X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

একাদশ সংসদ নির্বাচন বিএনপির জন্য সওগাত

আনিস আলমগীর
১৭ জুলাই ২০১৮, ১৪:১৩আপডেট : ১৭ জুলাই ২০১৮, ১৪:১৭

আনিস আলমগীর আগামী ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে হতে যাচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে দুটি প্রশ্ন ঘুরছে– আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় থাকবে এবং বিএনপি কি নির্বাচনে আসবে শেষ পর্যন্ত। এর আগে আগামী ৩০ জুলাই ২০১৮ তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। ইতোমধ্যে খুলনা এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে এই নির্বাচনগুলোরও গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, বড় বড় শহরের মানুষের মতামতই শেষ পর্যন্ত গোটা জাতি অনুসরণ করে।
আওয়ামী লীগ টানা দশ বছর ক্ষমতায়। সুতরাং, জাতীয় নির্বাচনে অ্যান্টি ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টরের ভয়ে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করে পা বাড়াচ্ছে তারা। উইনস্টন চার্চিলের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিজয়ী ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত যুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন। তখন সবাই বলেছিলেন অ্যান্টি ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টরের কারণে নাকি চার্চিলেন রক্ষণশীন দল পরাজিত হয়েছিল।
টানা ক্ষমতা অনেক সময় ভোটাররা পছন্দ করেন না। গত শতাব্দীর নয় দশক থেকে আমরা দেখছি, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আওয়ামী লীগ, বিএনপির মাঝেই হাতবদল হচ্ছে। একাদশ নির্বাচনেও এই দুই দল প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি। অ্যান্টি ইনকামবেন্সির যেমন নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া আছে তেমনি উন্নয়নের ধারাবাহিকতার প্রশ্নে পজেটিভ দিকও রয়েছে। চীন, রাশিয়া এবং তুরস্কের মানুষ বারবার এক নেতাকেই ক্ষমতায় আনছে– দেশের উন্নয়নের স্বার্থে। এমনকি শাসনতন্ত্র সংশোধন করা হচ্ছে এক নেতার জন্য।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই ধারাবাহিকতার জন্য শেখ হাসিনাকে মাহাথির মোহাম্মদ হতে বলেন অনেকে। বিরোধীদের শক্তহাতে দমন করে উন্নয়নের লক্ষ বাস্তবায়ন। কিন্তু মালয়েশিয়ার উন্নয়নের পাশাপাশি মাহাথির দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন তার কারণেই বিদায় নেওয়ার পরও তাকে জাতি ফিরিয়ে এনেছে। আবার এসেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি আবার জেহাদ চালাচ্ছেন। সেটি কি বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে? শুনছি আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ চালু হবে। দেখা যাক কতটা জেহাদ শেখ হাসিনা করতে পারেন নিজ দলের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে, আর ফিরে আসার জন্য আওয়ামী লীগের নির্বাচনি কৌশল কী হয়।  

অন্যদিকে, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার এক দুর্নীতি মামলায় ৫ বছর জেল হয়েছে। বর্তমানে তিনি জেলেই আছেন। আবার দলের দ্বিতীয় ক্ষমতাশালী নেতা তারেক রহমান, যিনি খালেদা জিয়ার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন, তিনিও দেশে নেই। তিনি দীর্ঘ ১০ বছরব্যাপী ব্রিটেনে অবস্থান করছেন। তারও ১৭ বছরের জেল হয়েছে। দেশে থাকলে হয়তো তিনিও জেলেই থাকতেন। তাদের দুজনের বিরুদ্ধে বহু মামলা রয়েছে।

গ্রেনেড হামলা মামলার রায় হবে আগামী মাসে। সে মামলায় তারেক জিয়াও আসামি। শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ২০০৪ সালের নিক্ষিপ্ত গ্রেনেডে ভাগ্যের ফেরে শেখ হাসিনা বেঁচে গেলেও আইভি রহমানসহ ২৪ জন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী নিহত হয়েছিলেন। সুতরাং সে মামলার রায়ে অনেকের ফাঁসির হুকুম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তাই শুনতে অপ্রিয় হলেও বলতে হয়, বিএনপির অবস্থা এখন ভালো নয়। স্থায়ী কমিটির নেতারা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, তারেক জিয়ার পরামর্শে দল পরিচালনা করছেন। পাঁচ মাস হয়ে গেলো বেগম জিয়া জেলে, কিন্তু তার মুক্তির জন্য কোনও আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি বিএনপি। অবশ্য আন্দোলন গড়ে তোলার মতো কোনও সাহসী ক্যারিশমেটিক নেতাও বিএনপিতে নেই। মওদুদ সাহেব তার ভাইয়ের নামে খাড়া দলিলে গুলশানে বাড়ি ক্রয় করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত দলিলের অভ্রান্ততা প্রমাণিত না হওয়ায় তিনি বাড়ির অধিকার হারিয়েছেন। এমন নানা কারণে বিএনপি নেতাদের ক্রেডিবিলিটি ক্রাইসিস রয়েছে। তারপরও মনে রাখতে হবে দেশের রাজনীতি এ দুই দলকে ঘিরেই আবর্তিত হয়।

বিএনপি বলছে, (১) তাদের নেত্রীকে মুক্তি না দিলে, (২) নিরপেক্ষ সরকার না হলে, (৩) নির্বাচনের পূর্বে সংসদ ভেঙে না দিলে, আর (৪) নির্বাচনের সময় ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী নিয়োগ না করলে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। আবার আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যে যার দায়িত্বে নির্বাচনে আসবে। না আসলেও নির্বাচন কারও অপেক্ষায় বসে থাকবে না।

বিএনপি যদিওবা শর্তসাপেক্ষে নির্বাচনে যোগদানের কথা বলছে, তবে আমরা বাইর থেকে লক্ষ করেছি তারা একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এবং সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করছে। খুলনা এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তারা কারচুপির কথা বলছেন। তবে ব্যাপক কোনও কারচুপি হয়েছে বলা যাবে না। অনুন্নত দেশের স্থানীয় নির্বাচনে যেসব জোরজবরদস্তি, অনিয়ম হয় তা-ই হয়েছে। যেসব কেন্দ্রে কারচুপির চেষ্টা করা হয়েছে তা নির্বাচন কমিশন স্থগিত করে দিয়েছে।

আমাদের একশ্রেণির সুশীল সমাজ, সুজন নামক এনজিওটা আর দুটি প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা ‘ধুম করে তাল পড়েছে না তাল পড়ে ধুম করেছে’ অনুরূপ অহেতুক কথার বিতর্ক সৃষ্টি করে নির্বাচনকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করে এবং জাতির মাঝে অহেতুক বিবাদ জিইয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালায়। নির্বাচন নিয়ে ভারতে গিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের দৌড়ঝাঁপও লক্ষণীয়। আমরা যদি তাদের আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য ডেকে আনি তাহলে তো ধীরে ধীরে আমাদের বিষয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে হস্তক্ষেপ করার একটা অভ্যাস জন্ম নিতে পারে ভারতের। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য শেষ পর্যন্ত হয়তো হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। আওয়ামী লীগ বিএনপি উভয় দলের উচিত ঘরোয়া বিষয়ে ভারতকে ডেকে আনার অভ্যাস ত্যাগ করা।

আমেরিকার রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটও কথা বলা শুরু করেছেন। তার আফসোসের সীমা নেই গাজীপুরের নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ে। তার নিজের চরকায় তেল দেওয়া উচিত। এখন তো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়েছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের পক্ষে রাশিয়া কাজ করেছে। এফবিআই এমনও ইঙ্গিত করেছে রাশিয়া অঢেল অর্থ ব্যয়ও করেছে।

আমরা ভুলিনি চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দে আর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে তো তারাই হত্যা করেছিল। সেনাবাহিনীকে বাগে আনতে না পেরে সেনাবাহিনীর বিচ্ছিন্ন একটা অংশকে কাজে লাগিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল। ফলে বার্নিকাটরা বেশি কথা বললে আমরা আতঙ্কিত হই।

ক্ষমতাসীন পিতার ওরসে বিএনপির জন্ম। তাই ক্ষমতার জন্য তার হা-হুতাশ বেশি। কিন্তু মাঝে মাঝে রাজনীতিতে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। দীর্ঘ ২১ বছর পথে পথে ঘুরে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেছে। বিএনপি ক্ষমতার বাইরে রয়েছে মাত্র ১২ বছর। জাতি দেখেছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় পুরানা পল্টনের অফিসে আমেনা বেগম মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে থাকতেন। মফস্বল সফরে গেলে অফিস খোলার লোক থাকত না। মাওলানা ভাসানী, শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ করতে গিয়ে দু’ আনার মুড়ি খেয়েও দিন কাটিয়েছেন।

বিএনপির জন্যও এমন কঠিন সময় সম্ভবত উপস্থিত হয়েছে। বেগম জিয়া যদি সরকারের সঙ্গে সমঝোতা না করেন তবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বিএনপিকে লড়াই করে ময়দানে থাকতে হবে। সে কারণে আমি বলবো, আগামী নির্বাচন তাদের জন্য সওগাত হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। এ নির্বাচনে যদি তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ক্ষমতায় যেতে নাও পারে তবে যারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন তারা সংসদে সক্রিয় থাকলেই দল টিকে যাবে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা নিয়ে বিএনপির কোনও বিতর্ক থাকা উচিত নয়। এমনকি সবক’টি সিটি করপোরেশনে হারলেও বিএনপির ২০১৪ সালের মতো ভুল করা উচিত না।

আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে, বিএনপি দুধে ধোয়া তুলসি পাতা নয় যে নির্বাচনে তারা না এলে জনগণের কিছু আসবে যাবে। জনগণ এক দলের প্রতি বিরক্ত হয়ে আরেক দলকে পছন্দ করে বলেই বিএনপি এখনও আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী। নীতি আদর্শে বিএনপি উত্তম কেউ সেটা প্রমাণ পায়নি। ক্ষমতায় গেলে লুটপাট আর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা বিএনপির পুরনো অভ্যাস। সবেচয়ে বড় কথা, বিএনপি ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে অন্যকে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে এই নজিরও নেই। ফলে আওয়ামী লীগ সাজানো নির্বাচন করে আবার ক্ষমতায় আসতে চায়, তাই নির্বাচন বর্জন করবো- এই তত্ত্ব ধোপে টিকবে না। বিএনপি এখনও মাঠে টিকে আছে, কারণ আওয়ামী লীগের অন্য কোনও শক্তিশালী বিকল্প নেই। আর বিএনপি যদি চোখের সামনে থেকে বারবার সরে যায়, বিকল্প খোঁজা বিচিত্র নয়।

বিএনপি অন্যদের থেকে এমন কোনও মূল্যবান প্রার্থী দেবে না যে জনগণ আফসোস করবে তাদের প্রার্থীর জন্য। কারণ, শুধু রাজনৈতিক দল নয়, পেশাজীবীদের সংগঠন, যেমন- ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, সাংবাদিক- সব ধরনের নির্বাচনে এখন দু’চারজন প্রার্থীর কথা বাদ দিলে যোগ্য, সৎ কাউকে খুঁজে পায় না ভোটাররা। খুঁজে যাদের পায় তারা আবার বৃহৎ দুর্বৃত্তচক্রে নেই বলে ভোটে জেতারও সম্ভাবনা থাকে না। ফলে ভোটাররা ভোট দিতে গিয়ে এখন সম্ভাব্য বিজয়ী প্রার্থীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম দুর্বৃত্ত কোনটা তাকে খোঁজে, যাকে বলে ‘লেসার ইভিল’ খোঁজা।

লেখক: সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিষয় বিশ্লেষক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে: জাতিসংঘ
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে: জাতিসংঘ
ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধে কোন কোন খাবার এড়িয়ে চলবেন?
বিশ্ব যকৃৎ দিবসফ্যাটি লিভার প্রতিরোধে কোন কোন খাবার এড়িয়ে চলবেন?
শিশু হাসপাতালে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না: ফায়ার সার্ভিস
শিশু হাসপাতালে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না: ফায়ার সার্ভিস
ভোট দিতে এসে কেউ উৎফুল্ল, অনেকেই ক্ষুব্ধ!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনভোট দিতে এসে কেউ উৎফুল্ল, অনেকেই ক্ষুব্ধ!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ