X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

কী রেখে গেলো কিশোর আন্দোলন?

লীনা পারভীন
০৬ আগস্ট ২০১৮, ১৭:০৯আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০১৮, ১৭:১৬

লীনা পারভীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাসে আরেকটি মাইলফলক যোগ হলো এই ক’দিনের কিশোর ছাত্রদের আন্দোলন। যতবার এই স্বাধীন বঙ্গে আমাদের রাজনীতিবিদেরা পথ হারিয়েছে ততবার তাদের সঠিক দিশা দেখিয়েছে ছাত্র-জনতা। ২০১৩ সালের কথা বারবারই বলতে হয়, হবেই। ২০১৩ সাল থেকে যারা শিক্ষা নিয়েছিল তারাই এখনও টিকে আছে আমাদের রাজনীতিতে। কিন্তু ক্ষমতা কখনও কাউকে এককভাবে শক্তিশালী করে না। হিসাবের শেষ ফলাফলটা জনগণই মিলিয়ে দেয়। সেটা আবারও দেখালো আমাদের উত্তর প্রজন্ম।
যে প্রজন্মকে নিয়ে আমরা হা-হুতাশ করেছি সেই প্রজন্মই বারবার আমাদের জবুথবু প্রজন্মকে ধাক্কা মেরে দেখিয়ে দিয়ে গেছে, যাচ্ছে। আসলে তারাই প্রকৃত দেশকে ধারণ করছে। এর থেকেও যদি আমাদের রাজনীতিবিদেরা শিক্ষা না নেয় তবে বলতেই হবে এরা মূর্খ, এরা আমাদের এখনও বুঝতে পারেনি। এরা ব্যর্থ হয়েছে প্রজন্মের পালস বুঝতে। এদের দিয়ে এই দেশ চলতে পারে না।
এই নতুন প্রজন্ম যেমন করে দেশকে বুকে ধারণ করছে সেটা সম্ভবত নিরাপদ সড়কের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন না হলে বুঝা যেতো না। ছাত্ররা বলছে, তোমরা আমাদের মাথায় গুলি করো, বুকে করো না। কারণ, এই বুকে বঙ্গবন্ধুর বসবাস। এরা মুক্তিযোদ্ধা হতে চাওয়া প্রজন্ম। এরাই আমাদের বাংলাদেশকে সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছে।

মন্ত্রী শাজাহান খান নিহত মীমের বাসায় গিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ছাত্রদের সব দাবি যৌক্তিক। অল্প কয়েকদিনেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেলো নিয়ম করলেই হবে না, সেটিকে প্রয়োগের জন্য লাগে কেবল আন্তরিকতা ও উদ্যোগ। নিয়ম মানতে বাধ্য করাটাও জরুরি। জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে হলে দরকার নিজেদের কাছে নিজেদের আস্থাবান হওয়া।

একেকটা আন্দোলনের দানা বাঁধে আর আমরা এক নতুন বাংলাদেশকে চিনতে পারি। নিরাপদ সড়কের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মাঝেই আমরা বুঝতে পারলাম আমাদের প্রশাসনের মাঝে কতটা দুর্বলতা আর কতটা ঘুণে ধরা অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। পরিবহন খাত আমাদের দেশে একটি বিশাল প্রতিষ্ঠান। সাধারণ মানুষের একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম হচ্ছে গণপরিবহন। অথচ এই খাতটি দিনের পর দিন রয়ে গেছে অবহেলিত ও উপেক্ষিত। দুর্নীতি ও অরাজকতার এক মহাউৎসব চলে এখানে। দলমত নির্বিশেষে চলে এখানে সমস্ত কাজকর্ম। সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান নিয়ে কাউকে নতুন করে বলার কিছু নেই।

নিরাপদ সড়কের দাবি তাই হয়ে উঠেছে আপামর জনতার প্রাণের দাবি। গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছে তাই। রমিজ উদ্দীন কলেজের দুজন ছাত্রছাত্রী হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন সে আন্দোলনকে অস্বীকারের কোনও উপায় ছিল না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তাঁর একাত্মতা জানিয়েছেন সেখানে। লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চালানোর লজ্জায় পড়েছেন আমাদের পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী এবং প্রচুর সাধারণ মানুষ। বাচ্চারা আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেছে কেমন করে সুশাসন কায়েম করা যায়। তাদের পরিচালনায় সমস্যা থাকতেই পারে আর সেটা ওদের কাজও না। কিন্তু যেমন করে আমাদের সবাইকে তারা বাধ্য করেছিল নিয়মের মধ্যে থাকতে, আমাদের প্রশাসনের ব্যক্তিরা কি পারেন না এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে? নিশ্চয়ই পারেন। কারণ, তাদের হাতে ক্ষমতা আছে, অর্থ আছে, সিস্টেম আছে, দরকার কেবল সিস্টেমকে বাস্তবায়নের মতো দেশপ্রেম ও সততা।

কিন্তু গোটা ঘটনাটিকে যেভাবে সামাল দেওয়ার প্রয়োজন ছিল আমাদের সরকার কি ঠিক সেভাবে পেরেছে সামাল দিতে? ছাত্ররা মাঠে নেমেছে আবেগ থেকে। সহপাঠী, বন্ধুর মৃত্যুর বিচার চাইতে। আমাদের সাংসদ-মন্ত্রীরা কেউ কি তাদের কাছে গিয়েছেন? কেউ কি একবার সামনে গিয়ে বলেছেন বাবারা তোমরা আমাদের যথেষ্ট লজ্জা দিয়েছো, শিক্ষা দিয়েছো, চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের অক্ষমতাকে দেখিয়ে দিয়েছো এখন তোমরা বাড়ি ফিরে যাও, স্কুলে ফিরে যাও। বাকি কাজগুলো আমাদের করতে দাও। না বলেননি। টিভিতে সাংবাদিকদের মাধ্যমে বলা আর দায়িত্ব নিয়ে সবার সঙ্গে এক হয়ে গিয়ে বলার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে।

একটা পর্যায়ে মনে হচ্ছিলো যেন সরকার এটিকে বাড়তে দিচ্ছে। পরেই মনে হলো কেনইবা বাড়তে দেবে? এতে তাদের লাভ কী? সামনে নির্বাচন। সরকারের একটি বিরাট সুযোগ ছিল নিজেদের জয়ী করে নেওয়ার। এই একটি বড় প্রজন্মের কাছে নিজের অবস্থানকে স্থায়ী করে নেওয়ার। কিছু সিদ্ধান্ত হতে পারতো সেই মাইলফলকের সহায়ক। এদেশের মানুষ আমাদের রাজনীতিবিদদের বিশ্বাস করে না। এই অবশ্বাসের বীজ ঢুকেছে আমাদের এই স্কুল-কলেজের প্রজন্মের মাঝেও। জনগণের বিশ্বাস অর্জন করতে না পারলে ক্ষমতায় থাকা সুবিধার হয় না। বারবারই চ্যালেঞ্জের সামনে পড়তে হয়। অনেক উন্নয়নের মাঝেও জনগণ ঠিক তাদের জীবনের উন্নয়নের জন্য আপনাদের বাহবা দিতে চায় না।

প্রশ্ন হচ্ছে কেন? কেন এই অনাস্থা বা অবিশ্বাসের জায়গাটি তৈরি হলো?

বর্তমান ক্ষমতাসীন দলটি সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে দেশ পরিচালনায় আছে। একটি দেশকে একই ধারায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অবশ্যই যে দলটি উন্নয়নের ধারক বাহক তাদের দীর্ঘ সময়ে ক্ষমতায় থাকা লাগে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে যেখানে প্রতিমুহূর্তে ইস্যু সামনে আসে সেখানে ক্ষমতায় থাকতে গেলে একটি বড় অংশের আস্থাকেও অর্জন করতে হয়। আমাদের সরকারের মাঝে এক শেখ হাসিনা ছাড়া আর কোনও একজন ব্যক্তির উপর সহজে আস্থা করা যায় না। থাকলে অন্তত তারাই ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কোনোরকম বিতর্ক ছাড়া অরাজনৈতিক আন্দোলনগুলোকে সামাল দিতেও পারতেন।

কেন ছাত্রদের সামাল দিতে পুলিশের লাঠি লাগবে? কেন সরকারি দলের লোকদের মাঠে নামা লাগবে? অ্যাকশনে যাওয়া লাগবে? কেন 'তৃতীয় পক্ষ' সুযোগ নিতে পারবে? এই জায়গাগুলো নিয়ে ভাবতে হবে অনেক। অযোগ্য কোনও মন্ত্রীকে ক্ষমতার ভাগ দিয়ে জনতার আস্থায় যাওয়া কঠিন হবে। সবাই আশা করেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হয়তো সঠিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তটি এবার নিয়েই নেবেন। পরিবহন খাতকে 'মাস্তানমুক্ত' করে ফেলবেন। জিম্মি জনগণকে মুক্তি দেবেন তিনি। কিন্তু না, তেমনটা করেননি। কেন করেননি জানা সম্ভব না। তবে যদি করতে পারতেন তবে তিনি আরও এক ধাপ হৃদয়ের মাঝে জায়গা কিনে নিতে পারতেন। বাংলাদেশের মানুষ এখন একমাত্র শেখ হাসিনাতেই সমাধান খোঁজে। আর কাউকে বিশ্বাস করে না, সামর্থ্যবান মনে করে না। এ লজ্জা আমাদের সবার, এ লজ্জা আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের। আবার আমাদের জনগণকেও বুঝতে হবে ৪৭ বছরে গড়ে ওঠা জঞ্জাল পরিষ্কার করা এত সহজ কাজ নয়। প্রশাসনের ভেতরে যেখানে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বসে আছে তাদের পরিষ্কার করতে না পারলে সরকার পরিচালনা এত সহজ হবে না।

আশা করছি এক শেখ হাসিনা নয়, এমন হাজারও শেখ হাসিনা আমাদের সামনে আসবে। পথ হারায়নি বাংলাদেশ। সঠিক সময়ে সঠিক দাবিতে জ্বলে উঠতে পারে বাংলাদেশ। আবারও এটাই আমাদের শিখিয়ে দিলো মীম ও সজীবের বন্ধুরা।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ