X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘চুমু দ্য কিস’

আহসান কবির
২৫ জুলাই ২০১৮, ১৭:০৪আপডেট : ২৫ জুলাই ২০১৮, ১৭:০৬

আহসান কবির বিজ্ঞান বলছে—মানব আচরণের সবচেয়ে অমীমাংসিত অথচ শিল্পিত রূপ চুমু। সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে চুমু হচ্ছে দেওয়ার ব্যাপার কিন্তু বাংলায় এটি খাবারের তালিকায় রাখা হয়েছে। তাই কবিতা দিয়ে শুরু করা যাক চুমু বিষয়ক লেখাটি:
যারা চুমু খায় তারা সবাই জানে না
কেউ কেউ শুধু জানে
অমলিন শূন্যতা ওঁৎ পেতে থাকে
দু-ঠোঁটের মাঝখানে!

চুমু নিয়ে সারা পৃথিবীতে যেমন অনেক রকমের মাতামাতি আছে, তেমনি কোথাও কোথাও মনে করা হয় প্রকাশ্যে চুমু দেওয়াটা অপরাধ! মার্কিন মুল্লুকের বাসিন্দাদের চুমু নিয়ে রীতিমতো আদিখ্যেতা আছে। কেউ সমুদ্রের হাজার ফুট নিচে নেমে চুমু দিতে চায়, কেউ চুমু দিতে চায় হিমালয়ের চূড়ায় ওঠে। কেউ প্যারাসুটে করে বিমান থেকে নেমে চুমু খেতে খেতে মাটির দিকে আসতে চায়। আমেরিকার ঠিক পাশের দেশ মেক্সিকোতে প্রকাশ্যে চুমু দেওয়াটা অপরাধের পর্যায়ে পড়বে। একই অবস্থা সৌদি আরবেও। জেলে যেতে চাইলে যে কেউ সৌদি আরবে গিয়ে প্রিয়জনকে প্রকাশ্যে একবার চুমু দিয়ে দেখতে পারেন। তবে সৌদি আরব আর মেক্সিকোর মধ্যে পার্থক্য শুধু উট ও জিরাফে। সৌদি আরবের জনপ্রিয় একটি কৌতুক এমন—রাজা তার উট-বহরের সবচেয়ে দামি ও সুদর্শন উটের সঙ্গে এক খরগোশের বিয়ে দিয়ে দিলেন। মিডিয়া এই বিয়ে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। উট ও খরগোশের বিয়ের তিনদিন পর এক পত্রিকা রিপোর্ট করলো—খরগোশ আর উটের বিয়ে-পরবর্তী ঘটনা তুঙ্গে। শুধু চুমু দিতে হলে খরগোশকে অনেকদূর পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। মেক্সিকোতে এই একই কৌতুক প্রচলিত থাকলেও সেখানে খরগোশের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে জিরাফের। এই দুই পশুর গলা দীর্ঘ বলেই খরগোশকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়।

তবে সৌদি আরবে উটরা একে অন্যের গাল ঘষে আদর জানায়। সেখানকার মানুষেরাও তাই। গাল ঘষার কারণ বৈজ্ঞানিক। মরুভূমির গরমে শরীরের যে অংশ খোলা থাকে সেসব গরম হয়ে যায়। তাই কোলাকুলির পর ঢেকে রাখা গাল ঘষে সহমর্মিতা জানায় সৌদিরা। এস্কিমোরা এমনিতেই শীতে জমে থাকে। তাই বড় বড় নিঃশ্বাস নেওয়ার পর তারা নাকে নাক ঘষে চুমু দেওয়ার ভান করে। তারা চায় না চুমুর কারণে শীতে তাদের ঠোঁট জমে যাক। আসলে যে দেশের মানুষের যেমন অভ্যাস। সুদানের মানুষরা মনে করে আত্মা মুখ থেকে বেরিয়ে ওপরে চলে যায়। তাই তাদের কাছে মুখ বন্ধ রাখাটাই ভালো। জানি না সুদানের মানুষ আজও  মুখ বন্ধ করে চুমু দেয় কিনা। মঙ্গোলিয়ানরা বহুদিন ধরে জানতো না যে, চুমু বলে একটা ব্যাপার আছে। এ বিষয়ে তাদের এক্সপার্ট করে তুলেছিল ইংরেজরা। তবে ইঁদুররা তাদের ভাব বা আদর বিনিময় শুরু করে নাকে নাক ঘষে। সহজাত অনেক জিনিস পশু পাখি ও মানুষের জীবনে একই রকম প্রভাব ফেলে। মারামারি হাতাহাতি ঝগড়ার পরে বানর বা শিম্পাঞ্জি একে অন্যকে চুমু খায়। দুই সাপ আদর বিনিময়ের আগে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে নাচে। দুই হাতির আনন্দও শুঁড় ঘিরে। দুই হাতি যখন মারামারি করে তখন দূর্বাঘাস পায়ের নিচে পিষ্ঠ হয়। যখন দুই হাতি একে অন্যকে চুমু দেয়, তখনও দূর্বাঘাস পিষ্ঠ হয়। দূর্বাঘাস হচ্ছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত আর গরিব মানুষের প্রতীক। হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন গরিব মানুষ চুমু দিলে সেটা ভালো নাও লাগতে পারে (অনেকটা সেই ছড়ার মতো-যার মুখে গন্ধ/তার চুমু বন্ধ!) তবে গরিব মানুষরা যখন সমবেতভাবে প্রতিবাদ করে, তখন নাকি সেটা শিল্প হয়ে যায়! আগেই লিখেছি চুমু হচ্ছে অমীমাংসিত মানব আচরণের শিল্পিত রূপ।

Kiss শব্দটা এসেছে ইংরেজি cyssan থেকে। cyssan শব্দটা চুমুর সময় উদ্ভূত শব্দের রূপক। চুম্বনেরও বিভিন্ন ধরন এবং নাম রয়েছে। প্যাশনেট বা অতি আবেগী চুম্বনকে বলে  saviolum  আর ঘনিষ্ঠ চুম্বনকে বলা হচ্ছে osculum ।একইভাবে কপাল ঘাড়ে বা হাতের চুম্বনের রয়েছে আলাদা আলাদা নাম। চুমুবিদ্যা বা চুম্বনতত্ত্বের ইংরেজি নাম হচ্ছে  philmatology। ভারত পুরানে চুমু হচ্ছে সুখের স্পর্শ। হাতে চুমু দিয়ে সেটা প্রিয়তমের উদ্দেশে ছোড়ার ভঙ্গিটা ফ্রেঞ্চ কিস নামেই পরিচিত। প্রায় সত্তর বছর ট্রেনে চুম্বন নিষিদ্ধ করেছিল ফ্রান্স সরকার। কারণ প্রিয়তমকে বিদায় দেওয়ার আগে বা তাকে ট্রেন থেকে নামার সময় বরণ করার জন্য চুমু দেওয়ার রেওয়াজ ছিল, যা এখনও আছে। ট্রেন যাত্রায় যাত্রীরা চুমুর কারণে দেরি করতো বলে এই আইন করা হয়েছিল। যদিও এখন আর সেই আইন নেই। ফ্রান্সের অন্য নাম এখন ফুল, সৌরভ ও চুম্বনের দেশ। খোদ ইংল্যান্ডে চুমু নিষিদ্ধ ছিল কয়েক দশক। প্লেগ ও বিভিন্ন রোগের কারণে ১৪৩৯ সালে রাজা পঞ্চম হেনরি চুমু নিষিদ্ধ করেন। তিনি নিজেও চুমু দিতে না পেরে উদ্ভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। যাই হোক পরে এই আইন রদ করা হয়।

পাঁচ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক চুমু দিবস। মার্কিন মুল্লুকে একবার চুমু দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল—চুমু দিন, প্রতারণা রুখে দিন। শরীরে ডোপামিন নির্গত হলে মানব শরীরে প্রতারণার উপাদান বাড়ে। চুমুতে নির্গত হয় অক্সিটোক্সিন। শান্তি, আনন্দ ও উদ্দীপনা ছড়িয়ে দেয় শরীরে এই অক্সিটোক্সিন। ২০১৩ সালে থাইল্যান্ডে ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে লাক্সানা তিরানাত ও এক্কাচাই তিরানাত চুমুর বন্ধনে (১২ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় চুম, শেষ হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি) আবদ্ধ হন। ৫৮ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট ৫৮ সেকেন্ড পরে একে অন্যের ঠোঁট ছাড়েন। ভালোবাসা দিবসে পৃথিবীর মানুষ জানতে পারে যে, এই দুই জন মানুষ দীর্ঘস্থায়ী চুমুতে বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন। যদিও এক্কাচাই ও লাক্সানা তিরানাতকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল এবং অক্সিজেন ট্রিটমেন্ট দিয়ে তাদের সুস্থ করে তোলা হয়।

সিনেমায় বিভিন্ন চুমুর দৃশ্য কালজয়ী হয়ে আছে। কিন্তু যেভাবে সেইদৃশ্যগুলো ধারণ করা হয়েছিল, তার অধিকাংশই সিনেমাতে সেভাবে দেখা যায়নি। সেন্সর বোর্ড বলে একটা জিনিস আছে যা সব দেশেইে সক্রিয়। গত শতকের সত্তর দশকের বাংলাদেশে রাজ্জাক ববিতা অভিনীত ‘অনন্ত প্রেম’ ছবিতে প্রথম সরাসরি চুম্বন দৃশ্য ধারণ করা হয়েছিল, যদিও সেন্সর বোর্ড তা চালানোর অনুমতি দেয়নি। ছবিতে যেমন আছে বাস্তবেও চুমুর ঘটনা নিয়ে তুমুল বিতর্ক আছে। বোম্বের ছবিতে ইমরান হাশমির নাম হয়ে গেছে সিরিয়াল কিসার! যখনই ছবিতে চুমুর দৃশ্য থাকে বাধ সাধেন তার স্ত্রী। তখন তাকে ব্যাগ কিনে দেন হাশমি! তার স্ত্রীর নাকি ভ্যানিটি ব্যাগের নেশা আছে। এখন পর্যন্ত কী পরিমাণ ব্যাগ জমেছে, তা জানাননি ইমরান হাশমি বা তার স্ত্রী! এক অনুষ্ঠানে শিল্পা শেঠিকে চুমু দিয়ে বিশাল বিতর্কে জড়িয়েছিলেন রিচার্ড গিয়ার। অভিষেক বচ্চনের উপস্থিতে তার স্ত্রী ঐশ্বরিয়া রাইকে চুমু দেওয়ায় বিতর্কে জড়ান অজয় দেবগন। অন্যদিকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টে বারাক ওবামা তারা স্ত্রী মিশেলকে চুমু দেওয়ার যে বিবরণ দেন, তা নিয়ে কম আলোচনা হয়নি। ওবামা লিখেছিলেন মিশেলের সঙ্গে প্রথম চুমু বিনিময়ের পর আমি পেয়েছিলাম স্বর্গীয় কোনও চকলেটের স্বাদ!

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার প্রধানতম বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে চুম্বনরত দুই তরুণ-তরুণীর কাছ থেকে কিন্তু কখনোই জানা যাবে না, কেমন ছিল তাদের চুম্বন অনুভূতি। ২০১৮ সালের জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে এই চুমুর ছবি ভাইরাল হয়। জানা যাবে না যে, চুমুর স্বাদ চকলেট চুইংগাম নাকি চটপটির মতো ছিল। তবে মন্তব্যের বন্যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভারী হয়ে গেছে। একদল গালাগাল করেছে, দুই তরুণ-তরুণীকে নির্লজ্জ বেহায়া বলেছে, কেউ কেউ এটাকে ধর্মবিরোধী অসামাজিক কাজ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সংখ্যায় অনেক কম কিন্তু কেউ কেউ বলেছেন এদেশে ধর্ষণ, ঘুষ গ্রহণ, জমি দখল, ছিনতাই রাহাজানি সামাজিক অত্যাচার নিয়ে কারও যেন কোনও মাথাব্যথা নেই, সামান্য চুমু খেলেই অপরাধ? চুমুতেই সব অপবিত্র হয়ে গেলো?

দেশ যেন আজ  দুই দলে বিভক্ত। চুমুপক্ষ আর চুমুবিরোধী পক্ষ। বসনিয়ায় যখন গণহত্যা চলছিল তখন দেশ ছেড়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয় প্রেমিক-প্রেমিকা। প্রেমিক ছিল সার্বিয়ান আর প্রেমিকা ছিল বসনিয়ান। সার্বিয়া আর বসনিয়ার নিরপেক্ষ বর্ডার অতিক্রম করার সময় মারা পড়ে এই প্রেমিক প্রেমিকা। যুদ্ধের বিভীষিকাময় জগৎ পেরিয়ে শান্তিময় পরিবেশে তাদের ভালোবাসার চুম্বন দেওয়ার কথা ছিল।

মরে যাওয়ার আগে প্রেমিকা প্রার্থনা করেছিল এই বলে যে, ইশ্বর তুমি নিশ্চয়ই আমাদের পবিত্র ভালোবাসাকে অমর্যাদা করবে না। আমরা চুমু খাবো পরপারে, তোমাকে সাক্ষী রেখে ঈশ্বর।

লেখক: রম্যলেখক

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ