X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

ওদের কাঁদতে দিন, মৃত্যুর প্রতিবাদ করতে দিন

জোবাইদা নাসরীন
০১ আগস্ট ২০১৮, ১৬:৪৯আপডেট : ০১ আগস্ট ২০১৮, ১৬:৫৬

জোবাইদা নাসরীন ওরা সবাই স্কুল-কলেজের ড্রেস পরা। পুরো ঢাকা ঢেকে গিয়েছিল স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীতে। সহপাঠীদের মৃত্যু তাদের রাস্তায় দাঁড়  করিয়েছে। সহপাঠীদের জন্য এমন আবেগ, ভালোবাসা অনেক দিন দেখেনি বাংলাদেশ। কেউ কেউ রক্তাক্ত হয়েছে, রক্তে ভিজে গেছে সাদা জুতা। পুলিশ টেনেহিঁচড়ে বাধা দিচ্ছে কয়েকজনকে। এসব ছবি ভাইরাল হয়ে ঘুরেছে সারাদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
কর্মক্ষেত্রে যেতে আসতে অনেকেরই অসুবিধা হয়েছে। ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদীরূপে দেখে প্রথমে ভয় পেলেও প্রায় সকলের মুখেই কেমন যেন একটা স্বস্তি ছিল। ছিল এই কারণেই যে এতদিন যে প্রজন্মকে অনেকটা ‘আত্মকেন্দ্রিক প্রজন্ম বলে বাবা  মায়েরা হায়-হুতাশ করতেন, তারা আজ  নতুনরূপে সন্তানদের আবিষ্কার করছেন। কম্পিউটারে গেম খেললেও এই সন্তানদের ভিতরে আবেগ আছে, আছে বন্ধুর জন্য জীবন বাজি রেখে রাস্তায় নামার প্রতিজ্ঞা। কী এক অসাধারণ তাদের লড়াই। সবাই স্কুলের জামা পরেই একইসঙ্গে প্রতিবাদ করছে। বিমানবন্দর সড়কে বাসের চাপায় গত রোববার দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর প্রতিবাদে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সড়কে দুইদিন ধরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছে ঢাকার স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। বাসের চাপায় মারা যাওয়া দুইজন হলেন শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম ও বিজ্ঞান বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আব্দুল করিম রাজিব।

পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী গত ২৯ জুলাই দুপুরে কালশী ফ্লাইওভার থেকে নামার মুখে এমইএস বাসস্ট্যান্ডে ১৫/২০ জন শিক্ষার্থী দাঁড়িয়েছিল, হয়তো কোন বাসে উঠবে বলেই দাঁড়িয়েছিল। জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস ফ্লাইওভার থেকে নামার সময় মুখেই দাঁড়িয়ে যায়। এ সময় পেছন থেকে আরেকটি দ্রুতগতিসম্পন্ন জাবালে নূরের বাস ওভারটেক করে সামনে আসতেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। নিমিষেই ওঠে পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের ওপর। চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় দুইজন। এছাড়া আহত হন আরও ১৫/২০ জন শিক্ষার্থী।

এই নিহত এবং আহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত সোমবার ও মঙ্গলবার দিনভর সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়, ফার্মগেট, উত্তরা, মতিঝিল, মিরপুর, আগারগাঁওসহ কয়েকটি স্থানে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা দোষী ব্যক্তিদের ফাঁসি, নিরাপদ সড়কসহ নয়টি দাবিতে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছে। এতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে পুরো ঢাকা প্রায় স্থবির হয়ে যায়। ওদের কেউ কেউ সহপাঠীর জন্য কাঁদছে, বিক্ষোভ করছে, বিচার চাইছে, সবাইর কাছে বিচারের দাবি নিয়ে হাজির হচ্ছে। গত ৩০ জুলাই সকাল ১০টা থেকে রাজধানীর গুলশান, মিরপুর, বাড্ডা, উত্তরা ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকার অন্তত ১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জড়ো হন শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের সামনে। প্রথমে পুলিশ তাদের জোর করে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়ে বাসে তুলে দেন। এরপর বেলা সাড়ে ১০টার দিকে তারা একসঙ্গে কলেজ গেট থেকে এমইএস বিমানবন্দর সড়কে গিয়ে বিক্ষোভ করেন।

আমার চোখে ভাসছিল সেই দিয়ার বাসচালক বাবার মুখটা। ক্ষোভে দুঃখে বলছেন তিনি আর কখনও বাস চালাবেন না। বেশ কিছুদিন আগে পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ছবি দেখে হৃদয় মোচড় দিয়ে উঠেছিল। এক বাবা এসেছিলেন বিমানবন্দরে। প্রবাসে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে মারা যাওয়া দুই ছেলের লাশ গ্রহণ করতে। লাশের বাক্সের বাইরে দুই ছেলের ছবি। কোনটা কার লাশ বোঝার জন্যই হয়তো এই ব্যবস্থা। বিমানবন্দর থেকে বের করার পর হয়তো বৃষ্টি হচ্ছিলো। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছিল সেই ছবিতে। দরিদ্র বৃদ্ধ বাবা হাতের গামছা দিয়ে সেই ছবিতে পড়া ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি জীবনের সকল সঞ্চিত ভালোবাসা দিয়ে মুছছেন। গত দুদিন ধরে দিয়ার বাসচালক বাবার ছবি দেখছি আর মনে হচ্ছে  সেই বাবার কথা। তিনিও গাড়িচালক। আরেক গাড়িচালকের কারণেই নিভে গেছে অভাবের সংসারে বড় হওয়া, কলেজে ভর্তি হওয়ার আব্দার ছড়ানো ছোট্ট মেয়েটির জীবন।

তিনি মাত্র ১২৫০ টাকা পেতেন একবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাওয়া আসা করলে। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। আর স্বপ্ন ছিল বলেই মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন কলেজে। তার সেই স্বপ্ন ভেঙে যায় মেয়েটির মৃত্যুতে। মেয়েকে হারিয়ে বাবার হৃদয়ের গভীরে যে ক্ষত হয়েছে, সে ক্ষত মোছা যাবে না কখনও। পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়ে সেই ক্ষত মোছার চেষ্টা চলছে। আমি জানি না, কীভাবে, কোন প্রক্রিয়া মানুষের জীবনের ক্ষতি হিসেবে করা হয় অর্থের দাড়িপাল্লায়। আর কোন নিক্তিতে বা কোন যুক্তিতে অর্থের মানদণ্ডে মৃত্যুর ক্ষতি পুষিয়ে যায় বলে ভাবা হয়? এর আগেও আমরা দেখেছি এমপিপুত্রের গাড়িচাপায় পড়ে যখন আরেকজন গাড়িচালক নিহত হন তখনও সেটির দফারফা হয়েছিল টাকার বিনিময়ে। তাহলে জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি এখন টাকা কাজ করে।

শিক্ষার্থীরা জেনে রাখো, আমরা তোমাদের জন্য গর্বিত।  বন্ধুর জন্য তোমাদের আবেগ, ভালোবাসা তোমাদের নতুন করে চিনতে শিখিয়েছে। কেউ কেউ পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছো, মার খেয়েছো , তবু তোমরা সরে যাওনি।

সহপাঠীরা একে অপরকে ভালোবাসুক, বন্ধুরা একে অপরের জন্য জীবন দিতে রাজপথে নামুক। তাই সবাই সমস্বরে বলুন, ওদের আঘাত করবেন না,  বাধা দিবেন না, ওদের বন্ধুর জন্য কাঁদতে দিন, প্রতিবাদ করতে দিন। আর এভাবেই তো ওরা বুঝতে পারবে কীসের জন্য লড়তে হয়, কীসের জন্য রাজপথে নামতে হয়। ওরা শিশু বলেই ওদের ভয় কম,  ওরা শুধু জানে ওরা হারিয়েছে দুই বন্ধুকে, সেজন্য ঘাতকের ফাঁসি চাচ্ছে ।

সরকারকে বলতে চাই, বন্ধুর জন্য যারা রাস্তায় নামে তারা যেন প্রতিবাদ করার অধিকারটুকু ছোট বয়সেই না হারায় সেটির নিশ্চয়তা যেন সরকার দেন।  ওদের এই প্রতিবাদী মন যেন জিইয়ে থাকে, আমরা যেন ওদের জন্য সেই পরিসরটুকু রাখি! সবকিছু মানতে মানতে নিজেকে রাখার জায়গাটুকুও আমরা ক্রমশ হারিয়ে ফেলেছি।

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: [email protected]

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ
দ্বিতীয় বিয়ের চার দিন পর বৃদ্ধকে হত্যা, দুই ছেলে পলাতক
দ্বিতীয় বিয়ের চার দিন পর বৃদ্ধকে হত্যা, দুই ছেলে পলাতক
লখনউ ও চেন্নাইয়ের অধিনায়ককে ১২ লাখ রুপি জরিমানা 
লখনউ ও চেন্নাইয়ের অধিনায়ককে ১২ লাখ রুপি জরিমানা 
বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণ গেলো ইউপি সদস্যের
বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণ গেলো ইউপি সদস্যের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ