X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

কে নেবে দায়, কে দেবে ভরসা?

রাশেদা রওনক খান
০১ আগস্ট ২০১৮, ১৬:১৩আপডেট : ০১ আগস্ট ২০১৮, ১৬:২১

রাশেদা রওনক খান এই মুহূর্তে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সূচকে এগিয়ে গেলেও এক ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে! ট্রানজিশন পিরিয়ডে কম বেশি প্রায় সকল দেশই এ ধরনের একটি সংকটময় সময় কাটায়। আর বাংলাদেশের মতো জনবহুল একটি রাষ্ট্রে সমস্যা হবে, প্রতিদিনই কোনও না কোনও সংকট তৈরি হবে। উন্নত দেশগুলোতেও হয় না সংকট, তা নয়, সেখানেও সংকট হয়, কিন্তু তাদের সাথে আমাদের মূল তফাতের জায়গাটা হচ্ছে, তারা সমস্যা তৈরি হওয়া মাত্রই  দ্রুত কয়েক ঘণ্টার মাঝে একটি সমাধানের জন্য উঠেপড়ে একযোগে কাজে লেগে যায়। আর আমাদের এখানে এক সংকট থেকে অন্য সংকট তৈরি হয়, তবু কর্তৃপক্ষের দায়সারা ভাব, কোনও উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়াস দেখা যায় না। যদি নেয়াও নয়, তার থাকে না কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা কিংবা বাস্তবায়নের মহৎ উদ্দেশ্য। কেউ যেন দায় নেওয়ার নেই, ভরসার জায়গাও তাই আর তৈরি হয় না। আরও কিছু বিষয় আছে, যা আমাদের এখন ভেবে দেখা জরুরি।

১. দেশের যেকোনও ইস্যুতে সংকট তৈরি হলে, সেই বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিমিষেই নিজের দায় স্বীকার করে নিয়ে তা সমাধানের জন্য কাজ শুরু করে দেয়। আমাদের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ যেন নীরব দর্শক! তাদের বাঁচাতে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা এগিয়ে আসেন কিংবা আমরা নিজেরা ওই রাজনৈতিক নেতাদের ওপর খেদ প্রকাশ করি। কিন্তু এই সমস্যা মূলত তৈরির পেছনে যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব- দুটোই যে সমভাবে দায়ী, সে বিষয়ে আমরা ওয়াকিবহাল থাকলেও নীরব থাকি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অঙ্গুলি প্রদর্শনে। যেকোনও সমস্যা বা সংকট তৈরিতে আমাদের লোকবলের অভাব নেই, কিন্তু সমাধানের জন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এতক্ষণে পরিবহন সেক্টর নিয়ে কাজ করেন সকল স্টেকহোল্ডারদের ৩/৪টা মিটিং হওয়া, সেই মিটিংগুলোতে নেয়া পদক্ষেপের কথা জানান দেয়া, সেই অনুযায়ী রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের তৎপরতা দেখানো -এসব হলো এই মুহূর্তে সংকট মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ, যা দেখে বাচ্চারা একটু আশ্বস্ত হবে, একটু স্বস্তি পাবে। আমরা যারা বড় হয়ে গেছি, নিজেদের পদ-পদবি, ক্ষমতা, স্বার্থ নিয়ে ভাবি, তাদের মতো এই কোমলমতি বাচ্চাগুলো নয়। তারা রাস্তায় নেমেছে তাদের সহপাঠীর অস্বাভাবিক মৃত্যুকে মেনে নিতে না পেরে, নেমে এসেছে সামনে যেন আপনার আমার বাচ্চা কিংবা আপনি-আমি এভাবে মারা না যাই। তারা স্বার্থের অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গেছে, তাদের এই নিঃস্বার্থ প্রতিবাদকে স্যালুট জানাই, আপনারাও জানান। তাদের চাওয়া একান্তই তাদের চাওয়া নয়, এটা আমাদের 'সকল'-এর চাওয়া-আমার আপনার সকলের। ‘সকলের সংকট, আমার সংকট'-এভাবে ভাবতে পারার সময় এসেছে। এটাই হচ্ছে মূল জায়গা, যেটি নিয়ে আমাদের ভাবনার সময় এসেছে। নয়তো সামনে আরও খারাপ সময় আসবে, সংকট তৈরি হবে, কিন্তু সমাধানের পথ থাকবে না।

২. আমাদের প্রবণতা হচ্ছে, সমস্যা হয়েছে, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসবে না, কেবল তাকিয়ে থাকবেন একজনের দিকে, কখন তিনি এর সমাধান নিয়ে কথা বলবেন! কিন্তু কেন? রাষ্ট্র পরিচালনার মতো বড় দায়িত্বে থেকে তাকেই কেন রাষ্ট্রের প্রতিটি সমস্যা নিয়ে ভাবতে হবে, কথা বলতে হবে, সমাধানের পথ দেখাতে হবে? তাহলে মন্ত্রিপরিষদের দায়িত্ব কি? এই সমস্যা মোকাবিলায় কি কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব মিলে কয়েকটি পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেন না? এতটুকু নেতৃত্বও কি আমরা আশা করতে পারি না? যেকোনও ঘটনার সমাধান কেন কেবল প্রধানমন্ত্রীকেই দিতে হবে?

৩. আমরা কি একটা স্বপ্ন দেখতে পারি না যে আজ বা আগামীকাল ঢাকা শহরের রাস্তায় বাচ্চারা প্রতিবাদ করতে বের হলে অন্তত কিছু তরুণ মন্ত্রী কিংবা নেতৃত্ব স্থানীয় তরুণ তাদের পাশে এসে দাঁড়াবেন? খুব কি অলীক ভাবনা? ভাবতে পারি না যে তারা ওদের উদ্দেশে বলবেন, "আমরা আছি তোমাদের সাথে, এসো রাস্তায় নয়, আলাপ করি টেবিলে বসে"? সত্যিই কি আপনাদের কিছুই করার নেই? কয়েকজন তরুণ মন্ত্রী মিলে কি একটা সমাধান বাতলে দিতে পারবেন না, কীভাবে এই সংকট হতে আমরা নগরবাসী মুক্ত হতে পারি? যথাযথ কর্তৃপক্ষকে নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসা যায় না?

৪. তরুণ নেতৃত্ব, আসুন, দেখুন, সাহস করুন! আমরা বিশ্বাস করতে চাই, আপনারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী, তাঁর সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়েই রাজনীতি করেন.. ছাত্রদের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ সম্পর্কে আপনারা জানেন, পড়েছেন তাঁর আত্মজীবনী। তাঁর মতো করেই ছাত্রদের পাশে দাঁড়াবেন। বঙ্গবন্ধুর মতো সাহসী কি হতে পারে না আমাদের তরুণ নেতৃত্ব? এতটুকু কি আশা করা খুব অন্যায় স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে? বঙ্গবন্ধু কেবল নিজের ভাবনা ভাবলে আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে বসে প্রতিবাদ করতে পারতাম না।

৫. এখনও সময় আছে, আসুন, রাস্তায় নামুন, ওদের পিঠে হাত বুলিয়ে বলুন, আপনারা এই সমস্যার সমাধান করবেন, আপনারা এগিয়ে আসবেন, আপনারা যে যেই মন্ত্রণালয়েরই হন না কেন, সমাধানের জন্য কাজ করবেন। ডিভিশনাল সেগমেন্টেশন, এটা অমুক মন্ত্রণালয়ের কাজ, এটা অমুক মন্ত্রীর কাজ-এসব আমলাতান্ত্রিক জটিলতার যে ঔপনিবেশিক চরিত্র তা আমাদের রাজনৈতিক পরিসরেও ঢুকে পড়েছে।  কিন্তু সময় এখন বাংলাদেশের! তাই সবাই মিলে একসাথে একযোগে কাজ করতে হবে। আর সবাই মিলে কাজ করলে একটি শহরের রাস্তাঘাট-যানবাহন সংক্রান্ত সমস্যা সমাধান হবে না, তা কি করে হয়? প্রয়োজন উদ্যোগ, সাহস আর সততার। এই তিনের সমন্বয়ে গড়ে উঠুক আমাদের আগামী প্রজন্মের নেতৃত্ব!

৬. আমরা সবাই জানি, এ ধরনের সড়ক দুর্ঘটনা কেন ঘটছে, কাদের গাফিলতিতে ঘটছে? কাদের দায়িত্ব রাস্তায় কোন বাস চলার যোগ্য, কোনটি যোগ্য নয়-তা দেখার? ড্রাইভিং লাইসেসন্স না থাকলেও কারা ৫০/১০০ টাকার বিনিময়ে গাড়ি চালাতে দিচ্ছে? কারা বাসগুলো বাসস্ট্যান্ডে না দাঁড়িয়ে যেখান সেখান হতে যাত্রী তুলছে দেখেও নীরবে তা মেনে নিচ্ছে কিছু বাড়তি আয়ের উদ্দেশে? রাস্তায় চলাচলের অযোগ্য গাড়ি কীভাবে রাস্তায় কেবল চলছে না, প্রতিযোগিতা করে প্রতিদিন মানুষ মারছে? নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে, বাড়তি আয়ের ভাবনা থেকে একটি পুরো সেক্টর ধ্বংস হয়ে যেতে পারে না। একটি বিভাগের কয়েকজন অসাধু হতে পারেন, কিন্তু  এখনও সৎ মানুষের সংখ্যা বেশি। তাই এগিয়ে আসুন আপনারা, ঢেলে সাজান পরিবহন সেক্টরকে। একটি বিভাগের কয়েকজন অসাধু হতে পারেন, কিন্তু তারুণ্য বিশ্বাস করে, যেকোনও বিভাগে এখনও সৎ মানুষের সংখ্যা বেশি। তাই এগিয়ে আসুন আপনারা, ঢেলে সাজান পরিবহন সেক্টরকে।

৭.  তারুণ্য আপনাদেরই  প্রতীক্ষায়.. এগিয়ে আসুক যথাযথ কর্তৃপক্ষ, আসবে বিআরটিএ, আসবে ডিএমপি, আসবে প্রতিটি ট্রাফিক পুলিশ, আসবে পরিবহন মালিক সমিতিসহ সকলে। এই ক্ষেত্রে 'ঢাকার চাকা'র উদাহরণ মাথায় রেখে পুরো ঢাকা শহরের পরিবহন ব্যবস্থাকে সাজানো যেতে পারে। পরিবহন সেক্টরের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে জিজ্ঞাসা করি, আমাদের এই ছোট বাচ্চাদের এভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা অপদস্থ হতে দেখছেন, একটুও খারাপ লাগছেনা? দয়া করে তাদের পাশে এসে দাঁড়ান, তাদের কথা শুনুন, নিজেদের সংকটগুলো নিজেরাই চিহ্নিত করুন!

৮.  বাচ্চাদের এই প্রতিবাদের স্বরকে পুলিশি আক্রমণ দিয়ে নয়, ভালোবাসা, মমত্ববোধ, মানবিকতাবোধ ও দায়িত্ববোধের সাথে আমলে আনতে হবে, নয়তো এই প্রতিবাদ-মিছিলও ছিনিয়ে নিয়ে রাজনৈতিক খেলা শুরু হবে। তাই লাগাম এখনই টেনে ধরা জরুরি। আজ ৩/৪ দিন পার হয়ে যাচ্ছে, সমাধানের জন্য কোনও সুপরিকল্পিত উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না? রাস্তাঘাটে যত্রতত্র বাস এখনও থামছে, চলছে ড্রাইভারদের প্রতিযোগিতা। প্রয়োজন সংকট কাটিয়ে ওঠার সঠিক সমাধান, একটি নিরাপদ সড়ক। উন্নয়নশীল দেশে পৌঁছে যাওয়া একটি দেশের রাজধানী শহরের জন্য এটা কি খুব বেশি অন্যায় চাওয়া?

আমরা বিশ্বাস করতে চাই, এই মন্ত্রিপরিষদে কেবল বাচ্চাদের মৃত্যুর খবর শুনে হেসে উঠা মন্ত্রী নেই, আছে অনেক মানবিক মন্ত্রী, আছে দায়িত্বশীল নেতা! ২০০৯ সালে আমি তারুণ্যনির্ভর মন্ত্রিসভা নিয়ে "ফার্স্ট মিনিস্টার" নামে একটি অনুষ্ঠান করতাম চ্যনেল আইতে, তরুণেরা কথা বলেছিল প্রত্যেক মন্ত্রীর সাথে।  ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে "ফার্স্ট ভোটার" নামে একটি অনুষ্ঠান করতাম, সেখানে আমরা তরুণদের সাথে কথা বলতাম যারা কেমন নেতৃত্ব চায়, তা নিয়ে তাদের স্বপ্নের কথা বলতো।  সেসব  অভিজ্ঞতার জায়গা থেকেই বলছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০০৯ সালে তরুণ নেতৃত্বকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন একটা স্বপ্ন বা ভিশন নিয়ে। এখনও  তার  মন্ত্রিপরিষদে তরুণ নেতৃত্বকে প্রাধান্য দিচ্ছেন কেবল তারুণ্যের শক্তি ও সাহসকে ভালোবাসেন বলেই। তিনি তরুণদের ভাষা বোঝার জন্য, তারুণ্যকে আরও জাগ্রত করার জন্যই মূলত তরুণ নেতৃত্বকে সামনে নিয়ে আসছেন, তারুণ্যকে এভাবে একের পর এক ঘটনায় রাস্তায় অসহায়ভাবে নিপীড়িত হওয়ার দৃশ্য দেখার জন্য নিশ্চয় নয়। বঙ্গবন্ধুর দেশে তরুণ নেতৃত্বের এত সংকট থাকবে- এটা আমরা বিশ্বাস করতে চাই না। এগিয়ে আসুক তরুণ নেতৃত্ব তারুণ্যের প্রতিটি সংকটে, এই প্রত্যাশা রইলো।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কলেজ চত্বর থেকে অসুস্থ ভুবন চিল উদ্ধার
কলেজ চত্বর থেকে অসুস্থ ভুবন চিল উদ্ধার
নাহিদ সুলতানা যুথীসহ ৩ জনের জামিন আবেদন শুনতে হাইকোর্টের নতুন বেঞ্চ
নাহিদ সুলতানা যুথীসহ ৩ জনের জামিন আবেদন শুনতে হাইকোর্টের নতুন বেঞ্চ
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা সাকিবকে আমার বাসায় নিয়ে আসেন: হাফিজ উদ্দীন
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা সাকিবকে আমার বাসায় নিয়ে আসেন: হাফিজ উদ্দীন
রাজধানীতে মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার ২৩
রাজধানীতে মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার ২৩
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ