখন আমজনতা কোনও বিচার পায় না,সেই ‘ভাতিজা’দের দেশে সবাইকে স্বাগতম! বেঁচে থাকতে হলে আবহাওয়ার খবরের মতো আপনাকে খবর রাখতে হবে ‘ভাতিজা’রা কবে কখন গাড়ি নিয়ে বের হচ্ছেন! ‘ভাতিজা’রা বের হবেন,তাদের মতো করে গাড়ি চালাবেন,নিরাপদে থাকার দায়িত্ব শুধু আমাদের,আমজনতার! খেয়াল,খুব খেয়াল!
প্রথম ‘ভাতিজা’র কথায় আসি। তার নাম মুহিত (ইনি অর্থমন্ত্রী নন। দয়া করে মিলিয়ে ফেলবেন না)।
ছড়াকার বাপী শাহরিয়ারের কথা হয়তো অনেকের মনে আছে। না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার পর বাপী শাহরিয়ার কেমন আছে জানি না। ঢেঁকি যদি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, তাহলে বাপী শাহরিয়ার নিশ্চয়ই ছড়া লিখছে সেখানে বসে! কিন্তু বাপীর তো না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার কথা ছিল না,এখনও তাঁর বেঁচে থাকার কথা। ছড়ার বই সাজানো থাকার কথা ছিল তাঁর ড্রয়িং রুমে। দুরন্ত কৈশোরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ঢাকা শহরের রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে বেড়াত বাপী। তারপর একদিন!

সাইকেল চালাচ্ছিল বাপী আর রাস্তাটা নিজের মনে করে দ্রুতবেগে গাড়ি চালাচ্ছিল এরশাদ আমলের প্রভাবশালী মন্ত্রী মতিনের ছেলে মুহিত। মুহিতের গাড়ির ধাক্কায় ছিটকে পড়েছিল বাপী,ভেঙে গিয়েছিল তার পিঠের হাড়!

এরপর বাপীর অবর্ণনীয় কষ্ট। একরকম প্যারালাইসিস জীবনযাপন। বিচার এবং চিকিৎসা না পেয়ে বাপী পরিবারের মুখাপেক্ষী আর বোঝা হতে চাইলো না। নিঃস্ব অভিমানে আত্মহত্যা করে বসলো ছেলেটা। ছড়ার মতো ছন্দময় ছেলেটা চলে গেলো না ফেরার দেশে।

মুহিত হয়তো ভালোই আছে এখন,হয়তো ভুলেও মনে পড়ে না বাপী শাহরিয়ারকে! বাপীকে তাও মনে রেখেছি আমরা কয়েকজন কিন্তু রাস্তার সেই নাম না জানা শিশু কিংবা আহত মানুষদের কেউ মনে রাখেনি। তাই আরেক ‘ভাতিজা’র কাছে যাই। তার নাম ফারিজ রহমান। বাবার নাম এইচবিএম জাহিদুর রহমান,ব্যবসায়ী (বাবার স্টারওয়ালা হোটেল আছে,বিখ্যাত খাবার রেস্টুরেন্ট ব্যাটন রুজের মালিক)। মা প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালক। আর ফারিজের চাচা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ ও ব্যবসায়ী এইচ বি এম ইকবাল। দেশ এগিয়ে যাওয়ার কারণে ভাতিজাদের কাল চলছে বছর কয়েক ধরে। তারা শুধু মদ খাচ্ছে তাই না,মদ খেয়ে গাড়ির রেসও দিচ্ছে! দুরন্ত সেই গতিশীল গাড়ির আঘাতে দুই একটা রাস্তার (?)শিশু ছিটকে পড়ে গেলেও সেদিকে কেউ তাকায়নি,খবরও রাখেনি। দেশ এতো ভালো হয়েছে যে ছোট বয়সেই ছেলেরা যেমন দুরন্ত গতিতে গাড়ি চালাতে পারছে ঠিক তেমনি দুর্ঘটনা ঘটানোর পর পুলিশ ফারিজকে মোটরসাইকেলে করে নিরাপদে বাসায় পৌঁছে দিচ্ছে। মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে রিকশাযাত্রী আর গাড়ির যাত্রীর স্ট্যাটাস এক না। তেল আর জল কখনও মেশে না। ঠিক যেন সেই ছবির ডায়ালগ- রাজা রাজাইশ,প্রজা প্রজাইশ অথবা এনিমেল ফার্ম উপন্যাসের সেই অনবদ্য কথা-এভরিবডি ইজ ইক্যুয়াল বাট সামবডি ইজ মোর ইকুয়াল! এই সামবডি কারা? যারা দেশ চালায় তারা!

দেশ এগিয়ে যাওয়ার কারণে অল্প বয়সেই যেমন গাড়ি চালাতে পেরেছিলেন ফারিজ,গাড়ির সামনের সিটে  প্রিমিয়াম মল্টেড হুইস্কি শিভাস রিগ্যালের বোতল রেখে ছবি তুলে সেটা আপলোডও করতে পেরেছিলেন ফেসবুকে। ঘটনা ঘটানোর পরে অর্থাৎ রাস্তায় দুই একজন আমজনতাকে  আহত বা নিহত (বিষয়টি মীমাংসিত নয়) করার পর বাবাকে নিয়ে পুলিশ স্টেশনে গেলেও ফারিজ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে পারেন নির্দ্বিধায়-‘গোয়িং পুলিশ স্টেশন উইথ ড্যাড!’ তারপর ফারাজ মুক্ত হন। ঘটনা ঘটানোর বছর দুই পরে হয়তো এখন ভালোই আছেন ফারাজ,যারা আহত হয়েছিলেন তারা হয়তো ফারাজদের অর্থসাহায্যে চিকিৎসা নিয়ে ভুলে গেছেন সেই ঘটনা। আসলে সবকিছু মনে রাখতে নেই!

এসব ঘটনায় কেউ মরে গেলেও হয়তো কোনও ক্ষতি বৃদ্ধি হতো না। পাকিস্তান এবং আফ্রিকার কিছু দেশে ব্লাডমানি বলে একটা জিনিস আছে। কাউকে মেরে ফেলার পর তার জন্য কিছু টাকা দিয়ে দিলেই সব ল্যাঠা চুকে যাবে। কোনও বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না! হলেও টাকা দিলে থানা পুলিশ,পত্রিকা,টিভি আর আদালত সবে বশে থাকবে। সুতরাং ‘নো চিন্তা ডু ফুর্তি’! এদেশটা মুহিত,ফারিজ কিংবা শাবাবদের!

ইদানীংকালের আরেক ‘ভাতিজা’র নাম শাবাব। ঈদের ছুটিতে যখন ঢাকা শহর একেবারেই ফাঁকা তখন সম্ভবত তার মন চেয়েছিল গাড়িকে বিমান বানানোর। তাই গাড়িটাকে  বিমানের বেগেই চালাচ্ছিলেন তিনি। মহাখালীর ফ্লাইওভারে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানোর সময়ে শাবাব চাপা দেন এক গাড়িচালককে, যার নাম সেলিম ব্যাপারি এবং সেলিম ব্যাপারি নিহত হন। শাবাব নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করীম চৌধুরীর ছেলে। শাবাব যে গাড়িটি চালাচ্ছিলেন সেটি তার মা কামরুন্নাহার শিউলির, যিনি নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার চেয়ারম্যান। শাবাব সেলিম ব্যাপারিকে গাড়িচাপা দিয়ে দ্রুতবেগে চলে আসেন সংসদ ভবনের উল্টো দিকে ন্যাম ভবনে, যেখানে তার পিতা একরাম চৌধুরীর বাসা রয়েছে। একজন মোটরসাইকেল আরোহী এবং একটি প্রাইভেটকারের আরোহী শাবাবকে অনুসরণ করেন এবং ভিডিও করতে করতে তারাও ন্যাম ভবনে যান। পরে শাবাব গাড়ি থেকে নেমে যারা অনুসরণ করেছিল,লোকজন নিয়ে তাদের মারধর করেন বলে অভিযোগ আছে। যারা অনুসরণ করেছিলেন তাদের মোবাইল থেকে ভিডিও ফুটেজ মুছে দেওয়া হয়। যদিও একরাম চৌধুরী থাকেন ধানমন্ডিতে এবং তিনি বলার চেষ্টা করেছেন যে গাড়িটি তার চার পাঁচ ড্রাইভারের মধ্যে কোনও একজন চালাচ্ছিল,শাবাব নয়!

এরপরের ঘটনা অভিনব। নিহত সেলিম ব্যাপারির স্ত্রী জায়না বেগমের অ্যাকাউন্টে বিশ লাখ টাকা জমা দেওয়া হয়েছে শাবাবের পরিবারের পক্ষ থেকে এবং সেলিম ব্যাপারির পরিবার মামলা তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন! জানি না এটাকে বাংলাদেশের প্রথম ব্লাডমানি সলিউশন বলা যাবে কিনা! জানি না বলা হবে কিনা সেলিম ব্যাপারি অনেক ভাগ্যবান। কারণ, তার মৃত্যুর দাম বিশ লাখ! বেশিরভাগ এমন মৃত্যুর কোনও দাম নেই। বড়জোর তাদের কপালে জুটতো ফ্রি দাফন কাফন বা সৎকার, আই মিন আনজুমানে মফিদুল ইসলাম!

ভালোই! ‘ভাতিজা’দের কল্যাণে এদেশে মৃত্যুর দাম বিশ লাখ পর্যন্ত উঠেছে। আসলেই মধ্যম আয়ের দেশ এখন বাংলাদেশ!

বিশেষ দ্রষ্টব্য: ‘ভাতিজা’দের জন্য সাত খুন মাফ। সড়ক দুর্ঘটনা তো সামান্য ঘটনা। ‘ভাতিজা’রা ফাঁসির দণ্ড পেলেও তাদের ক্ষমা করে দিলে দণ্ড রদ হয়ে যাবে এবং জেলখানায় ‘ভাতিজা’রা বিয়েও করতে পারবেন। লক্ষ্মীপুরের তাহেরপুত্র বিপ্লবের ক্ষেত্রে তেমনই হয়েছে এবং তিনি জেলখানাতে ভালোই আছেন। ভালো আছেন এমপি পুত্র রনি, যিনি ডাবল মার্ডারের মামলায় জেলে আছেন,তবে তার হাসপাতালের আয়েশী জীবন নিয়ে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে।

একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরি করার পর ক্রিকেটার মেহরাব হোসেন অপির বাসার দেয়ালে মহল্লাবাসী সুন্দর করে লিখে দিয়েছিল ‘শাবাশ ভাতিজা অপি’! এদেশে অপির বাইরেও যে ক্ষমতাবান ‘ভাতিজ’রা আছেন এ দেশটা তাদেরই। আর তাই ‘ভাতিজা’দের দেশে সবাইকে স্বাগতম!

লেখক: রম্যলেখক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ