X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রতিদিনকার নিপীড়ন আর নিতে পারছি না…

জোবাইদা নাসরীন
১৬ জুলাই ২০১৮, ১৫:২১আপডেট : ১৬ জুলাই ২০১৮, ১৯:৪০

জোবাইদা নাসরীন প্রায় প্রতিদিনই এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আলোচনায়। কারণ, প্রতিদিনই এই ক্যাম্পাসে ঘটছে নিপীড়নের ঘটনা। নিপীড়িত যে শুধু শিক্ষার্থীরা হচ্ছেন তা নয়, নিপীড়িত হচ্ছেন শিক্ষকরাও। এই নিপীড়নের পরিসর এখন যে শুধু লাইব্রেরি বা মধুর ক্যান্টিন তা নয়, এটি ছড়িয়ে পড়েছে শহীদ মিনারেও।
আমাদের ১০ জন ছাত্র গ্রেফতার হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে হামলার প্রতিবাদ ও গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন বিভাগে চলছে ক্লাস বর্জন এবং প্রতিবাদ। শিক্ষার্থীরা জানিয়ে দিয়েছে তাদের সহপাঠীদের মুক্তি ছাড়া ক্লাস করবে না। এই দাবিতে গত রবিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল। আমরা দেখলাম সেখানে কর্মসূচির একপর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করলে তাদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ। এ সময় শিক্ষকদের সঙ্গে ছাত্রলীগ মারমুখী আচরণ এবং অনেক শিক্ষার্থীকে মারধর করে। শিক্ষককে হাত উঠিয়ে শাসানোর ছবি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ছবিটি ফেসবুকেও লজ্জার স্মারক হয়ে ঘুরছে। পরে  শিক্ষার্থীদের ধাওয়া ও ধাক্কা দিয়ে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয় ছাত্রলীগ। পরে দুইজন সহকারী প্রক্টরের মধ্যস্থতায়  শিক্ষকরা  উদ্ধার হন এবং পরবর্তীতে তারা কেউ কেউ শিক্ষকদের বাসা পর্যন্ত অনুসরণ  করে এবং গালিগালাজ অব্যাহত রাখে। আমরা যারা ক্রমাগত লিখে যাচ্ছি তাদের প্রতিনিয়তই গালিগালাজপূর্ণ মেইল পাঠানো হচ্ছে, হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘ওই ঘটনায় ছাত্রলীগ নামধারী কেউ আছে কিনা, সেই বিষয়টি পরিষ্কার হতে হবে’। তিনি আরও বলেছেন, ছাত্রলীগের এখনও নতুন কমিটি হয়নি। এটি বলার মধ্য দিয়ে তিনি ছাত্রলীগকে এই ঘটনা থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন এবং এই হামলার দায় অন্য কারও কাঁধে চাপাতে চাইছেন বলেই ধরে নেওয়া যায়। রাজনীতিবিদদের এই ধরনের বক্তব্য আসলে  এসব ঘটনাকে আরও উসকে দেয়। কারণ, হামলাকারীরা জানে এবং আরও দৃঢ়ভাবে জেনে যায় যে এই ধরনের হামলা করেও দল থেকে এবং প্রশাসন থেকে কোনও ধরনের শাস্তি তাদের দেওয়া হবে না।

ক্যাম্পাসে কোথায় নিরাপদ? শিক্ষার্থীরা নিরাপদ নয়, লাইব্রেরির সামনে, মূল চত্বরে, টিএসসিতে কিংবা শহীদ মিনারে। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই এই শহীদ মিনারের রাজনৈতিক কারিগর। তখন শিক্ষার্থীরাই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ'র বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল।  এই ক্যাম্পাসেই জন্ম হয়েছে গণতন্ত্রের। এমনকি ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে নিপীড়নের বিরুদ্ধে এই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী-শিক্ষকেরা গর্জে উঠেছিলেন, জেল খেটেছেন। সেই ক্যাম্পাসে আজ প্রতিবাদের একটুও জায়গা নেই। প্রশাসনও দোষ চাপাচ্ছে আন্দোলনকারী এবং আন্দোলনে সমর্থন দেওয়া শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের  ওপর। প্রশাসন বলছে কেন অনুমতি না নিয়ে লাইব্রেরির সামনে কর্মসূচি দেওয়া হলো। শিক্ষকরা যে শহীদ মিনার যাবেন সেটা কি প্রশাসনকে জানিয়েছিলন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিনই নানা ধরনের মিটিং, মিছিল হয়– এটির জন্য কখনও কোনও ধরনের অনুমতির দরকার, এই প্রথম শোনা গেলো, জানা হলো।

নিপীড়ন প্রতিনিয়তই চলছে। গত শনিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল চত্বরে এক ছাত্র ও ছাত্রীকে পিটিয়ে আহত করেছেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। হামলাকারীদের শনাক্ত করতে ভুক্তভোগী দুই শিক্ষার্থী সূর্যসেন হলে গেলে সেখানেও তাদের দ্বিতীয় দফায় পেটানো হয়। মারধরে ছাত্রীর পায়ের নখ উঠে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই দুই শিক্ষার্থী বিকেলে মূল চত্বরে হাত ধরে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজছিলেন। এমন সময় সূর্যসেন হলের ১০ থেকে ১২ জন ছাত্রলীগ কর্মী তাদের ঘিরে ধরে পরিচয় জানতে চান। তারা নিজেদের পরিচয়পত্র দেখান। ওই ছাত্র পরিচয় জানতে চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে ছাত্রলীগ কর্মীরা তাকে মারধর শুরু করেন। ছাত্রীটি তাকে রক্ষা করতে গেলে তিনিও আহত হন। এই দুই শিক্ষার্থী দুই দফা আক্রমণের শিকার হয়েছে। ছাত্রীটি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের আবাসিক ছাত্রী, আমি এই হলের আবাসিক শিক্ষক। রাত সাড়ে দশটায় আমি ঘটনাটি জানতে পারি। আক্রমণকারীরা বাজে কথা কথা ছড়াচ্ছে ওই শিক্ষার্থী দুজন ‘আপত্তিকর’ অবস্থায় ছিল। ক্যাম্পাসে কে কোন অবস্থায় থাকবে সেটার নজরদারি করার দায়িত্ব ছাত্রলীগকে কে দিলো? ছাত্রলীগ কি ক্যাম্পাসের প্রতিটি  ইঞ্চি জায়গা দেখভালের ইজারা নিয়েছে?

এ ঘটনায় হালকা নড়াচড়া করেছে প্রশাসন। প্রক্টর গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজ, গণমাধ্যমের খবর পরীক্ষা এবং ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের তথ্যের ভিত্তিতে এই তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তিন দিনের মধ্যে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেবে। এরপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে’।

তবে এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছেন কয়েকজন আইনজীবী। পত্রিকার প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী ছাত্রলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা জানাতে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের ১৩ জন আইনজীবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থী ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর পক্ষে  রেজিস্ট্রি ডাকযোগে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর ও রেজিস্ট্রার বরাবরে আলাদাভাবে ওই নোটিশ পাঠানো হয়। নোটিশে ৩০ জুন ও ১ জুলাইয়ের হামলার ঘটনায় কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে। ব্যর্থ হলে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও এতে বলা হয়েছে।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন কতটা সরকারি তা বোঝা যায় এই কোটা আন্দোলন নিয়ে তাদের সরকারমুখী পদক্ষেপ দেখে। গতকালই  কোটা সংস্কার নিয়ে নানা লেখালেখির জন্য এক ছাত্রকে সাময়িক বহিষ্কার করেছেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ওই শিক্ষার্থীর নাম মীর মোহাম্মদ জুনায়েদ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। এ বিষয়ে আরও তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

 আমাদের স্পষ্ট কথা, আমরা নিপীড়নমুখী বিশ্ববিদ্যালয় কোনোভাবেই আর নিতে পারছি না।  ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে অতি দ্রুতই এগিয়ে আসতে হবে। আন্দোলনকারী এবং গ্রেফতারকৃত শিক্ষার্থীরা সবাই আমাদের শিক্ষার্থী। এদের দায়িত্ব আমাদের। দিনশেষে আমরা তাদের শিক্ষক, তাই তো তারা শিক্ষককে জাপটে ধরে হামলাকারীদের আঘাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে চায়। মনে রাখতে হবে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে মতাদর্শিক এই পরাজয়  আমাদের শিক্ষাখাতের বড় পরাজয়ই।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ