X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘১৫ টাকার সিট আর ৩৮ টাকার খাবার’

আহসান কবির
১৫ জুলাই ২০১৮, ১৭:১৪আপডেট : ১৫ জুলাই ২০১৮, ১৭:১৬

আহসান কবির প্রাচীনকালের গল্পে বীরভোগ্যা রাজকুমারী কিংবা বীরপূজারি রাজ্যের দেখা মিলতো। এরপরের কিংবা আধুনিককালের গল্পও কিন্তু এমন। যারা জয়ী হয়, ইতিহাস নাকি তাদেরই মনে রাখে। পরাজিতদের কোনও বন্ধু থাকে না, তাদের কেউ মনে রাখে না! প্রাচীনকালের গল্প শুরু হতো এভাবে—একদেশে ছিল এক রাজা ছিলেন। প্রজাদের সুখ-দুঃখে তিনি পাশে থাকতেন। বর্তমানকালের গল্প শুরু হয় প্রায় একইভাবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘১৫ টাকা সিটভাড়া আর ৩৮ টাকা খাবার। কোথায় আছে পৃথিবী? ১৫ টাকার সিটভাড়া আর ৩৮ টাকার খাবার খেয়ে তারা লাফালাফি করে। তাহলে সিটভাড়া আর খাবারের বাজারদর যা রয়েছে, সেগুলো দিতে হবে তাদের। সেটা তারা দিক।’
আগেরকালেও রাজারা চলতেন প্রজাদের খাজনায়। না পেলে প্রজাদের চাবুকপেটা করতেন। বর্তমানেও দেশ চলে ‘প্রজা’দের ভ্যাট-ট্যাক্সে। বাস্তবতা এই যে, যারা ১৫ টাকার সিটে থেকে ৩৮ টাকার খাবার খান দৈনিক, তারাও ‘প্রজা’দের টাকায়ই খান। সংসদ সদস্য, উপ, পূর্ণমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর বেতনও হয় এই ‘প্রজা’দের টাকায়! তারা অর্ধকোটি টাকার গাড়ি কিংবা প্রায় লাখ টাকার মোবাইল কিনতে পারেন ‘প্রজা’দের টাকাতেই!  কিন্তু কোনোকালের গল্পই এভাবে শুরু হয় না—বাংলাদেশে আবু বকর নামে এক মেধাবী ‘ছোট প্রজা’ ছিল। তার বাবা-মা ছিলেন হত-দরিদ্র ‘প্রজা’। বকরের মা মানুষের বাসায় কাজ করলেও মুরগির ডিম খেতেন না। জমিয়ে বিক্রি করতেন। কখনও চুলে তেল দিতেন না। গাছের নারকেলও বাজারে বিক্রি করে সেই টাকা তুলে দিতেন আবু বকরকে। আবু বকর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারতো। ছাত্রলীগের দুই দলের মারামারি মাঝখানে পড়ে মারা যায় বকর! কোনোকালের গল্পই এভাবে শুরু হয় না যে, ১৫ টাকার সিটে থেকে যারা ৩৮ টাকার খাবার খায়, সেটা তাদের কেউ করুণা করে দেয় না। সেটা তাদের অধিকার। অধিকারের মিছিলে যাওয়ার ফল হাতুড়িপেটা হতে পারে না। অধিকারের মিছিলে যাওয়ার ফল আবু বকরের পরিণতি বরণ করা নয়। মাঝরাতে হল থেকে মেয়েদের বের করে দেওয়া নয়।

দুই.

মেধা কারা যাচাই করে? কীভাবে করে? মেধাবীরাই পৃথিবীর সব? বাংলাদেশে যেভাবে মেধা যাচাই হয়, সেই মানদণ্ডে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা নিউটন, আইনস্টাইনরা যে কী করতেন, সেটা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। মেধাবীরাই যদি সব পাবে, তাহলে প্রতিবন্ধীরা যাবে কোথায়? পরের ঘরে কাজ করে, কৃষিকাজ কিংবা গরু চড়িয়ে আবু বকরের মতো যারা উচ্চশিক্ষা নিতে আসে তাদের কী হবে? কী হবে একেবারে প্রান্তিক অঞ্চলের নারীর? কী হবে পাহাড়ে থাকা মানুষদের? তাদের কি মেধাহীন কোনও অঞ্চলে পাঠিয়ে দেবো আমরা? জানি না, সমাধান আছে কিনা নিচের কবিতায়-

মেধাবীরা আসো

গাইড নিয়ে হাসো

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বেশি ভালোবাসো

মেধাতেই দাও ধার

মেধাহীন চলে যাক নদীর ওপার!

তিন.

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এম আবদুস সোবাহান বলেছেন ‘বাম ঘরানা ও শিবিরের’ কারসাজি। যাকে সংক্ষেপে তিনি বাঁশি উপাধী দিয়েছেন। রোম যখন পুড়ছিল সম্রাট নিরো নাকি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। যারা কোটা সংস্কার আন্দোলন করছেন, তারা বাঁশি বাজাচ্ছেন নাকি ভিসি নিজেই বাজাচ্ছেন বোঝা যাচ্ছে না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তিনি এই ‘বাঁশি’ বলে উপহাস করলেও তার বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছেলেটাকে হাতুড়িপেটা করে নির্মমভাবে আহত করা হয়েছে, তাকে তিনি দেখতে যাননি। দুই ভাঙা পা ও কোমর নিয়ে আহত তরিকুল রাজশাহী মেডিক্যালে ভর্তি হলেও মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে পুরোপুরি চিকিৎসা না দিয়ে তড়িঘড়ি করে রিলিজ করে দিয়েছে। তরিকুলকে ঢাকা আনা হয়েছে চিকিৎসার জন্য। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যারা জড়িত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনে হামলার অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে কিন্তু যারা তরিকুলকে হাতুড়িপেটা করেছে তারা ‘মুক্তপ্রজা’ হিসেবেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।

জোহা স্যারের সমাধি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরম মমতায় তিনি ছাত্রদের আগলে রাখতেন, বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে শেখাতেন পাকিস্তানি হায়েনাদের রাইফেলের সামনে! জোহা স্যারের ক্যাম্পাসে জোহা চত্বরে নগ্নপায়ে একজন শিক্ষক (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি কিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফরিদ খান) নীরবতা পালন করতে চেয়েছিলেন। প্রক্টর সাহেব তাতে বাধা দিয়েছেন। তারপরও সেই শিক্ষক কোটা সংস্কার যারা চাচ্ছে, সেসব ছাত্রের কথা পরম মমতা নিয়ে বিবেচনা করতে বলেছেন। যারা ‘১৫ টাকার সিটে থেকে ৩৮ টাকার খাবার’ খেয়ে বড় হচ্ছে, ভিসি আবদুস সোবাহান কিংবা ফরিদ খান তাদেরই মতো ছিলেন কোনও একসময়ে। হয়তো তখন এই ব্যয় বর্তমানের মতো ছিল না।  

আসলে কে, কখন কীভাবে বদলে যাবে কেউ জানে না। বিপ্লবের ভেতরে তাই আজীবন বাস করে প্রতিবিপ্লবের বীজ। স্বাধীনতার পর দেখা গেলো যারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন তাদের বেশিরভাগই সাধারণ মানুষ, যারা অনেক ক্ষেত্রেই ছিলেন পিছিয়েপড়া। এসব মানুষের দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত করার জন্যই মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ ক্রমশ নারী, প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী কোটার প্রচলন করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর এই কোটাও বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন। আজ  কোটা সংস্কার আন্দোলন আর ছাত্রলীগের হাতুড়িপেটা কিংবা ভিসিদ্বয়ের ‘বাঁশি’ কিংবা ‘জঙ্গি’ কার্যক্রমের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা’। নারী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আর প্রতিবন্ধী কোটা নিয়ে তেমন বিতর্ক ওঠেনি। সরকারের কারও কারও কাছে এটা অবিশ্বাস্য হলেও এই কোটা সংস্কার আন্দোলন জনপ্রিয়তা পেয়েছে কোনও সন্দেহ নেই। নতুন অনেকের কাছে হয়তো কোটা সংস্কার আন্দোলন বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রাথমিক শর্ত। হয়তো অনেক তরুণের স্বপ্ন এটা, যা হাতুড়িপেটা করে দমানো যাবে না। বিরোধী মতকে কখনও নির্মমভাবে দমন করা যায় না। তবে যে প্রান্তিক ও পিছিয়েপড়া মানুষ স্বাধীনতা এনেছিল, কোটার মাধ্যমে তাদের কতটা প্রতিদান দিতে পেরেছে রাষ্ট্র? আরও কতটা দিলে নির্দিষ্টভাবে দেওয়া হবে তাদের? সেই হিসাব কেউ করেনি, কেউ জানতেও চায়নি।

চার.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান কোটা সংস্কার আন্দোলনে জড়িত ছেলেদের কার্যক্রমকে ‘জঙ্গি’দের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ২০জন ছাত্রীকে মাঝরাতে হল থেকে বের করে দেওয়াটা খারাপ না, কোটাবিরোধী মিছিল মিটিংয়ের কার্যক্রমটাই ‘জঙ্গি সমর্থক’। আমরা এই ভেবে আনন্দিত হতে পারি যে, তিনি সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদের ক্রসফায়ারে নিতে বলেননি। সম্ভবত হাতুড়িপেটাই তাদের প্রথম বিচার। তার বাসভবনে হামলা হয়েছিল। তার বাসার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ হামলাকারীরা নিয়ে গেছে। কীভাবে সম্ভব? পুলিশও হামলার সময়ে ধারে কাছে ছিল। তারা ওই সময়ে কাউকে গ্রেফতার করতে পারলো না? এছাড়া নাকি আশেপাশে দুই একটা (বিশেষ করে ব্রিটিশ কাউন্সিলে) সিসি ক্যামেরা ছিল। সেসব ক্যামেরার ফুটেজ দেখে এই পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা গেলো না? নাকি এই ঘটনার পেছনে অন্য কোনও ষড়যন্ত্র আছে?

পাঁচ.

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পক্ষ নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য তার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। বহুদিন পরে এসে মনে হয় তিনি ওই সময়ের ‘১৫ টাকার সিট আর ৩৮ টাকার খাবারে’র পক্ষে ছিলেন। চাষাভুষার ছেলেরা যেন খুব সামান্য খরচে পড়ালেখা করতে পারে, তিনি তেমনই চেয়েছিলেন। ছয়দফা ঘোষণার পর সারাদেশে সেটা তুমুল জনপ্রিয় হলে ওই সময়ের আইয়ুব-মোনায়েমের সংগঠন এনএসএফের পান্ডারা (ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অস্ত্রের আমদানি করেছিল। ভয় দেখানো আর সন্ত্রাসের মাধ্যমে তারা স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল বিরোধী মতকে। সাধারণ ছাত্ররা এর প্রতিবাদে ক্রমশ স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল, স্বাধীনতার অন্যতম শক্তি ছিল এই ছাত্ররাই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের অগণিত সদস্য ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের একেবারে সামনের কাতারে।

আওয়ামী লীগ কিংবা ছাত্রলীগ জলে ভাসা শ্যাওলা কিংবা পদ্মফুলও নয়। দীর্ঘ ঐতিহ্য আর উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতার ফসল আজকের আওয়ামী লীগ। তারপরও আবু বকর কিংবা বিশ্বজিৎ মরে যায় ছাত্রলীগের সংঘর্ষের কারণেই। হাতুড়িপেটা থেকে শুরু করে আরও অনেক বদনাম তৈরি করে ছাত্রলীগ কিংবা যুবলীগ।

অভিমান করে হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা সংস্কারের পক্ষেই আছেন। তিনি সব কোটা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এখন শোনা যাচ্ছে আদালতের কথা। আদালতের রায়ের পরে প্রধানমন্ত্রীর করে দেওয়া কমিটি কী মত দেয়, সেটাই দেখার ব্যাপার।

এদেশটা সবার। মুক্তিযোদ্ধা, প্রান্তিক নারী, পাহাড়ি কিংবা প্রতিবন্ধী—সবার। যারা ‘১৫ টাকার সিটে থেকে ৩৮ টাকার খাবার খায়’ তাদের কিংবা যারা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে লাখ টাকা খরচ করে পড়ে, এই দেশ তাদেরও। সেই সঙ্গে মেধাবীরাই পারে দেশটাকে বদলে দিতে। কেউ বাংলাদেশের বাইরের নন। আর সে কারণেই কামনা:

দেশ ছেয়ে যাক মেধাবী শিশিরের লক্ষ লক্ষ ফোঁটায়

হৃদয় খুঁড়ে তবু বেদনাও জাগুক জীবনানন্দের কোটায়!

লেখক: রম্যলেখক

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতায় কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন
কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতায় কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ