X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০৫ জুলাই ২০১৮, ১৩:৫২আপডেট : ০৫ জুলাই ২০১৮, ১৭:২৮

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী বড় দেশগুলো এখন ধীরে ধীরে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে বিশ্বের অবস্থা মনে হচ্ছে দিনে দিনে খারাপ হবে। কারণ, ট্রাম্প এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন, তাতে মনে হচ্ছে বিশ্বব্যবস্থা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে সারাবিশ্ব এক নৈরাজ্যের মাঝে নিমজ্জিত হবে।
আবার আমেরিকার কিছু একতরফা সিদ্ধান্তের কারণে বিশ্বের অপূরণীয় ক্ষতিও হচ্ছে। জলবায়ু নিয়ে প্যারিস সম্মেলনে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ট্রাম্প তা থেকে বের হয়ে গেছেন। জাতিসংঘের ইউনিসেফ  ও মানবাধিকার সংস্থা থেকেও বের হয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। পারমাণবিক অস্ত্র সম্প্রসারণ রোধ করার জন্য জাতিসংঘের পাঁচ স্থায়ী সদস্য প্লাস জার্মানির সঙ্গে ইরানের যে চুক্তি হয়েছিল, সে চুক্তি থেকেও আমেরিকা তার নাম প্রত্যাহার করেছে। কানাডায় অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলনের ঘোষণায় ট্রাম্প দস্তখত করেননি। ট্রাম্পের সব কাজ বিশ্বব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলছে।
বাণিজ্য নিয়ে আমেরিকা, চীন, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারতের মাঝে শুল্ক আরোপ করা আর পাল্টা আরোপের মাঝে শান্তিপূর্ণভাবে চলমান বাণিজ্যে প্রবল বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। যা বিশ্ববাণিজ্যকে মন্দার সম্মুখীন করতে পারে। ট্রাম্পের কর্মকাণ্ড স্ববিরোধিতায় ভরপুর। কোরিয়া উপদ্বীপকে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত করার জন্য উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিন জং উনের সঙ্গে গত ১২ জুন (২০১৮ সাল) সিঙ্গাপুরে বৈঠক করেছেন ট্রাম্প। সেই মর্মে উভয় পক্ষ দেড় পৃষ্ঠার একটি যৌথ ইশতেহারও স্বাক্ষর করেছে। অথচ ইরানের সঙ্গে পরমাণু অস্ত্র প্রতিরোধের জন্য সম্পাদিত চুক্তি থেকে তিনি বের হয়ে গেছেন ট্রাম্প।

ভারত ও চীনকে ইরান থেকে তেল না কেনার জন্য হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন ট্রাম্প। একইসঙ্গে ইরানের ওপর নতুন করে বাণিজ্য অবরোধ স্থাপন করেছেন, যেন ইরান তেল বিক্রি করতে না পারে আর বিশ্ববাজারে ইরানের অনুপস্থিতিতে তেলের স্বল্পতা দেখা দিতে পারে। তেলের মূল্য বেড়ে যেতে পারে, সে কারণে সৌদি বাদশাকে তেল উত্তোলনের পরিমাণ বাড়াবার জন্য অনুরোধ করছেন তিনি।

মার্কির প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জাতিসংঘের বাধা উপেক্ষা করে তেল আবিব থেকে আমেরিকার দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর করেছিলেন। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিরা প্রতিবাদ জানানোর জন্য গাজায় মিছিল করলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গুলিতে ৬২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা এর নিন্দা জানালে ট্রাম্প এই সংস্থা থেকে আমেরিকার সদস্যপদ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন। তার মতে, তারা অকারণে ফিলিস্তিনিদের সমর্থন দিয়েছে এবং ইসরায়েলের নিন্দা করেছে। ট্রাম্পের এসব কর্মকাণ্ড বিশ্বব্যবস্থাকে বিপন্ন করে তুলছে।

কয়েকদিন আগে ট্রাম্প ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে আমেরিকার বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধা দেওয়ার লোভনীয় প্রস্তাব দিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিনিময়ে। কারণ, মাঝে মাঝে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি রাষ্ট্রের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত আমেরিকার আরবিট্রেটরি সিদ্ধান্তকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। সুতরাং ইউরোপের ঐক্যকে বিনষ্ট করাই এখন তার উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ট্রাম্পের শাসনকালে তার কর্মকাণ্ডে বিশ্বব্যবস্থা যে একের পর এক ঝুঁকির মুখে পড়ছে, তার সর্বশেষ হচ্ছে বিশ্ব-বাণিজ্য ব্যবস্থা। ট্রাম্প সম্প্রতি চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত ও কানাডার পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।  পাল্টা এসব রাষ্ট্রও আমেরিকা থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ব্যবস্থা নিয়েছে। ফলে এখন এসব শিল্প উন্নত দেশের মাঝে একটি বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়েছে, যা বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার প্রবাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তাতে স্বল্প উন্নত দেশগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বিশ্ব মন্দার ঝুঁকির মুখে পড়বে বিশ্ব।

ট্রাম্প সম্প্রতি চীনের ৩ হাজার ৪শ’ কোটি ডলারের পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক আরোপ করেছেন এবং আরও  ১ হাজার ৬শ’ কোটি ডলারের ওপর শুল্ক আরোপের ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রেখেছেন। চীনের ৮১৮টি পণ্যের সর্বমোট ৫ হাজার কোটি ডলার আমদানি মূল্যের ওপর ২৫ শতাংশ হারে যে শুল্ক আরোপ আমেরিকা করেছে, তার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চীন বলছে, তারা আমেরিকা থেকে আমদানিকৃত সয়াবিন, গাড়ি ও সামুদ্রিক পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক বসাবে।

চীনের এ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্প বলছেন, চীন আমেরিকার পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক বসানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা থেকে সরে না এলে যুক্তরাষ্ট্র আরও শুল্ক বসাবে। চীনের পণ্যের ওপর শুল্ক বসানোর যুক্তি হিসেবে ট্রাম্প বলেছেন, চীনের পণ্য সস্তা, সে কারণে আমেরিকার বহু শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে  লাখ লাখ লোক বেকার হয়ে যাচ্ছে। আবার চীনের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্যঘাটতি দেখা দিয়েছে ৮০ হাজার কোটি ডলারের। অথচ আমেরিকায় ল্যাপটপ ও আইফোন তৈরির কোনও কারখানা নেই, আর এ দুটি জিনিসের মূল্য কম হওয়ায় চীনা ল্যাপটপ ও আইফোনে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। খুচরা যন্ত্রাংশও পর্যাপ্ত পরিমাণে সস্তা মূল্যে পাওয়া যায়, আবার ল্যাপটপ ও আইফোন টেকসইও।

আমেরিকার সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। নিত্য প্রয়োজনীয় চীনা ইলেকট্রিক সামগ্রী সস্তা ও টেকসই হওয়ায় ক্রেতাদের ঝোঁক চীনা সামগ্রীর প্রতি আর এসব সামগ্রীর ওপর শুল্ক আরোপ করলে সস্তা জিনিসগুলোর মূল্য বেড়ে যাবে। তখন ট্রাম্প সাধারণ ক্রেতাদের কোপানলে পড়বেন। সম্ভবত সেই কারণে গত ২ জুলাই ২০১৮ ইউএস চেম্বার অব কমার্স বলেছে, শুল্ক আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা হুমকিতে পড়েছে। চেম্বার বলেছে, ট্রাম্প মনে হয় এক ভয়াবহ বাণিজ্যযুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে।

পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া হিসাব অনুসারে, চীন আমেরিকা থেকে ১৩০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য ক্রয় করে আর আমেরিকা ক্রয় করে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের মালামাল। সুতরাং প্রতি বছর ঘাটতি বাণিজ্য হচ্ছে ৩৭০ বিলিয়ন ডলার। ঘাটতি বাণিজ্য মেটাতে শুল্ক বাড়ানোর পলিসি কোনও কার্যকর পলিসি নয়। চীনের অর্থনীতি রাশিয়া বা ইরানের অর্থনীতি নয় যে অবরোধের কথা বলে চীনকে নতিস্বীকার করানো যাবে। যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি জিএম গাড়ি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিক্রি হয় ৩০ লক্ষ, আর এই জিএম গাড়িই চীনে বিক্রি হয় ৪০ লাখ টাকায়। চীন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন, গরুর মাংস, শূকরের মাংস আর গম আমদানি করে থাকে।

বাস্তবতাকে স্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্র বড় বড় দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সংঘাত নয় একটি শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়া দরকার। স্টিল ও এলুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক বসানোর ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কানাডা, ভারত ও চীন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করে আমেরিকা তো পথ চলতে পারবে না। সবাই ঐক্যবদ্ধ প্রেসার সৃষ্টি করলে আমেরিকার অর্থনীতি তা কখনোই বরদাস্ত করতে পারবে না।

আমেরিকা চীনের কাছে, জাপানের কাছে ঋণী। ২০১৮ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত এক দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার পাবে চীন আর জাপান পাবে এক দশমিক শূন্য ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। খুবই প্রয়োজনীয় এসকেনডিয়াম, লেনতানাম, ক্রিয়াম, সামারিয়াম, টারবিয়াম, লুটি টাম, যাদের সম্মিলিত নাম আর.ই.ই., এসব ধাতু শুধু চীনেই পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়। অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র তৈরিতে এসব ধাতুর ব্যবহার হয়ে থাকে। চীন এসব ধাতু বিক্রি বন্ধ করে দিলে অস্ত্র উৎপাদনকারী করপোরেট হাউসগুলো থেকে ট্রাম্প প্রবল বাধার সম্মুখীন হবে।

সুতরাং চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমেরিকা পারবে না। বিশ্ব বাণিজ্যে সুস্থির ভাব ফিরিয়ে আনার জন্য আমেরিকার উচিত চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর ভারত-কানাডার সঙ্গে অচিরেই একটি মীমাংসায় পৌঁছানো। আমেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থা কোনোভাবেই ভালো নয়। ব্যাপক এক সংস্কার ভিন্ন আমেরিকা তার অবস্থার পরিবর্তন করতে পারবে না। এখন আমেরিকার উচিত হবে তার ৫০ স্টেটের প্রতিনিধিদের ডেকে তাদের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা করে জাতীয় ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস করা, নয়তো দারিদ্র্য ও বেকারত্ব জাতীয় অস্তিত্বকে বিরাট হুমকির মুখে ফেলবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

 

[email protected]

/এসএএস/এমএনএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ