X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

নতুন বাম জোটের রাজনৈতিক তাৎপর্য

আমীন আল রশীদ
২৬ জুলাই ২০১৮, ১৪:৪৪আপডেট : ২৬ জুলাই ২০১৮, ১৭:৪৬

আমীন আল রশীদ ভোট এলে জোট গঠন, ভাঙন, সম্প্রসারণ স্বাভাবিক ঘটনা। সেই প্রক্রিয়ায় ১৮ জুলাই সকালে রাজধানীর মুক্তি ভবনে সংবাদ সম্মেলনে ৮টি দল নতুন জোটের ঘোষণা দেয়—যার নাম দেওয়া হয় ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’। উদ্দেশ্য, অপরাজনীতির বাইরে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি জোরদার করা।
জোটের অন্তর্ভুক্ত দলগুলো হচ্ছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্ক্সবাদী), গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন।
গত এক বছর ধরে সিপিবি-বাসদ-গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার অন্তর্ভুক্ত আটটি রাজনৈতিক দল একসঙ্গে তাদের যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল, তারই ধারাবাহিকতায় নতুন এই জোট গঠন। প্রশ্ন হলো, বাম দলগুলোর এই জোটের রাজনৈতিক তাৎপর্য কী? আগামী জাতীয় নির্বাচনে তারা কী ভূমিকা রাখতে পারবে কিংবা সামগ্রিক ভোটের হিসাবে জনগণের কাছে তাদের অবস্থানইবা কোথায়?

বলা হয়, বাংলাদেশের বাম রাজনীতি বরাবরই বিভক্ত এবং বড় কোনও দলের ছত্রছায়ায় না থাকলে তাদের টিকে থাকা কঠিন। যদিও তারা রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের কথা বলে; সমতাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রের কথা বলে। কিন্তু তারপরও কেন তারা ভোট পায় না, তা একটি বড় প্রশ্ন। এরমধ্যে জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি সরকারের অংশ হয়ে ওঠায় তাদের বিরোধী বাম দলগুলোর অভিযোগ, ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে গিয়ে তারা (জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি) বাম রাজনীতির দর্শন থেকে বিচ্যুত হয়েছে। এটিকে অনেকে ‘রাজনৈতিক স্খলন’ বলেও মন্তব্য করেন।

স্বাধীনতার পর থেকে এযাবৎ যে ১০টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে তাতে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর আসন প্রাপ্তির পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে ভোটের রাজনীতিতে তাদের জনপ্রিয়তার একটা চিত্র পাওয়া যায়। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৩৭টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল জাসদ, কিন্তু তারা মাত্র একটি আসনে জয়লাভ করে। ন্যাপ (মোজাফফর) ২২৪টিতে প্রার্থী দিলেও একটি আসনও  পায়নি। আরেক অংশ ন্যাপ (ভাসানী) প্রার্থী দিয়েছিল ১৬৯টিতে। প্রাপ্ত আসন সংখ্যা শূন্য। সিপিবি প্রার্থী দেয় ৪টিতে। একটিতেও জেতেনি।

১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৪০টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ৮টিতে জয় পায় জাসদ। ন্যাপ (মোজাফফর) একটিতে জয়ী হলেও দলের অন্য দুটি অংশ ন্যাপ (নাসের) ও ন্যাপ (জাহিদ) একটি আসনও পায়নি। সিপিবি ১১টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। আসন সংখ্যা শূন্য।

১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিপিবি ৯টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ৫টিতে জয়ী হয়। জাসদ (রব) ৪টি, জাসদ (সিরাজ) ৩টি, ন্যাপ (মোজাফফর) দুটি এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ৩টি আসনে জয় পায়।

১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ জাতীয় সংসদ জাসদের আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বিরোধী দল ১৯টি এবং জাসদের আরেক অংশ (সিরাজ) ৩টি আসনে জয় পায়।

১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় নির্বাচনে সিপিবি ৫টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ১টি, জাসদ (সিরাজ) একটি এবং ন্যাপ (মোজাফফর) একটি আসনে জয় পেলেও জাসদ (ইনু), জাসদ (রব) কোনো আসন পায়নি।

১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় নির্বাচন ছিল একটি বিশেষ পরিস্থিতির এবং সেই সংসদ ছিল অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ অধিকাংশ দল অংশ নেয়নি। সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী আনার জন্য ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিএনপি, ফ্রিডম পার্টি এবং কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে  বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে জাসদ ৭৬টি আসনে প্রার্থী দিয়ে মাত্র একটিতে জয় পায়। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনও বাম দল আসন পায়নি। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাসদ ৬টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ৩টিতে এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দুটিতে জয় পায়। সবশেষ ২০১৪ সালের আলোচিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, অর্থাৎ যে নির্বাচনে ১৫৩ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, এই নির্বাচনে জাসদ ৫টি এবং ওয়ার্কার্স পার্টি ৬টি আসন পায়।

এই পরিসংখ্যানই বলছে দেশে ভোটের রাজনীতিতে বাম দলগুলোর জনপ্রিয়তা খুব বেশি নয়। কিন্তু তারপরও রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং ক্ষমতা কাঠামোয় ভারসাম্য রাখতে এই দলগুলোর গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে বড় দলগুলো যখন গ্যাস বিদ্যুতের দাম, সুন্দরবন সংলগ্ন রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মতো প্রকল্পের বিরুদ্ধে বড় কোনও কর্মসূচি দিতে ব্যর্থ হয়, তখন এসব জনইস্যুতে সরকারের বাইরে থাকা বাম দলগুলোই রাস্তায় নামে, পুলিশের লাঠিপেটা ও টিয়ারশেল খায়। তাছাড়া রাষ্ট্রের নানা স্তরে দুর্নীতি এবং রাজনীতিতে কালো টাকা ও  পেশিশক্তির দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে সরকারের বাইরে থাকা বাম দলগুলোই জোর গলায় কথা বলে। ফলে ভোটের মাঠে বাম দলগুলোর গুরুত্ব খুব বেশি পাত্তা না পেলেও রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন এবং ভিন্ন মত প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাদের একটা গুরুত্ব রয়েছে।

নতুন বাম জোট তাদের যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে তার মধ্যে রয়েছে দুঃশাসন, জুলুম, দুর্নীতি-লুটপাটতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র প্রতিরোধ এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে ২৪ জুলাই ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ; জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা এবং বিদ্যমান নির্বাচনি ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের দাবিতে ৪ আগস্ট ঢাকায় মতবিনিময় ইত্যাদি।

জোটের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে পঠিত মূল বক্তব্যে রাষ্ট্র ও সরকারের ফ্যাসিবাদী প্রবণতা বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয় এবং এরকম পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বাম প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক শক্তিই জনগণের প্রকৃত ভরসার জায়গা হয়ে উঠতে পারে বলে দাবি করা হয়। জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়ে সরকারের পদত্যাগ, সকল দল ও সমাজের অপরাপর অংশের মানুষের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন এবং গোটা নির্বাচনি ব্যবস্থার আমূল সংস্কারেরও দাবি জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।

বাম রাজনৈতিক দলগুলো কেন ভোটের রাজনীতিতে হেরে যায় বা কেন তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ে না, তা নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ হয়েছে। এ বিষয়ে বামপন্থী তাত্ত্বিকদের যেমন ব্যাখ্যা আছে, তেমনি কোনও পন্থী নন, এমন অ্যাকাডেমিশিয়ানদেরও বিশ্লেষণ রয়েছে। তবে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সাধারণ ধারণা এরকম, তারা ভালো কথা বলে; কালো টাকা-দুর্নীতি-পেশিশক্তি-পরিবারতন্ত্র ইত্যাদির বিরুদ্ধে তারা যেসব স্লোগান দেয়—তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের ভাবনার কোনও তফাৎ নেই। কিন্তু তারপরও তারা বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিকল্প হিসেবে নিজেদের প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে নতুন জোট গঠন উপলক্ষে দেওয়া সংবাদ সম্মেলনে তাদের তরফে যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে সেগুলো নিছকই রাজনৈতিক বুলি কিংবা অ্যাকাডেমিক তর্কের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে কিনা তাও এক বিরাট প্রশ্ন। কেননা, দেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের কোনও পরিবর্তন আনতে চাইলে জনগণের ম্যান্ডেট লাগবে। অর্থাৎ ভোট লাগবে। কিন্তু অনেক সময়ই বাম দলগুলোর তরফে বলা হয়, তারা ভোটের রাজনীতি করে না। ভোটের রাজনীতি না করলে তারা কী করে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে তা পরিষ্কার নয়। তাছাড়া বিপ্লবী সরকার গঠন বা শ্রেণিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বাস্তবতা এখন নেই। এখন তাদের মূলধারার দল বলে পরিচিত ও স্বীকৃত আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো দলের বিকল্প হিসেবে দাঁড়াতে হলে জনগণের কাছে তাদের কর্মসূচি পরিষ্কার করতে হবে। জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। তারা যে আওয়ামী লীগ-বিএনপির চেয়ে উত্তম, জনগণের মধ্যে সেই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেইবা বাম দলগুলো কয়টি আসনে জয়লাভ করবে, তা নিয়েও সংশয় আছে। বস্তুত বড় দুটি দল বা জোটের বাইরে গিয়ে এককভাবে কিংবা বাম দলগুলোর জোট করেও খুব বেশি আসনে জয়ী হওয়া কঠিন।

নতুন বাম জোট গঠনের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, অপরাজনীতির বাইরে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি জোরদার করা। প্রশ্ন হলো বাংলাদেশে বড় দুটি দলের বাইরে গিয়ে নতুন বা বিকল্প জোটের সাফল্যের সম্ভাবনা কতটুকু? বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার একটা বড় সুযোগ এসেছিল ওয়ান ইলেভেনের পরে। কেউ কেউ সেই সুযোগ কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। কিংস পার্টি নামে একটি শব্দ তখন বেশ আলোচিত হয়। কিন্তু আখেরে দেখা গেলো, এই কথিত বিকল্প বা তৃতীয় শক্তি খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি।

তবে বাংলাদেশের রাজনীতির ভেতরে ভেতরে ইসলামিকরণের যে প্রবণতা বেশ কয়েক বছর ধরে চলছে, তাতে ভবিষ্যতে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে ছোট ছোট ইসলামি দলগুলো অধিকতর শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং কট্টরপন্থী ইসলামি দলগুলো বড় দলগুলোর ছত্রছায়ায় কিংবা নিজেরাই জোট গঠন করে একসময় আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াবে কিনা–সেই আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আমরা স্মরণ করতে পারি, গত বছরের ৭ মে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে সম্মিলিত জাতীয় জোট নামে এইচ এম এরশাদ তার দল জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে একটি নতুন জোটের ঘোষণা দিয়েছিলেন–যেখানে অধিকাংশ দলই ধর্মভিত্তিক। ৫৮টি দলের মধ্যে ৫৬টির কোনও নিবন্ধনই নেই। অধিকাংশ দলের নাম দেশের মানুষ জানেই না। ভোট তো দূরে থাক, সাধারণ মানুষের মধ্যে এসব দলের কোনও গ্রহণযোগ্যতাও নেই। কিন্তু তারপরও এই দলগুলোকে নিজেদের দলে ভিড়ানো, এমনকি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত না হওয়ার পরও কট্টরপন্থী সংগঠন হিসেবে পরিচিত হেফাজতে ইসলামের তোষণও ভবিষ্যতে রাজনীতিতে কী ধরনের মেরুকরণ তৈরি করবে তা এখনই বলা মুশকিল।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
কুমিল্লা মেডিক্যাল সেন্টার হাসপাতালকে ২ লাখ টাকা জরিমানা
কুমিল্লা মেডিক্যাল সেন্টার হাসপাতালকে ২ লাখ টাকা জরিমানা
ফটোকপি দোকানের কর্মচারী, জেলে, রাজমিস্ত্রি তৈরি করতো জাল টাকা
ফটোকপি দোকানের কর্মচারী, জেলে, রাজমিস্ত্রি তৈরি করতো জাল টাকা
রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর নিরাপত্তা জোরদার করছে কিয়েভ
রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর নিরাপত্তা জোরদার করছে কিয়েভ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ