X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব প্রশাসনকেই নিতে হবে

জোবাইদা নাসরীন
০৮ জুলাই ২০১৮, ১৪:২৩আপডেট : ০৮ জুলাই ২০১৮, ১৪:২৪

জোবাইদা নাসরীন অনেকেই বলেন ছাত্ররা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু আমি মনে করি ছাত্ররাই হলো বর্তমান। তাদের চিন্তা-ভাবনার মধ্য দিয়েই আমরা দেখি বর্তমানের এগিয়ে চলাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় যখন তরুণ নেতৃত্বের জয়জয়কার তখনও আমরা এদেশে ‘মুরুব্বি’ খুঁজি। তবে সব সময়ই যে আমরা বয়সের মাপে ‘মুরুব্বি’ মানি তা নয়, ক্ষমতার মাপকাঠিতেও নির্ধারিত হয়ে পড়ে ‘মুরুব্বি’। তাই কোনও ক্ষেত্রে সহপাঠীকে ‘মুরুব্বি’ মানতে হয়, ‘মুরুব্বি’ হয়ে যায় জুনিয়র কেউ। তাই এই সাধারণ আর রাজনৈতিক ‘মুরুব্বি’র প্রতিদিনকার দেনদরবারের মধ্য দিয়েই আমরা বুঝতে চেষ্টা করি বিশ্ববিদ্যালয়ের গত তিন দশকের রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ধারণাটিকে ঠিকভাবে বোঝা যায় না। ক্লাসরুম, পড়ানো, পরীক্ষা, সেমিনার, হল জীবন, ক্যান্টিন, সিম্পোজিয়ামের মধ্য দিয়েই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটি সঠিকভাবে হাজির হয় না। আমার কাছে মনে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের যে শানিত বোধ এবং পারস্পরিক সম্পর্কের যে আদর্শিক চর্চা  সেটিই বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সঙ্গে অনেক বেশি যুক্ত। আর এই কারণেই স্পষ্টভাবে বলা যায় যে এই বোধের কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন সময়ে হয়ে উঠেছিল কিংবা এখনও সকল প্রগতিশীল আন্দোলনের সূতিকাগার।

এত কথা বলার কারণ অনেক। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১০ জনের মতো শিক্ষার্থী আটক রয়েছে। এই আটকের কারণ তারা গত চার মাস ধরে কোটা সংস্কারের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমরা এটাও জানি আন্দোলন, প্রতিবাদ এইগুলো হলো একটি দেশের গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রতিবাদ, আন্দোলনকে দমিয়ে, মুচড়িয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা গণতন্ত্রবিরোধী। রাষ্ট্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে গণতন্ত্রের সংজ্ঞার সঙ্গে এই বিরোধপূর্ণ অবস্থান মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের মতাদর্শিক আদল থেকে আমাদের ছিটকে ফেলছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রধান চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরিচালিত হয়। সে অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত। তার মানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজের বলয়ে, পরিসরে, জ্ঞানে, আদর্শে নিজেদের মতো করে ভাবার, পরিচালিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এই স্বায়ত্তশাসনের দাপটশালী চর্চা হচ্ছে  শুধুমাত্র শিক্ষক রাজনীতির ক্ষেত্রে। অন্য ক্ষেত্রে এটি তেমনভাবে প্রযোজ্য হয়নি। সেই স্বায়ত্তশাসনের অংশ হিসেবে ছাত্র রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং এখনও আছে। তবে যে ধারায় ছাত্র রাজনীতির চর্চা হচ্ছে সেটি হয়তো অনেকাংশেই কাঙ্ক্ষিত নয়। শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকার নিয়ে স্বর তুলবে, ছাত্র সংসদ থাকবে, তারা শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কথা বলবে- এগুলোই চর্চিত হওয়ার কথা ছিল।  সেই স্বায়ত্তশাসনের হিসাব অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি হামলার কোনও সুযোগ নেই। সেটিও বিভিন্ন দফায় বাদ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে পুলিশি হামলা হয়েছে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় সকল আন্দোলনই প্রশাসনের কাছে ‘বিশ্ববিদ্যালয় অস্থির’ করার আন্দোলন হিসেবে অনুবাদিত হচ্ছে। এই অনুবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সমস্যা বয়ে আনবে। আন্দোলন মানেই গদি হঠানো নয়, আন্দোলন মানে হলো শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে ভাবছে। তাই প্রশাসনও বিষয়টিকে এভাবে দেখলে প্রত্যেকটি আন্দোলনের ফলাফল খুব যৌথ বোঝাপড়ায় শেষ হতো।

এই বছরেই কোটা সংস্কার আন্দোলনের একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করেছে। তখনও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলেছিলেন তারা জানেন না এই টিয়ার গ্যাস সম্পর্কে। কিন্তু প্রশাসন তাহলে চাইলো না কেন প্রশাসনের অজ্ঞাতে কেন পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করলো? ঈদের পরে আবারও এই আন্দোলন দমাতে দফায় দফায় পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের ‘ডান্ডা মেরে ঠান্ডা’ করে দেওয়া’র কাজ প্রশাসন একভাবে অনুমোদন করেছে। গ্রেফতার করা হয়েছে অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থীকে। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান বলেছেন, ‘গ্রেফতার আছে নাকি? যা হবে আইনি কাঠামোর মধ্যেই হবে। আইনি প্রক্রিয়ায় ১৮ বছর বয়স হলে ব্যক্তিকে তার নিজের দায়দায়িত্ব নিতে হয়। সবার জন্যই এই আইন প্রযোজ্য’। তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের কাঁধে ভর দিয়ে যেন কোনও অশুভ শক্তি তাদের স্বার্থ উদ্ধার করতে না পারে, সে জন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম বিনষ্ট করার কোনও অপপ্রয়াস সহ্য করা হবে না’।

প্রক্টর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও ছাত্রদের গ্রেফতার, তাদের ওপর হামলার বিষয়গুলো এড়িয়ে চলেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রথমে ছাত্রলীগের হামলার বিষয়ে বলেছেন, ‘জানেননি, শুনেননি, কেউ অভিযোগ করেননি’ বলে প্রশাসনিক দায় এড়িয়েছেন, যা প্রশাসনিক দিকে থেকে অত্যন্ত বেমানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাকসুদ কামাল বলেছেন, ‘শিক্ষক সমিতির কাজ শিক্ষকদের স্বার্থ দেখা। তাছাড়া তারা শিক্ষা কার্যক্রম ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিষয়টা দেখেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের গ্রেফতারের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানে’। তবে শিক্ষকদের ব্যাপারে পূর্ণ নজর রাখা শিক্ষক সমিতির তরফ থেকে অবশ্য প্রেসক্লাবে পুলিশ কর্তৃক অধ্যাপক ফাহমিদুল হককে লাঞ্ছনার বিষয়ে কোনও ধরনের বিবৃতি এখনও আসেনি। আশা করছি এই বিষয়ে শিক্ষক সমিতি নিন্দা প্রকাশ করবেন।

২০১৩ সালেও আরও তিনজন ব্লগারসহ গ্রেফতার করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র সুব্রত শুভকে। সেই সময়ও শুভ’র মুক্তি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গড়িমসি ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বেশ কয়েকজন শিক্ষক এগিয়ে এসেছিলেন এবং সেই সময়ের প্রশাসনকে অনুরোধ করেছিলেন এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে। পরে প্রশাসন করেছিল। তাই এখনও যখন প্রশাসন বলছেন তারা এই বিষয়ে দায়িত্ব নেবেন না, তখনও আমরা বলবো, ওরা আমাদের ছাত্র, ওদের আন্দোলনের অধিকার আছে, ওদের বিষয়ে আমাদের দায়িত্ব নিতে হবেই।

তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রয়োজন এই মুহূর্তে  আটককৃত শিক্ষার্থীদের বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়ে তাদের মধ্যে এই মনোভাব ফিরিয়ে আনা যে আমরা তাদের পাশেই আছি। এটাই হলো বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের মূলমন্ত্র। শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে প্রশাসনিক বৈঠক এবং আলাপ-আলোচনার পরিসর তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কানের সমান্তরাল তিন বিভাগে কোন কোন দেশের ছবি
কান উৎসব ২০২৪কানের সমান্তরাল তিন বিভাগে কোন কোন দেশের ছবি
বিএনপির কারণে ভিন্ন কৌশল নেওয়ার কথা জানালো আ.লীগ
উপজেলা নির্বাচনবিএনপির কারণে ভিন্ন কৌশল নেওয়ার কথা জানালো আ.লীগ
মাদক-চাঁদাবাজি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে পল্লবীতে পাভেল হত্যা
৮ জনকে গ্রেফতারের পর ডিবি’র দাবিমাদক-চাঁদাবাজি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে পল্লবীতে পাভেল হত্যা
পিবিআইয়ের প্রতিবেদন গ্রহণ, পরীমনিকে আদালতে হাজির হতে সমন জারি
পিবিআইয়ের প্রতিবেদন গ্রহণ, পরীমনিকে আদালতে হাজির হতে সমন জারি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ