X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাকিস্তানে নির্বাচন, সেনাবাহিনী ও গণমাধ্যম

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২৫ জুলাই ২০১৮, ১৬:২৭আপডেট : ২৫ জুলাই ২০১৮, ১৬:২৮

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা আজ সাধারণ নির্বাচন পাকিস্তানে। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার ‘গণতান্ত্রিক’ পথে নেতা নির্বাচন করবে দেশটি। পাকিস্তানের ভোট সংস্কৃতি সম্পর্কে নানা কথা প্রচলিত আছে দেশটির সুশীল সমাজে। বলা হয়, ভোটের আগেই রিগিং বা ভোট কারচুপি হয় দেশটিতে এবং সেটা করে সেনাবাহিনী। এবার সেনাবাহিনীর পছন্দ সাবেক ক্রিকেটার ও পিটিআই নেতা ইমরান খান।
বরাবরের মতো এবারও ভোটের আগে লাগাতার সন্ত্রাসে দেশজুড়ে আতঙ্ক আছে। গত ১০ জুলাই পেশোয়ারে এক জঙ্গি হামলায় আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির নেতা হারুন বিলৌরসহ ২২ জন নিহত হন। খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষ দল এই এএনপি। আরও ভয়াবহ হামলা ঘটে ১৩ জুলাই। বেলুচিস্তানের মাস্তুংয়ে বালুচ আওয়ামী পার্টির এক জনসভায় জঙ্গি হামলায় প্রায় দেড়শ’ জন নিহত হয়। আহত হয় শতাধিক। নিহতদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী দলের নেতা সিরাজ রায়সানিও।
সেনাবাহিনীর পছন্দ ইমরান খান। ১৯৯৭ সালে যখন রাজনীতিতে পা রাখেন ইমরান, তখন তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন দুর্নীতিগ্রস্তদের দলে ঢুকতে দেবেন না। তার একটা ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তিও মানুষের মনে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে তার রাজনৈতিক দর্শন কট্টর মৌলবাদী। তার দল থেকে লড়ছে কট্টরপন্থী ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রার্থী। ফলে পাকিস্তানের তারুণ্য তার পাশে কতটা আছে সে এক প্রশ্ন।

একদিকে ভয়াবহ সন্ত্রাস, আরেকদিকে সেনাবাহিনীর ভূমিকা। সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও তার কন্যা মরিয়ম ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরোর মামলায় শাস্তি ভোগ করছেন বলে জানে মানুষ। লন্ডনে বিলাসবহুল চারটি ফ্ল্যাট ক্রয়ের অর্থের উৎস দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় নওয়াজকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

তাছাড়া কন্যা মরিয়মকে সাত ও জামাতা সাফদার আওয়ানকে ১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারাদণ্ড মাথায় নিয়েই নওয়াজ ও মরিয়ম দেশে এসে গ্রেফতার হন।

পাকিস্তানের যে রাজনীতির ধারা, তাতে পর্দার অন্তরালে থেকে সেনাবাহিনী বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করছে। নওয়াজ তিন তিনবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু কোনোবারই তিনি টার্ম পূরণ করতে পারেননি সেনাবাহিনী চায়নি বলে।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে পাকিস্তানে এখন আলোচনার বিষয় নির্বাচনের আগে পাকিস্তানের গণমাধ্যমের ভূমিকা। যে বড় ধরনের সেন্সরশিপ নেমে এসেছে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন সাংবাদিক ও সুশীল সমাজ। পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের সদস্য আই এ রহমান বলেছেন, জেনারেল জিয়াউল হকের শাসনকালকেই সাধারণত মিডিয়ার পক্ষে ‘অন্ধকার যুগ’ বলা হয়, কিন্তু বর্তমান সময় আরও ভয়ানক। সেই সময়ে সাংবাদিকদের ভয় দেখানো, সংবাদ সেন্সর করা, সবই হতো। কিন্তু গোয়েন্দা এজেন্সিরা এখন যেভাবে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তা আর একধাপ ওপরে।

‘ডন’-এর সিইও হামিদ হারুন গত মাসে সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন, ক্যান্টনমেন্ট এলাকাগুলোতে অনেক মাস ধরেই তাদের কাগজ ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না। এখন সিন্ধ, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাবের বিভিন্ন নাগরিক এলাকাতেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে হকার ও এজেন্টদের।

ভিয়েনাভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইন্সটিটিউট বলছে, the situation in Pakistan is "unprecedented" with journalists being intimidated, abducted and threatened and media houses being forced into self-censorship. পরিস্থিতি এমনই ভয়াবহ যে সেনাবাহিনী থেকে সাংবাদিক ও লেখক, ব্লগারদের তালিকা করে প্রচার করা হচ্ছে, এরা দেশবিরোধী ও সেনাবিরোধী।  সেনাবাহিনীর তরফে এমন তালিকা ভয়ঙ্কর। কারণ, সেখানে সেনাবাহিনী যা বলে সেটাই আইন।  

কোনও খবরে সেনাবাহিনী, বা কিছু নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সমালোচনা থাকলেই সেগুলো বাদ দিতে বা তার অংশবিশেষ ‘সেন্সর’ করতে চাপ দেয় পাক গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস (আইএস)। ওই দফতরের কর্তা আসিফ গফুর ‘ডন’ সংবাদগোষ্ঠীর ‘হেরল্ড’ পত্রিকার সম্পাদককে হুমকি দিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ। কারণ, ওই পত্রিকায় ‘পাশতুন তাহাফুজ আন্দোলন’ সম্পর্কে লেখা ছাপা হয়েছিল। ওই আন্দোলন জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় সেনার কার্যকলাপ নিয়ে প্রশ্ন তোলে, সামরিক বাহিনীর দায়বদ্ধতা দাবি করে।

তালিকা করা লেখক ও ব্লগারদের অনেককে বন্দিও করা হয়েছে। এক নারী সাংবাদিকের বাড়িতে ঢুকে তার ঘর তছনছ করা হয়েছে। টুইটে রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়ায় ২২ বছরের এক মেয়েকে শিগগিরই দেশ ছাড়তে হচ্ছে। তাহা সিদ্দিকী নামে একজন সাংবাদিক ফ্রান্সে পালিয়েছেন। একদল সশস্ত্র ব্যক্তি তাকে রাস্তা থেকে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এরপর প্রাণে বেঁচে দেশ ছেড়েছেন। এর আগে তার এক লেখার কারণে তাকে সেনা সদরে ডেকে এ নিয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছিল।

পরিস্থিতি এমনই। সামরিক বাহিনীই ঠিক করছে নির্বাচনে গণমাধ্যম কর্মীরা কীভাবে আচরণ করবে, কতটুকু প্রচার করবে বা প্রকাশ করবে। সেনাবাহিনী গণমাধ্যম কর্তাদের ডেকে নিয়ে বলে দিচ্ছে ইমরান খান সম্পর্কে ইতিবাচক খবর করতে হবে।

বেলুচিস্তান নিয়ে খবর কার্যত নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। অথচ সেখানে চলছে জাতীয়তাবাদী গণআন্দোলন। খাইবার-পাখতুনখোয়া অঞ্চলে পাশতুন তাহাফুজ আন্দোলন সম্পর্কেও সংবাদ বেরোচ্ছে না। নির্বাচনে যাই ঘটুক, সংসদে যেই আসুক, সেনাবাহিনীই আড়ালে থেকে সরকার গঠনে প্রধান শক্তি হয়ে উঠবে। এটি পাকিস্তানের নিয়তি। কিন্তু পাকিস্তানের গণমাধ্যমের জন্য এই নির্বাচন হয়ে থাকছে এক আতঙ্ক হিসেবেই। কারণ, নির্বাচন কমিশন নয়, সেনাবাহিনী তালিকা চেয়ে পাঠাচ্ছে কোন কোন রিপোর্টার নির্বাচনের খবর করবেন এবং সেই তালিকা ‘অনুমোদন’ করছে সেনাবাহিনী। ‘পাকিস্তান-বিরোধী’ কোনও সাংবাদিক নির্বাচনের খবর করুক, সেটা চায় না সেনাবাহিনী।

ডন সিইও হামিদ হারুন বলেছেন, সেনাবাহিনী নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করতে চায়, জাতির চলার পথ ঠিক করে দিচ্ছে এবং গণমাধ্যমকে কণ্ঠহীন করে ছাড়ছে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ