X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

‘বাঙালি শুধু কান্দে আর উচ্ছন্নে যায়’

চিররঞ্জন সরকার
১১ জুলাই ২০১৮, ১৬:১১আপডেট : ১১ জুলাই ২০১৮, ২০:২০

চিররঞ্জন সরকার কোটা ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন আন্দোলনকারীরা। এতে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নূরসহ আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে নুরুল হক নূরকে মারধরের সময় তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জাভেদ আহমেদ। এ সময় হামলাকারীরা তার ওপর চড়াও হয়। এতে তার হাতের একটি আঙুল কেটে যায়। এই আন্দোলনের সমর্থনকারী অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের বেধড়ক পিটুনির শিকার হয়ে কান্না করেছেন। গণমাধ্যমে এই নির্মম পিটুনির এই দৃশ্য দেখে অনেক পাঠকও কেঁদেছেন! কিন্তু তাতে হামলাকারীদের হৃদয়ে এতটুকু করুণার আলোড়ন সৃষ্টি হয়নি। তারা যা করেছে, তা যেন ‘শত্রু নিধনের’ জন্য করেছে!
আমাদের রাজনীতি বিভাজিত শত্রু ও মিত্রের মধ্যে। শত্রু ও মিত্রের বিভাজনের কথাটি বলেছিলেন উনিশ শতকের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কার্ল শ্মিট তার প্রসিদ্ধ ‘দ্য কনসেপ্ট অব দ্য পলিটিক্যাল’ গ্রন্থে। তিনি বোধহয় আমাদের বাংলাদেশের কথা ভেবেই এত দিন আগে গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন!
শত্রু-মিত্র কথা দু’টি এখানে আলঙ্করিক অর্থে ব্যবহৃত হয় না। তারা ব্যক্তিও নয় ও আমার শত্রু নয়, আমাদের শত্রু—এভাবে বিচার করলে আমরা বুঝতে পারি শত্রু-মিত্র হলো পাবলিক ক্যাটাগরি। রাজনৈতিক আঙিনায় শত্রু-মিত্রের বাস্তবতা, সত্যতা বোঝা যাবে লড়াই, সংঘাত, যুদ্ধের সময়। তাই শত্রু-মিত্রের সঙ্গে যেটা অপরিহার্যভাবে যুক্ত, সেটা হলো দাঙ্গা, মারামারি, বিদ্বেষ। সত্যিকারের দাঙ্গাবাজিতে শত্রু ও মিত্রের আসল অর্থ প্রকাশ পায়।


বাংলাদেশের মানবিক অস্তিত্বের মূল কথা—তুমি তোমার শত্রুকে প্রাণে মারার জন্য সব সময় তৈরি থাকবে। এটা তার রাজনৈতিক অস্তিত্বও বটে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক অস্তিত্বের মূলে রয়েছে হিংসা, তার চরম অর্থ হত্যা বা ধ্বংস। অর্থাৎ রাজনীতি বলতে এখানে বোঝা হয় শত্রু ও মিত্রের আলাদা দল তৈরি করে তাদের পরস্পরকে হত্যা করার জন্য প্রস্তুত রাখা।
আমাদের দেশের গত চার যুগের রাজনীতির ভিত্তিমূলে আছে শত্রু-মিত্র বিভাজন। বিভাজনের দাঙ্গাবাজির রাজনীতিতে মানুষ বাস করছে এক অবক্ষয়িত সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের পরিবেশে। এখানে একমাত্র প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো, তুমি কাকে হত্যা করতে প্রস্তুত আছ এবং কার জন্য মৃত্যুবরণ করতে তৈরি আছ? এ বিষয়টি মানুষের জীবনেরও বিষয়। কারণ এখানে জীবনই হলো ক্ষমতার সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু। জনগণের জন্য রাজনীতি তাই শেষপর্যন্ত ত্রাস, আতঙ্ক, ভীতির রাজনীতি। মানুষ তাই ব্যস্ত থাকে সম্ভাব্য মৃত্যু, হয়রানি ও প্রতিবন্ধকতা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে।
এখানকার রাজনীতি দলাদলির সর্বগ্রাসী প্রভাব বিস্তার করে আছে। দলাদলি শত্রু-মিত্রের বিভাজনকে একটা নির্দিষ্ট চেহারা দেয়। তাই খাড়াখাড়িভাবে শত্রু-মিত্র, আমরা-ওরা’য় বিভাজিত রাজনীতি এখানে পরিচালিত হয়ে আসছে বৈষম্যমূলক, পক্ষপাতমূলক, অতএব হিংসা ও বিভেদের নীতির মাধ্যমে। এখানে ব্যক্তির বা নাগরিকের অস্তিত্ব সীমিত, খণ্ডিত। হত্যা, বিরোধ, সংঘাতের এই পরিবেশে নাগরিকদের পরস্পরনির্ভরতা সম্ভব নয়। শত্রু-মিত্রের রাজনীতি তা হতেও দেয় না। তাই আমরা বলতে পারি, দলাদলি, শত্রু-মিত্র, হিংস্রতা আমাদের দেশের গণতন্ত্রের এক ক্লোজার সৃষ্টি করেছে।
এখানকার রাজনৈতিক দল ও দলের সমর্থকরা সমাজতাত্ত্বিক দিক থেকে এবং অস্তিত্বের দিক থেকেও নিজেদের কেবল শত্রু-মিত্রের বিভাজনের মাধ্যমেই দেখেন না, তারা মনে করেন তাদের যদি এই পার্থক্য করার ক্ষমতা না থাকে তাহলে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বও বিপন্ন হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ন্যায্যতা তাই রাজনৈতিক আদর্শের লড়াইয়ের মাধ্যমে প্রতিপন্ন হয় না, প্রমাণ হয় সত্যিকারের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। শত্রু-মিত্র বিভাজনের অন্তর্নিহিত এই প্রবণতা রাজনীতিকে এক হিংস্র সংঘর্ষ ও বিরোধে রূপান্তরিত করেছে। আলোচনা, সমঝোতা বা আবেদন এখানে বিরোধ মিটমাটে সক্ষম হয় না।
গত প্রায় চার যুগ ধরে এই ট্র্যাডিশন সমানে চলে আসছে। হুমকি, ভয় প্রদর্শন, সন্ত্রাস সবসময়ই এখানকার শাসক দলের কাছে এক কার্যকর ও শক্তিশালী অস্ত্র। এর অর্থ, গণতান্ত্রিক কাঠামোর মাধ্যমে এমন এক শাসনের প্রবর্তন, যেখানে নাগরিকদের কোনও শাস্তির ভয় ছাড়া হত্যা করা যায়, পঙ্গু করে দেওয়া যায়। রাজনীতি এখানে মানুষের জীবনকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে, মানুষের অস্তিত্ব ক্ষমতার সম্পর্কের কাঙ্ক্ষিত বস্তু হয়ে উঠেছে।
শত্রু-মিত্রের পার্থক্য ও বিভাজন এক অপরিসীম হিংসা ও হিংস্রতার আশঙ্কা তৈরি করে। বিরোধ ও হিংসার আশঙ্কাই আমাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের কাঠামো সৃষ্টি করছে। কেননা, শত্রু-মিত্রের পার্থক্যকে অন্য কোনও পার্থক্য বা ভিন্নতায় পর্যবসিত করা যায় না। ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, জাতিভিত্তিক পার্থক্য তখনই রাজনৈতিক পার্থক্যের রূপ ধারণ করবে, যখন তারা শত্রু-মিত্রের ভেদ উৎপন্ন করবে—এই হলো আজকের আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর বিশ্বাস। সুতরাং এটা কোনও আশ্চর্যের বিষয় নয় যে আজকের বাংলাদেশ এক হিংস্র দেশে পরিণত হয়েছে।
আমাদের রাজনীতি উদারনৈতিক মতবাদের ব্যর্থতা প্রতিপন্ন করে। উদারনীতি শত্রু-মিত্রের পার্থক্যকে মতের পার্থক্য বা অর্থনৈতিক পার্থক্য হিসেবে বুঝতে চায়। উদারনৈতিক ইউটোপিয়া দাবি করে যে সমস্ত বিরোধ যুক্তি ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে শত্রুর সঙ্গে কোনও মিত্রতা চলবে না।
প্রয়োজনে শত্রুকে শেষ করে দিতে হবে, যদি তার সুযোগ অবিলম্বে না আসে, দলের মানুষকে সর্বদা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে, ‘ওই দেখো আমাদের শত্রু’। সুতরাং আমাদের দেশে রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতির বাস্তববাদী মূল্যায়ন বলে, পার্থক্য মুছতে পারে শুধু হিংসার মাধ্যমে। অক্ষম বিচারব্যবস্থা, আজ্ঞাবহ আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ও অনুপস্থিত নাগরিক সমাজ তাই এখানে সৃষ্টি করেছে এমন এক লুম্পেনরাজ, যারা কোনও রকম আইন-কানুনের তোয়াক্কা করে না।
শত্রু-মিত্রের রাজনীতির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বিবদমান গোষ্ঠীর কোনও পক্ষেরই কোনও নৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকে না। এই রাজনীতির একমাত্র নৈতিকতা হলো, শত্রুকে জমি ছাড়লে চলবে না। তাকে শেষ করে দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো। শত্রুর হত্যাই হলো সবচেয়ে বড় নৈতিক কাজ। বিরোধীশূন্য করার প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। দরকারে অদরকারে ভয় দেখিয়ে গুলি করে মেরে ফেলো। এই হলো সত্যিকারের নৈতিক জয়। তোমার শত্রুকে তুমি এক ইঞ্চি জমি ছেড়ে দাওনি।
স্বীকার করে নিতেই হবে, এই হলো আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরম্পরা। মুষ্টিমেয় কিছু রাজনীতিবিদ শয়তানি করছেন এবং মানুষ এটা চান না—এই কথায় চিড়ে ভিজবে না। মানুষ যদি না-ই চান, তাহলে এই পরম্পরা বছরের পর বছর ধরে চলছে কেন? একটি উত্তর হতে পারে, মানুষ ক্ষমতাহীন, দমন-পীড়নে ভীত। তারা উদ্ভিদতুল্য। কিন্তু আমার উত্তর তা নয়। কারণ, ক্ষমতা এভাবে কাজ করে না। সাধারণ জ্ঞান বলে, সর্বব্যাপী ও সর্বগ্রাসী দলাদলির জমানায় এ দেশের মানুষও দলের অনুগত। দলের ভাগ্যের সঙ্গে তার ভাগ্য যুক্ত। এর মধ্যে দল-বদলকারী চতুরেরাও আছেন। কিন্তু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সবাই এই শত্রু-মিত্র ও মারদাঙ্গার রাজনীতির সমর্থক। এই রাজনীতি শুধু হিংসাই সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু সব সময় হিংসার স্ট্র্যাটেজি যে সফল হবে, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। ফলে সবচেয়ে সম্ভাব্য পরিণতি হলো, আরও বেশি হিংসা। হিংসা ফল দেয়, কিন্তু ফল দেয় অনির্দিষ্টভাবে। এটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক।
একটা সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বের মধ্যে এমন কিছু মানুষ ছিলেন, যারা সৎ, আদর্শবান ও আত্মপ্রচারসর্বস্ব না হয়েও মানুষের জন্য দরদি। কিন্তু এখনকার নেতৃত্ব? খুব বেছে বেছে সেই মানুষগুলোকেই সামনে আনা হচ্ছে, যাদের রাজনীতির মূলনীতিই হলো হিংসা। প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যাদের ব্রত। এমনটা না করেও উপায় নেই, মূল নেতৃত্বের রোষের মুখে পড়তে হবে!
মুক্তির উপায় কিছু আছে? মনে হয় নেই। বিশিষ্টজনদের কথা তুলে লাভ নেই, কারণ সমাজ-রাজনীতিতে বিশিষ্টজনদের কোনও ভূমিকা নেই। আমি দোষ দেবো নিজেকেসহ এই দেশের তথাকথিত সচেতন নাগরিকদের অপদার্থতা, ভীরুতা ও মেরুদণ্ডহীনতকে। নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করার কোনও সাহসই আমরা অর্জন করতে পারিনি। বঙ্কিম চন্দ্র একবার বলেছিলেন, ‘বাঙালি শুধু কান্দে আর উচ্ছন্নে যায়’। আজও অবস্থা ঠিক তা-ই। আমাদের চারপাশের আলো ক্রমশ নিভে আসছে!

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/এমএনএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ