X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনকালীন সরকার কেন?

আমীন আল রশীদ
০৫ জুলাই ২০১৮, ১৫:৪১আপডেট : ০৫ জুলাই ২০১৮, ১৫:৪৯

আমীন আল রশীদ জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রসঙ্গটি সামনে আসে। অথচ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলো ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই হয়। যুক্তি হিসেবে বলা হয়, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে জয়-পরাজয় ক্ষমতার পালাবদল ঘটায় না। ফলে এই নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হলো, তা খুব বেশি গুরুত্ব বহন করে না। দ্বিতীয় যুক্তি হিসেবে বলা হয়, যেহেতু ক্ষমতাসীনদের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো অনেক সময় প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিতর্কিত হয়, ফলে আরও বড় পরিসরের জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলো দলীয় সরকারের অধীনে অংশ নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। কারণ তাদের মনে এই আশঙ্কা থাকে যে সরকার নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করবে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, সেখানে নির্বাচনকালীন সরকার বলে কোনও বিধান ছিল না। তখন এ নিয়ে বিতর্কও ওঠেনি। বরং বঙ্গবন্ধু সরকারের অধীনেই ১৯৭৩ সালে, এরপর জিয়া সরকারের অধীনে ১৯৭৯ সালে, এরশাদ সরকারের অধীনে ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালে নির্বাচন হয়। তখন পর্যন্ত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের প্রসঙ্গটি সামনে আসেনি। দীর্ঘ গণআন্দোলনের মুখে এরশাদের পতনের পরে কার অধীনে নির্বাচন হবে, সেটি আলোচনায় আসে এবং তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের অধীনে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটিই প্রথম নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার।

তবে এই দাবিটি জোরালো হয় ১৯৯৬ সালে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করলেও এর ৫ বছরের মাথায় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে চলমান আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ‘বিতর্কিত’ ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করা হয়। এ ব্যবস্থায় সপ্তম,অষ্টম ও নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সর্বোচ্চ আদালত অবৈধ বলে রায় দিলে তার আলোকে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। ওই সময়ে অবশ্য অপেক্ষাকৃত ছোট আকারে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হয়। আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও এরকম একটি মন্ত্রিসভা গঠনের কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, আগামী অক্টোবরেই নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হতে পারে। কিন্তু এ বিষয়ে সংবিধান কী বলছে এবং এই ইস্যুতে আগামী দিনের রাজনীতির গতিপথ কোনদিকে যাবে?

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পৌনে দুই মাস আগে ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর যে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হয়েছিল, সেখানে নতুন-পুরাতন মিলিয়ে মোট সদস্য ছিলেন ২৯ জন। ওই সময়ে এই সরকারকে বলা হচ্ছিলো সর্বদলীয় সরকার। ওই সময়ে সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কাছে ওই নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য নাম চাওয়া হলেও তারা কারও নাম দেয়নি। এমনকি তাদের পছন্দের মন্ত্রণালয় দেওয়া হবে– এমন প্রতিশ্রুতির পরও তারা ওই মন্ত্রিসভায় কারও নাম দেয়নি বরং নির্বাচন বর্জন করে। সেই নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশের রাজনীতিতে কী বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা সবার জানা।

প্রশ্ন উঠছে, আগামী ডিসেম্বরে যে একাদশ জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা, তার আগেও কি পরিস্থিতি এরকম হবে? সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ হুমকি দিয়েছেন, সরকার পতনে ৬৯ ও ৯০-এর মতো গণআন্দোলন গড়ে তোলা হবে। এ মুহূর্তে গণআন্দোলনের বাস্তবতা এবং বিএনপির সেই সক্ষমতা আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে পরিস্থিতি যে খুব স্বাভাবিক থাকবে না, তা মোটামুটি আন্দাজ করা যাচ্ছে। কেননা, বিএনপি এখনও নির্বাচনকালীন এমন একটি সরকারের দাবিতে অনড়, যার প্রধান হিসেবে থাকবেন একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি। আরও স্পষ্ট করে বললে, তারা সরকারের প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কাউকে চায়। কিন্তু বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী তার কোনও সুযোগ নেই। যদি করতে হয় তাহলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। তারও কোনও সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। এবার বিএনপির এই নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের বাইরে দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুটিও রয়েছে। ফলে আগামী কয়েক মাসে দেশের রাজনীতির গতিপথ কোনদিকে যাবে, তা বলা মুশকিল। যদিও আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী যে শেখ হাসিনার অধীনেই বিএনপি নির্বাচনে যাবে; না হলে বিএনপি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।

নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে সংবিধানে সুস্পষ্ট কোনও রূপরেখা না থাকলেও কিছু ইঙ্গিত রয়েছে। ৫৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংসদ ভেঙে যাওয়া এবং সংসদ -সদস্যদের অব্যবহিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে কাউকে মন্ত্রী নিয়োগ করার প্রয়োজন দেখা দিলে সংসদ ভেঙে যাওয়ার অব্যবহিত আগে যারা সংসদ-সদস্য ছিলেন, তারা বহাল থাকবেন। ফলে দেখা যাচ্ছে নির্বাচন সামনে রেখে যদি সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় অথবা সংসদ বহাল রেখেই একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হয়, তারপরও সংসদ সদস্যরা তাদের পদে বহাল থাকবেন। আর ওই অন্তর্বর্তী মন্ত্রিসভার সদস্য নিতে হবে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকেই। একটা বিতর্ক এরকম আছে যে, সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদ ভেঙে দিলে সরকার থাকবে কিনা? এই প্রশ্নের জবাবও ৫৬ অনুচ্ছেদে রয়েছে। বলা হয়েছে, নির্বাচনের তিন মাস আগে যদি সংসদ ভেঙেও দেওয়া হয় তারপরও সংসদ সদস্যরা স্বপদে বহাল থাকবেন।

সংবিধানের ৫৭ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোনোকিছুই অযোগ্য করিবে না।’ অর্থাৎ যিনি জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন, নতুন একজন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত তিনি স্বপদে বহাল থাকবেন।

সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় নির্বাচন নিয়ে যাতে জটিলতার সৃষ্টি না হয় সেজন্য সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একটি অধিবেশন শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে পরবর্তী অধিবেশন শুরুর বাধ্যবাধকতা থাকলেও নির্বাচনের পূর্ববর্তী (যে সময়কালকে বলা হচ্ছে নির্বাচনকালীন বা অন্তর্বর্তী সরকারের সময়) ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের অধিবেশন বসবে না। অর্থাৎ আদতে সংসদ থাকলেও এর কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। কিন্তু সরকার তার রুটিন কাজ চালাতে পারবে।

শোনা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এবারও সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সাতটি রাজনৈতিক দল (আওয়ামী লীগ,জাতীয় পার্টি,জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন,জাতীয় পার্টি (জেপি),বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট) এবং স্বতন্ত্র জোটের সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে একটি নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠিত হবে,যেখানে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ২৫ থেকে ৩০ জন সদস্য থাকতে পারেন। যদিও সংবিধান অনুযায়ী টেকনোক্র্যাট কোটায় কারও এই নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় থাকার সুযোগ নেই। সংবিধানে পরিষ্কার বলা আছে,অন্তর্বর্তী মন্ত্রিসভার সদস্য নিতে হবে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকেই। ফলে এবার যদি বিএনপির সঙ্গে কোনও সমঝোতা হয়ও, তারপরও তাদের মধ্যে থেকে কাউকে নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় নেওয়ার সুযোগ নেই।

সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচনকালীন সকল নির্বাহী ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে পরামর্শক্রমে প্রয়োগ হওয়ার কথা। এমনকি ইসির সঙ্গে পরামর্শ না করে সরকার কোনও থানার ওসিও বদলি করতে পারে না। কার্যত নির্বাচন কমিশন এভাবে তার ক্ষমতা স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করতে পারলে এবং মাঠ প্রশাসন ইসিকে সব ধরনের ভয়ভীতি ও চাপের ঊর্ধ্বে ওঠে নির্বাচন কমিশনের আদেশ পরিপালন করতে পারলে, নির্দলীয় সরকার ছাড়াও একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব। কিন্তু সমস্যা আমাদের পদ্ধতিতে। সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে তাত্ত্বিকভাবে যথেষ্ট ক্ষমতা দিলেও তারা এর কতটুকু প্রয়োগ করতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। সবচেয়ে বড় কথা, যে নির্মম বাস্তবতায় ১৯৯৬ সালে সংবিধানে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের বিধান যুক্ত করা হয়েছিল, সেই বাস্তবতা শেষ হয়ে গেছে কিনা? অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট ছিল,তার অবসান হয়েছে কিনা? দলীয় সরকারের অধীনে এযাবৎ যত জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়েছে, সেগুলো বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল কিনা? যদি না থাকে, তাহলে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি অমূলক। কিন্তু যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট থাকে এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়,যদি সেই নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য না হয়– তাহলে জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচনকালীন সরকারের ইস্যুতে বিতর্ক চলতেই থাকবে।

লেখক: সাংবাদিক

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কড়া নিরাপত্তায় চলছে ভোটগ্রহণ
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: কড়া নিরাপত্তায় চলছে ভোটগ্রহণ
পাকিস্তানে জাপানি নাগরিকদের লক্ষ্য করে জঙ্গি হামলা
পাকিস্তানে জাপানি নাগরিকদের লক্ষ্য করে জঙ্গি হামলা
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
মাদারীপুরে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ