X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

মিডিয়ায় লেখক সংকট ও উত্তরণের উপায়

মো. সামসুল ইসলাম
০৮ জুলাই ২০১৮, ১৫:০২আপডেট : ০৮ জুলাই ২০১৮, ১৫:০৫

মো. সামসুল ইসলাম বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা ও মিডিয়া স্টাডিজ বিষয়ে শিক্ষকতা করতে গিয়ে আমি সব সময় উপলব্ধি করেছি যে বাংলাদেশের মিডিয়া লেখক সংকটে ভুগছে। আমাদের দ্রুত বর্ধনশীল মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির জন্য এটি একটি ভয়াবহ সমস্যা। এ সংকটের উপলব্ধি আমার নিতান্ত ব্যক্তিগত, তবে অতি সম্প্রতি কিছু দিন একটি ইংরেজি দৈনিকে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় এ বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছে। বাংলাদেশে যে পত্রিকার কলাম, মতামত বা বিশ্লেষণধর্মী লেখার লেখকের ভীষণ অভাব সে সম্পর্কে আমার মনে আর কোনও সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশের মিডিয়া শিল্পের পরিসর দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রিন্ট মিডিয়ার ক্ষেত্রে, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরের (ডিএফপি) ২০১৮ সালের মার্চের সর্বশেষ তালিকা অনুসারে দেশে নিবন্ধিত দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ১২০০, সাপ্তাহিক ১১৭৯, পাক্ষিক ২১৩ ও মাসিক পত্রিকা ৪০৬টি। এ তালিকার সবাই যে সক্রিয় তা আমি বিশ্বাস করতে বলছি না। কিন্তু এর কিছু অংশ নিয়মিত প্রকাশিত হলেও তা মোটেই কম নয়। এর ওপর রয়েছে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে জনপ্রিয় হতে থাকা অনলাইন নিউজ পোর্টালসমূহ। ১৬ কোটি মানুষের দেশে শিক্ষার হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের চাহিদাও দ্রুত বাড়ছে। এবং এটি কমে যাওয়ার কোনও কারণ নেই।

কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় আমি দেখলাম ইংরেজিতে তো অবশ্যই, এমনকি বাংলাতেও দেশে কলাম লেখক ও বিশ্লেষকের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কম। পুরনো কিছু খ্যাতিমান লেখক ছাড়া পত্রপত্রিকার জন্য নতুন লেখক খুব কমই উঠে আসছেন। আর এলেও তা দীর্ঘ সময়ের জন্য নয়। কিছুদিন লিখে তারা বিদায় নিচ্ছেন। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বিষয়ে লেখার জন্য জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যে দক্ষতা থাকা দরকার তা অনেকেরই থাকে না। শুধু ভাষার ওপর দক্ষতা থাকলেই ভালো কলাম লেখক হওয়া সম্ভব নয়। পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখক ও বিশ্লেষকদের ভাষার পাশাপাশি থাকতে হবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, প্রযুক্তি ইত্যাদি সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান। এই বৈচিত্র্যময় বা বিশেষায়িত জ্ঞানের অভাবে দেশ মিডিয়ার জন্য ভালো লেখক পাচ্ছে না।   

আবার সমাজে পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই এখন আর লিখতে আগ্রহী নন। লেখার পরিবর্তে তারা টেলিভিশনের টকশোতে বা পত্রিকার ক্ষেত্রে ইন্টারভিউ দিতে বেশি আগ্রহী। টেলিভিশন টকশোতে বক্তারা সঙ্গে-সঙ্গেই টাকা পেয়ে যাচ্ছেন, সেই সঙ্গে পাচ্ছেন খুব দ্রুত পরিচিতি। তাই লেখালেখিতে অনেকে আর আগ্রহ বোধ করছেন না।

ভালো লেখক তৈরি না হওয়ার জন্য আমাদের মিডিয়ার দায়ও কম নয়। অন্যান্য দেশের পত্রপত্রিকার নিজস্ব কলামিস্ট বা oped writer থাকলেও আমাদের পত্রপত্রিকাগুলো মূলত ধার করা কলাম বা মতামত লেখকদের ওপর নির্ভরশীল। নিজস্ব থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই স্বল্প। এর একটি অন্যতম প্রধান কারণ হয়তো অর্থনৈতিক। সম্পাদকীয় বিভাগে দক্ষ লেখক চাইলে ভালো বেতন দিতে হবে। পত্রিকা ব্যবসা মন্দার কারণে অনেক পত্রিকাই এটিকে বাড়তি খরচ মনে করেন।  

বিশ্লেষণধর্মী লেখার অভাবে আমি মনে করি সমাজে জ্ঞানচর্চার বিকাশ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, ভবিষ্যতমুখী চিন্তা ব্যাহত হচ্ছে, এবং সঠিকভাবে ভিন্নমতের প্রতিফলন না থাকায় সমাজে শুধুমাত্র এলিটদের মতামতই প্রাধান্য পাচ্ছে। আরো চিন্তার বিষয় যেটি তা হলো আমাদের দেশে এখন ক্ষেত্রবিশেষে সোশ্যাল মিডিয়া মূলধারার মিডিয়াকে পরিচালিত করছে এবং তাদের এজেন্ডা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। এর ভালো কিছু দিক থাকলেও অর্ধসত্য ও অপরিপক্ব মতামতের কারণে এটি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য মাঝে মাঝে বিপদের কারণও হতে পারে।

ফেসবুকে রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি খেলাধুলা নিয়ে ভয়ানক বিতর্ক মাঝে মাঝেই বাস্তবে সংঘর্ষের দিকে গড়াচ্ছে। এখানে বিভিন্ন স্বার্থ কাজ করে, যা অনেক সময় সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারে।

আমি খুব সাধারণ একটি উদাহরণ দেই। সম্প্রতি মেসেঞ্জারে আমি একটি বার্তা পেলাম, যেখানে দেশের দুই একটি বিখ্যাত পানীয়র উল্লেখ করে বলা হচ্ছে সেগুলো থেকে দূরে থাকতে। কারণ, এতে নাকি এইচআইভি জীবাণুযুক্ত রক্ত মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে সম্ভবত নিজেদের স্বার্থ পূরণে এটি কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাজ। আমি নিশ্চিত দেশের অনেক সাধারণ মানুষ এটি বিশ্বাস করবেন। মেইনস্ট্রিম মিডিয়া তাই এখনও আমাদের অন্যতম ভরসার স্থান। আমরা চাই সমাজে তথ্যপ্রবাহ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের নিয়ন্ত্রণ থাকুক অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও লেখকদের হাতে, যারা বিভিন্ন সংকটের সময় জাতিকে পথ দেখাবেন।

প্রশ্ন হচ্ছে এ থেকে উত্তরণের পথ কী? প্রথমেই যেটা বলবো তা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেখালেখিকে উৎসাহিত করা। আমাদের দেশে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়েটিভ রাইটিং সম্পর্কিত আলাদা বিভাগ আছে বলে আমার জানা নেই। সাংবাদিকতায় নিজের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমাদের দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে সম্পাদকীয়, কলাম বা মতামত লেখা এবং সেগুলো কীভাবে পাঠকপ্রিয়তা পেতে পারে সে ব্যাপারে আলোচনা খুব কমই হয়। এজন্য সাংবাদিকতা শিক্ষার কারিকুলাম ঢেলে সাজানো দরকার। শুধু সাংবাদিকতা বিভাগ নয়, সামাজিক বিজ্ঞানের এমনকি বিজ্ঞান ও বাণিজ্য অনুষদের বিভাগগুলোতে প্রবন্ধ লেখার কৌশল শেখানো দরকার।

আমি ইংল্যান্ডে অধ্যয়নরত এবং গবেষণার ক্ষেত্রে দেখেছি কীভাবে ছাত্রদের প্রবন্ধ বা মতামত লেখা শিখানো হয়। ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেখা যদি বিশ্লেষণধর্মী না হয়ে বর্ণনামূলক হয় এবং তাতে শিক্ষার্থীদের নিজস্ব মতামত না থাকে তাহলে ভালো রেজাল্ট তো দূরের কথা, পাস করাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আর plagiarism বা বুদ্ধিবৃত্তিক চৌর্যবৃত্তির তো প্রশ্নই ওঠে না। কয়েক লাইন তো দূরের কথা, পরপর কয়েকটি শব্দ কপি করলে অনেক ক্ষেত্রে তার ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যেতে পারে। অথচ আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেখালেখির নামে চলছে তো কপি পেস্টের রাজত্ব। শিক্ষকরাও এক্ষেত্রে থাকেন অসহায়। বেশি কড়াকড়ি করলে শিক্ষার্থীরা তার বিপক্ষে যাবে, খারাপভাবে মূল্যায়ন করবে এবং তার শিক্ষকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। জ্ঞানচর্চার জন্য এ অচ্ছেদ্য চক্র ভাঙতে হবে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই।

মিডিয়ারও এক্ষেত্রে বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। তাদের মনে রাখতে হবে যে কলাম লেখক বা বিশ্লেষক একটি বিশেষায়িত পদ এবং যাকে-তাকে ধরে এনে কলাম লেখানো খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কোনও পেশাজীবী বা বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে চাইলে তার সাক্ষাৎকার নেওয়া যেতে পারে অথবা তার বক্তব্য সংবাদে সন্নিবেশিত করা যেতে পারে। দীর্ঘদিন মিডিয়া সমালোচক হিসেবে কাজ করার কারণে আমরা বুঝতে পারি দেশে পত্রিকার বিশ্লেষণ বা মতামতের কলামগুলো তাদের ঔজ্জল্য হারাচ্ছে। অথচ আমাদের দেশের রয়েছে সাংবাদিক ও কলাম লেখকদের এক বর্ণিল ইতিহাস। আব্দুস সালাম, মানিক মিয়া বা জহুর হোসেন চৌধুরীর মতো কলাম লেখকরা তাদের লেখনীর মাধ্যমে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছেন।

বিভিন্ন সময়ে প্রমাণিত হয়েছে যে আমাদের জনগণ পড়তে আগ্রহী। সুস্থ জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে জনগণের শিক্ষা ও বিনোদনের ভার নিতে হবে কিন্তু আমাদের মিডিয়াকেই। ধারণার দুর্ভিক্ষের এ সময়ে দেশের অগ্রযাত্রার ধারণা কিন্তু তাদের লেখকদের কাছ থেকেই আসতে হবে।    

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

ইমেইলঃ [email protected]  

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ