X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘সোনামুখী সম্পর্ক’: দ্বিতীয় পর্ব

আহসান কবির
২১ জুলাই ২০১৮, ১৬:৫০আপডেট : ২১ জুলাই ২০১৮, ১৬:৫৭

আহসান কবির বছর খানেক আগে সোনা বিষয়ক একটা লেখা লিখেছিলাম যার শিরোনাম ছিল ‘সোনামুখী সম্পর্ক’। আবারও সোনা নিয়ে লিখতে হচ্ছে। কী নাম দেবো এই লেখার? তাই ঠিক করলাম, ‘সোনামুখী সম্পর্ক': দ্বিতীয় পর্ব।
যাই হোক, সোনাবিষয়ক এই লেখাটা এক-দুইটা কৌতুক দিয়ে শুরু করা যেতো। শুরু করা যাচ্ছে না। কেন যেন সোনাবিষয়ক কৌতুকগুলো সব জায়গায় উপস্থাপনযোগ্য না। তাই গান দিয়ে শুরু করি।
‘সব সখীরে পার করিতে নেবো আনা আনা
তোমার বেলায় নেবো সখী তোমার কানের সোনা’।

বাংলা ছবির এই জনপ্রিয় গানটি হয়তো অনেকেই শুনেছেন। সোনা নিয়ে আসলে বাঙালির আদিখ্যেতার অন্ত নেই। বাংলা গানই তার প্রমাণ। যেমন—‘আমার সোনার ময়না পাখি/কোন দেশেতে গেলা উইড়া রে/ দিয়া মোরে ফাঁকি রে’। কিংবা ‘সোনাবন্ধে আমারে দিওয়ানা বানাইলো’। অথবা ‘আমার সোনাবন্ধুরে তুমি কোথায় রইলারে!’ সোনা বন্ধু বা সোনাবন্ধের মতো প্রেমে বিস্তর আছে সোনার মিশেল। যেমন, ‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না/ তার সঙ্গে নাই লেনাদেনা/ খাঁটি সোনা ছাড়িয়া যে নেয় নকল সোনা!’ বাংলাদেশ ব্যাংকও সম্ভবত প্রেমহীনতায় ভুগছে। তাদের সংগ্রহশালায় তাই নাকি নকল সোনার ছড়াছড়ি।

পুরনো এক লেখায় লিখেছিলাম দেশপ্রেমেও সোনা প্রসঙ্গটা কেমন করে যেন ঘুরেফিরে আসে। বাংলাদেশের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই সোনার ব্যাপারটা আষ্ঠেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিল। স্বাধীনতাকামী কোটি মানুষের স্লোগান ছিল—‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন আইয়ুব শাহী জবাব চাই’। পরে অবশ্য এই জবাব ইয়াহিয়া খানের কাছেও চাওয়া হয়েছিল। পাকিস্তানি নিষ্ঠুর একনায়ক, খুনি আইয়ুব ও ইয়াহিয়া সম্ভবত খাঁটি সোনা কী জিনিস, সেটা বুঝে উঠতে পারেনি, যেমন বুঝতে পেরেছিল স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা। স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা রক্ত দিয়েছে, শহীদ হয়েছে, যুদ্ধের পরীক্ষায় ক্রমশ উত্তীর্ণ হয়ে এদেশের মানুষ পুড়ে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়ে দেশটাকে স্বাধীন করেছে। এ কারণেই এইদেশের জাতীয় সঙ্গীত হচ্ছে—‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। দেশের গানে সোনা অনেক সুন্দর একটা জায়গা দখল করে আছে। দেশের গান আছে এমন—‘সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা, সোনা নয় তত খাঁটি! বাংলার মাটি নাকি সোনার চেয়েও খাঁটি।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংগ্রহশালা কাম ভল্টে সোনার পরিবর্তে অন্য ধাতু না দিয়ে মাটি রেখে দিলেও ভালো হতো। কারণ বাংলার মাটি তো সোনার চেয়েও খাঁটি।

বাংলাদেশে জায়গার নাম আছে সোনাপুর। গাইবান্ধায় একটা জায়গার নাম আছে ডাকুনি সোনাপাড়া। খুলনায় সোনাপোতা নামেও একটা জায়গা আছে। জানি না, এই এলাকার মাটির নিচে কোনোদিন সোনাপোতা ছিল কিনা। তবে এর পাশের জায়গাটার নাম হচ্ছে ময়লাপোতা। পশ্চিমবঙ্গেও সোনাখালী নামে একটা জায়গা রয়েছে। এদেশে বহু মানুষের নাম আছে সোনা মিঞা। বাংলা লোককথায় ‘সোনাই’ নামটা একটা জনপ্রিয় নাম। ছোট্ট বাচ্চাদের সোনামনি জাদুমনি নামে ডাকার রেওয়াজ আজও  আছে।

তবে বাংলার মাটি সোনার চেয়ে খাঁটি হলেও সোনার বাংলায় সোনার ব্যাপারটা শুরু থেকেই জটিল। তাই বৈধভাবে কেউ নাকি এদেশে সোনা আমদানি করে না। এদেশে প্রায়ই চোরাচালানকৃত সোনা ধরা পড়ে এয়ারপোর্টে, মনে হয় এয়ারপোর্টটাই সোনারখনি। পরে জব্দ করা সোনা নিয়ে মামলা হয়। এরপর এইসব সোনা রাখা হয় বাংলাদেশে ব্যাংকে। সোনা যে ভল্টে রাখা হয়, তার নিরাপত্তাটাই নাকি অন্যরকম!

সত্তর জনের একটা পুলিশ কন্টিনজেন্ট নাকি পাহারা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট। মোট ছয়স্তরের নিরাপত্তা ও গেট কিপিং আছে ভল্টের পাহারায়। শুরুতে পা কার্ড দিয়ে আপনি প্রথম গেটটায় ঢুকতে পারবেন। এরপর আপনাকে তুমুলভাবে দেহতল্লাশি করা হবে।এরপর তিন দরজার চোখ রাঙানি। সর্বশেষ গেট দিয়ে ভল্টে ঢুকলেও ভল্টের আলাদা ও আলমারি বা লকারের চাবি আলাদা। এই চাবি আবার পালা করে দুজনে পাহারা দেয়। এছাড়া শুরু থেকে সিসি ক্যামেরা তো আছেই। বাংলাদেশ ব্যাকের ভল্টের নিরাপত্তার ব্যাপারটা যেন রূপকথার সেই গল্পের মতো। রাক্ষস মারতে হবে। কিন্তু তার প্রাণ ভোমরা সাত সমুদ্দুর তের নদীর শেষের আরেক নদী ও সমুদ্রের মোহনার নিচে থাকে। সেই মোহনার জলের ভেতর এক রাজপ্রাসাদ। হাজারো প্রহরী সেটা পাহারা দেয়। তাদের হত্যা করে যেতে হয় রাজপ্রাসাদের কোষাগারে। সেখানেও হাজার প্রহরী। তাদের হত্যা করে ডুব দিতে হবে হাজার ফিট। পাতালপুরীর এক খাঁচায় পাওয়া যাবে ভুতুম পেঁচা। তাকে হত্যা করে বের করে আনতে হবে প্রাণ ভোমরা। তাকে মেরে ফেলতে হবে, প্রয়োজনে আগুনে পোড়াতে হবে। তাহলেই মারা যাবে রাক্ষস।

এতকিছুর পরেও শেষমেষ ভল্টে কীভাবে ঘটে গেলো ভুতুড়ে কাণ্ড?

২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত জব্দ করা সোনার বার ও গহনা জমা পড়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর দৈবচয়ন ভিত্তিতে ভল্টে রক্ষিত সোনা পরীক্ষা করে দেখতে পায়, ছিল সোনার চাকতি, হয়ে গেছে মিশ্র ধাতু! (ইস কী বোকা। সোনার চেয়ে খাঁটি বাংলার মাটি রেখে দিলেও এর চেয়ে ভালো হতো)। ২২ ক্যারেট সোনা হয়ে গেছে ১৮ ক্যারেট। এই সোনা বিক্রি করলে সরকারের ক্ষতি হবে কোটি কোটি টাকা। অথচ জব্দ করে যখন জমা দেওয়া হয়, তখন কিন্তু ঠিকঠাক সোনাই ছিল। এরপর ফুঁসমন্তরে হয়ে গেলো অন্যকিছু। যদিও এই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর তোলপাড় হয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থপ্রতিমন্ত্রীর কল্যাণে জানা যায়, ওজন ঠিক আছে। কেরানির ভুলের জন্য নাকি বাংলা চার এর জায়গায় ইংরেজি আট বসেছে। এরপর আরও জানা গেলো এই সোনা নাকি আদৌ পরিবর্তন করা সম্ভব না। কারণ ক্যাশ ম্যানেজার, ক্যাশ ও কারেন্সি অফিসার এবং জয়েন্ট ম্যানেজার বুলিয়ান (স্বর্ণ) ছাড়া কেউ এই ভল্টে ঢুকতে পারে না। নেতা, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, গভর্নর, ব্যাংকের জিএম, ডিজিএম যখন ভল্টে ঢোকার সুযোগ ও অধিকার পান না, তখন সোনা সরানো অসম্ভব। যে পত্রিকায় রিপোর্ট বেরিয়েছে, সব নাকি তাদের কারসাজি। ঘটনা এমন হলেও ভালো হতো। সরকারেরই নিযুক্ত শুল্ক ও গোয়েন্দা এবং তদন্ত শাখার লোকজন পরে অবশ্য বলে দিয়েছে, যে যে যাই বলুক তাদের রিপোর্টই ঠিক! তাহলে এখন? সত্যি সত্যি কি ছিল সোনা? হয়ে গেলো অন্য ধাতু? নাকি চার ইংরেজি আট হইয়া গেছে করনিকদের কল্যাণে?

যাই ঘটুক, প্রিয় পাঠক একটা রেফারেন্স দিতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ এর আগে ব্যাংক থেকে দশ লাখ ডলার হ্যাক বা লোপাট হয়েছিল, যা আজও ফেরত পাওয়া যায়নি। এদেশের মানুষ জানতে পারেনি, কারা সরিয়েছিল এই টাকা। যদি রেফারেন্সটা আপত্তিকর মনে হয় কারও কাছে, দয়া করে ক্ষমা করে দেবেন।

বাংলাদেশে একজনই ছিলেন গোল্ড এক্সপার্ট। নাম তার সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরী। এই দণ্ডপ্রাপ্ত মানবতাবিরোধী অপরাধীর সোনাবিষয়ক কথাবার্তা সম্ভবত এখনও সবার মনে আছে! শুধু একটি কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে সাকা চৌধুরী বলেছিলেন, সোনা মিঞারে বানাইছে লাল মিঞা আর লাল মিঞারে বানাইছে সোনা মিঞা। মিঞা ঠিকই আছে শুধু সোনা লাল হইয়া গিয়াছে!

ঠিক তেমনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা সোনার চাকতি অন্য ধাতু হইয়া গিয়াছে।

লেখক: রম্যলেখক

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ