X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘নিজের চরকায় তেল দিন’

প্রভাষ আমিন
০৭ জুলাই ২০১৮, ১৬:৪৮আপডেট : ০৭ জুলাই ২০১৮, ১৬:৫১

প্রভাষ আমিন আমরা অনেক উন্নতি করেছি। কিন্তু আমাদের মানসিকতা খুব একটা বদলায়নি এখনও। ঔপনিবেশিক স্মৃতি যেন এখনও আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁথে আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের রাষ্ট্রদূত আছেন। কিন্তু তারা কখনও সে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলিয়েছেন, এমন কোনও বদনাম নেই। কিন্তু বাংলাদেশের নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা যেন এ দেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। এর জন্য দায় যতটা তাদের, তারচেয়ে বেশি আমাদের। আমরা সবসময় বিদেশি কূটনীতিকদের মাথায় তুলে নাচি। মার্কিন রাষ্ট্রদূত, যুক্তরাজ্য বা ভারতের হাইকমিশনার বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা আমাদের রাজনীতির প্রভাবক। আমরা তাদের ডেকে এনে বা প্রশ্ন করে বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে তাদের মতামত নেই এবং তা ফলাও করে প্রচার করি। বিদেশি কূটনীতিকদের সীমা দু’দেশের সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। কিন্তু তারা প্রায়ই সীমা লঙ্ঘন করেন। তাদের সব আগ্রহ যেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে।
বিদেশি কূটনীতিকদের মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন রাষ্ট্রদূত। বাংলাদেশের আমজনতাও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের নাম জানে বা চেনে। অথচ তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। নিজের দেশের রাজনীতিতে তার কোনও গুরুত্ব নেই, প্রভাব নেই, প্রভাব রাখার সুযোগও নেই। সব ‘মাতব্বরি’ বাংলাদেশে এসে। অথচ উল্টোটা একটু ভাবুন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লোকজন তো দূরের কথা, বাংলাদেশের লোকই জানে না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সবসময়ই পর্দার আড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা থাকে। ইদানীং ভারতের ভূমিকা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। আগেই বলেছি, এর দায় পুরোটা তাদের নয়। তারা তো নাক গলানোর চেষ্টা করবেই। কিন্তু আমরা তাদের নাক গলাতে দেই কেন?

বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, নির্বাচন ব্যবস্থা, মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তাদের উদ্বেগের কমতি নেই। সর্বশেষ গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর ডিক্যাবটকে অংশ নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট নির্বাচনের নানা অনিয়ম নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আমি বলছি না, গাজীপুরে নির্বাচন তুলসি পাতায় ধোয়া হয়েছে। জাল ভোট, বিএনপির এজেন্টদের ঢুকতে না দেওয়া বা বের করে দেওয়ার মতো নানা অভিযোগ গণমাধ্যমে এসেছে। এ নিয়ে সমালোচনাও হচ্ছে। বিএনপিও নানা অভিযোগ করেছে। নির্বাচন যেমন হয়েছে, তেমন আমরাও চাই না। আমরাও চাই সব নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হোক। কিন্তু সেটা আমাদের বার্নিকাটের মুখ থেকে শুনতে হবে কেন?

গত দেড় বছরে বার্নিকাটের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের যে হাল হয়েছে, তা নিয়ে কি তিনি কখনও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন? এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়ে এখনও তদন্ত চলছে, সেটা নিয়েও কিন্তু বার্নিকাটের কোনও উদ্বেগের খবর শুনিনি। তাদের দেশের শুনানি হচ্ছে যে অভিযোগ নিয়ে, তা নিয়ে মাথাব্যথা না থাকলেও; আমাদের দেশের নির্বাচনের অভিযোগ নিয়েও তার উদ্বেগের অন্ত নেই। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের উদ্বেগ আছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের দাবি জানিয়েছি আমরাও। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্প ট্রাম্প যে অভিবাসন প্রত্যাশী মায়ের কোল থেকে শিশু সন্তানদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছেন, তা নিয়ে কি বার্নিকাটের হৃদয়ে কোনও তোলপাড় আছে? মুসলমান দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ব্যাপারে যে ট্রাম্প কড়াকড়ি আরোপ করেছেন, তা নিয়ে কোনও প্রতিবাদ হয়েছে? দুদিন পর পর যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনও না কোনও স্কুলে বন্দুকধারীর গুলিতে শিশুরা মারা যাচ্ছে, তাতে কি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় না?

বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে চিন্তায় বার্নিকাটের ঘুম হয় না। কিন্তু ট্রাম্প যে নির্বাচিত হয়েও ইম্পেরিয়াল প্রেসিডেন্সি কায়েম করেছেন, স্বৈরাচার হয়ে উঠছেন, তা নিয়ে তার কোনও ভাবনা আছে বলে শুনিনি। ডোনাল্ড ট্রাম্প যে টুইটারে তার ইম্পেরিয়াল প্রেসিডেন্সি চালাচ্ছেন, তা নিয়ে যে সবাই হাসাহাসি করছে– তা কি বার্নিকাট জানেন না?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারাবিশ্বে খবরদারি করে বটে। কিন্তু নিজেদের দেশে তারা দারুণ গণতান্ত্রিক। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তার বিকাশ, অভ্যন্তরিণ মানবাধিকার নিয়ে তারা রীতিমত উদাহরণ ছিল। ছিল বলছি, কারণ ট্রাম্প এরই মধ্যে সব তছনছ করে দিয়েছেন। আগে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্টের মুখের ওপর যে কোনও কিছু বলে দেওয়া যেতো। কিন্তু মনেপ্রাণে স্বৈরাচার ট্রাম্পের সহিষ্ণুতা লেভেল শূন্য। কেউ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কিছু বললেই তিনি তাকে ‘ফেক’ বলে উড়িয়ে দেন। এখন আর যুক্তরাষ্ট্রে ভিন্নমতের কোনও জায়গা নেই। তবে গত সপ্তাহে একটি খবর দেখে আশাবাদী হয়েছিলাম, যাক তাহলে এখনও সব ফুরিয়ে যায়নি।

গত ২২ জুন শুক্রবার রাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখপাত্র সারাহ সান্ডার্স ভার্জিনিয়ার লেক্সিংটনের রেড হেন রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলেন। কিন্তু রেস্টুরেন্টের মালিক স্টেফানি উইলকিনসন ট্রাম্প প্রশাসনকে অমানবিক ও অনৈতিক আখ্যা দিয়ে সান্ডার্সকে চলে যেতে বলেন। সান্ডার্সও সপরিবারে বেরিয়ে আসেন। তবে রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষের এ আচরণকে বৈষম্যমূলক বলে সমালোচনাও করেছেন কেউ কেউ। এটাই মার্কিন মুক্ত সমাজের সৌন্দর্য্য। যত ক্ষমসতাশালীই হোক, যে কাউকে রেস্টুরেন্ট থেকে বের করে দেওয়ার স্বাধীনতা যেমন আছে, তেমনি কারও সমালোচনা করার অধিকারও আছে। কিন্তু আমার আশার গুড়ে বালি পড়তে সপ্তাহের বেশি সময় লাগেনি। সান্ডার্সকে বের করে দেওয়ার ‘অপরাধে’ এক সপ্তাহ পর ব্যবসায়ী কমিউনিটি রেড হেন রেস্টুরেন্টের মালিক স্টেফানি উইলকিনসনকে বহিষ্কার করেছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, চাপটা হোয়াইট হাউস থেকেই এসেছে। তারমানে যুক্তরাষ্ট্র এখন প্রায় ‘উন্মাদ’ এক ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার খেলার পুতুল। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ভিন্নমতের অধিকার– সব এখন ভূলুণ্ঠিত। সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত যখন বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন হন, তখন আমরা উদ্বিগ্ন হই নিজেদের মর্যাদা নিয়ে। আমার খালি বার্নিকাটকে বলতে ইচ্ছা করে, ‘ম্যাডাম প্লিজ, অয়েল ইউর ওন মেশিন’। ‘নিজের চরকায় ভালো করে তেল দিন’। আপনাদের চরকা কিন্তু আটকে যাওয়ার দশা।

আর একটা আত্মোপলব্ধি। আমরা যেন বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে দেশের অভ্যন্তরিণ রাজনীতি নিয়ে কোনও প্রশ্ন না করি। তারা যদি নিজে থেকে কিছু বলেও ফেলেন, আমরা যেন আমলে না নেই, গুরুত্ব না দেই। কূটনীতিকরা যেন তাদের সীমার মধ্যেই থাকেন। অতিক্রম করার ঔদ্ধত্য না দেখান।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ