X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রাম হবে শহর?

দাউদ হায়দার
২৩ জুলাই ২০১৮, ১৭:২২আপডেট : ২৩ জুলাই ২০১৮, ১৭:২৪

দাউদ হায়দার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি এক জনসভায়, তার সরকারের উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ে বলেছেন। ‘গ্রাম হবে নগর’, শিরোনামেই একটি দৈনিকে এই খবর প্রকাশিত হয়েছে।
নগরের যেসব সুযোগ বর্তমান, গ্রামেও নগরকেন্দ্রিক আধুনিকতা সহজেই সহজলভ্য হবে; এরকমই বলতে চেয়েছেন হয়তো। কিন্তু বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেননি। ধাঁধা এখানেই।
আমরা জানি, গ্রামের সাধারণ মানুষের হাতে এখন স্মার্টফোনও আছে। গ্রামে-গ্রামে বিদ্যুৎ যাচ্ছে। রাস্তা কংক্রিট হচ্ছে। গাড়ি চলাচল করছে। নগরের ছোঁয়া পাচ্ছে। স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল গড়ে উঠছে। জনগণের হাতে টাকাকড়িও আছে। সমস্যা অন্যখানে। ভালো স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল, চিকিৎসা, ডাক্তার নেই। নগরেই শেষ আশ্রয়।

শুনেছি, সরকারের হুঁশিয়ারির পরও সরকারি ডাক্তারও গ্রামে যেতে চান না। সরকারের কড়া নির্দেশ, চোখ রাঙানোকেও পাত্তা দেন না তারা।

ডাক্তারদের নাকি বিস্তর অভিযোগ। চিকিৎসার (যথা অপারেশন) যথাযথ ব্যবস্থা নেই। জরুরি ওষুধও সময়মতো সুলভ নয়। দক্ষ নার্সের অভাব। উপরন্তু গোদের ওপর বিষফোঁড়া, সময়ে-অসময়ে লোডশেডিং।

আমাদের এক আত্মীয় আছেন। বয়স চল্লিশোত্তীর্ণ। সরকারি ডাক্তার। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করেছেন, ভালো ছাত্র ও ভালো চিকিৎসক হিসেবে যথেষ্ট সুনাম। তিনি মূলত গ্রামের। জানেন গ্রামীণ মানুষের, রোগীদের করুণ কাহিনি, দুরবস্থা। নানা দুর্দশা। শহরের বদলে তিনি গ্রামই বেছে নেন, একটি থানা-হাসপাতালে। রোগীর সংখ্যা বেশি, অপর্যাপ্ত ওষুধ, চিকিৎসার সরঞ্জাম, সাহায্যকারী (অ্যাসিস্ট্যান্ট), নার্সও যথাসময়ে পাওয়া যায় না। সমস্যা আরও। তিনি বলেন, ‘গ্রামে কেন সরকারি ডাক্তার যেতে চান না, আমি গিয়ে হাড়ে-মজ্জায় টের পেয়েছি। বহু রোগী কথা শুনতে চান না, চিকিৎসা নিতে চান না, চিকিৎসার যন্ত্রপাতি দেখে ভয় পান। এত্ত বাহ্য। বলেন, ‘পানি-পড়া দেন’। দুই-চারদিনে অসুখ না সারলে রোগী ও রোগীর আত্মীয়কূল এসে ধমকান, হুমকি দেন। গ্রামের মাতবর, মস্তানরা আরও সরস। জরুরি ভিত্তিকে কাকে ভর্তি করা হবে, না হবে মাতবর মস্তানের নির্দেশ। না শুনলে বিপদ, ভয় দেখান। ভয়-ডর নিয়ে চিকিৎসা করা যায় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘নিজের চোখে দেখা, রোগীর ভর্তি নিয়ে রীতিমতো টাকার খেলা, মাফিয়া সিন্ডিকেট। গ্রামে কেন ডাক্তার যেতে অনিচ্ছুক, তা সহজেই অনুমেয়। শহরে একজন চিকিৎসক যত আয় করেন, গ্রাম মফস্বলে সিকি ভাগও নয়। তা হলে ডাক্তার কেন গ্রামগঞ্জে যাবে?’

চার দশকের বেশি বাংলাদেশের শহর-গঞ্জ-থানা-মফস্বল-গ্রামের চেহারা-চরিত্র হালহকিকত কেমন, অজানা। বিশদ বলা অপরাধ।

প্যারিসবাসী শিল্পী শাহাবুদ্দীন, তার স্ত্রী আনা, কন্যা চর্যা মাস কয়েক আগে ঢাকায় গিয়েছিলেন। ঢাকা থেকে বাংলাদেশের কয়েকটি গঞ্জ-মফস্বল-গ্রামে। ফিরে এসে ফোনে বললেন, ‘চোখে দেখার মতো পরিবর্তন। থানা-গঞ্জেও আজকাল বাণিজ্যবিতান। গ্রামেও ছোঁয়া লেগেছে। তবে বাংলার গ্রাম এখনও লুপ্ত হয়নি, গ্রামের শোভা, গ্রামীণ ধমনী আজও প্রাণবন্ত। নগরের ধুঁকপুক নেই।’

পৃথিবীর নানাদেশে, শহরে-মফস্বলে-গ্রামে বহু দিনরাত্রি কাটিয়েছি, প্রায় কাটাই। ভবঘুরের যা স্বভাব। ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আজও ‘গ্রাম’। বাংলাদেশের চেয়ে ধনমানে বিত্তবান হয়েও।

ইউরোপে দেখি, অনেক গ্রামই একেবারে ‘ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুর’ (গ্রাম)। বিদ্যুৎ, পাকা রাস্তাঘাট সবই আছে, কিন্তু গ্রাম্যশোভায় ঝলমল।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা, ‘গ্রাম নগর হবে’। যদি হয়, বিচলন স্বাভাবিক। গ্রাম উঠে যাবে তবে? মুছে যাবে গ্রামের ইতিহাস?

গ্রামে জন্ম, গ্রামের জলহাওয়া শরীরে, বহন করি দিবারাত্র। বিদেশেও গ্রামই বাংলার প্রাণ। নগর নয়। দুনিয়ায় কোনও নগরের কি কুলীন সংস্কৃতি আছে? লক্ষ করবেন, ‘কুলীন’ শব্দটি ব্যবহার করছি। নগরের ‘সভ্যতা’ রক্তমাখা। গ্রামীণ সংস্কৃতি কুলীন ও ঐতিহ্যময়। বাংলার সমস্ত কুলীন, ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি গ্রামীণ। পয়লা বৈশাখ থেকে নবান্ন। নৌকো বাইচ থেকে চড়ক। গাজন থেকে নাচন। যাত্রা থেকে পালা। বিয়ের গান থেকে গায়ে হলুদ দেওয়া। মাথায় ফুল গোঁজা থেকে হাতে মেহেদি, পায়ে হলুদ দেওয়া, বধূবরণ। কী নেই? আছে জারি-সারি-ভাটিয়ালি। আছে পায়েস-রস-পিঠে-মিষ্টির নানা উৎসব। নগরে এসব আছে? আছে কি বাংলার আদি ঐতিহ্যের কুলীন সংস্কৃতি? না। নেই।

বাংলা সাহিত্যের মূল কেন্দ্র, মূল রূপ গ্রাম। গ্রাম ছাড়া বিশ্ব সংস্কৃতি, বিশ্ব সাহিত্য, বিশ্ব ঐতিহ্য, বিশ্বকুলীনতা তৈরি হয়নি।

গ্রাম যখন নগরে পরিণত হয়, মানুষ দিশেহারা। খাঁটি দেশীয় ঐতিহ্য ভুলে যায়, নগর সভ্যতায় কতটা যান্ত্রিক, বাংলা ভাষার বহুমান্য কবি অমিয় চক্রবর্তীর ‘ইতিহাস’ নামক কবিতায় পড়েছি।

প্রধানমন্ত্রীকে বিনীত অনুরোধ, গ্রামকে নগরতুল্য সুযোগ-সুবিধা দিন, প্রভূত উন্নয়ন করুন গ্রামের, চিকিৎসায়-বিদ্যুতে-শিক্ষায়-ব্যবসায়, দয়া করে গ্রামকে ‘নগর’ করবেন না। বাংলার কুলীন-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য চিরকালীন, নিশ্চয় আপনারও স্বপ্ন, আরাধ্য। গ্রাম যদি নগর হয়, তবে ‘পুড়িল কপাল, পুড়িল অস্থিমজ্জার সব’। প্রধানমন্ত্রী যদি গ্রামকে নগরতুল্য সুযোগ-সুবিধার কথা বুঝিয়ে থাকেন, তবে এতে অবশ্যই আমার কোনও আপত্তি নেই।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউরোপ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে: সতর্ক ম্যাক্রোঁর
ইউরোপ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে: সতর্ক ম্যাক্রোঁর
রবিবার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলছে, শনিবারও ক্লাস চলবে
রবিবার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলছে, শনিবারও ক্লাস চলবে
অবৈধ ব্যবহারকারীদের ধরতে বাড়ি বাড়ি যাবে তিতাস
অবৈধ ব্যবহারকারীদের ধরতে বাড়ি বাড়ি যাবে তিতাস
ছক্কায় মুশফিকের ‘আউট’ নিয়ে যা বললেন রনি
ছক্কায় মুশফিকের ‘আউট’ নিয়ে যা বললেন রনি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ