X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

নাবালকদের আন্দোলনে সাবালকদের ‘ধান্দা’

আনিস আলমগীর
০৭ আগস্ট ২০১৮, ১৪:০২আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০১৮, ১৪:১০

আনিস আলমগীর ১৪/১৫ বছরের ছেলেটি রাস্তার জ্যামে আটকানো গাড়ির গ্লাসে নক করে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইশারায় সিটবেল্ট লাগাতে বলে। আমিও তাকে ইশারায় জানাই সিটবেল্ট কাজ করছে না। উবার চালক পাশে বসা। সেও বুঝালো। তারপর ছেলেটি চলে যায়।
এরপর আসলো ১২/১৩ বছরের একজন কিশোরী। ইশারায় গ্লাস নামাতে বললো এবং নামানোর পর অনেকটা ধমকের সুরেই বললো, আঙ্কেল সিটবেল্ট লাগান। ছোটখাটো মেয়েটার ধমকে আমি এবং চালক দু’জন হেসে ওঠি। সে অবশ্য অর্ডার করেই চলে গেছে, হাসি দেখার টাইম নেই।
এটা ২ আগস্টের ঘটনা, ফার্মগেটের কাছাকাছি। গুলশান ২ থেকে ধানমন্ডির দিকে আসছিলাম। ২৯ জুলাই থেকে তারা রাম্তায় নেমেছে। সেদিন দুপুরে রাজধানীর র‌্যাডিসন হোটেলের উল্টোদিকে বাসচাপায় রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুল করিম সজীব ও দিয়া খানম মীম নিহত হলে তারা নিরাপদ সড়কের দাবিসহ নয় দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। আমি ১ আগস্ট ধানমন্ডি থেকে নিউমার্কেট যেতেও ধানমন্ডি এক নম্বর রোডে তাদের ট্রাফিক চেকিংয়ে আটকা পড়েছিলাম। রিকশাকে তারা লাইন ধরে চলা শেখাচ্ছিল তখন।
ফার্মগেটের ঘটনায় মনে হলো তারা আরও সংগঠিত হয়েছে। নিজেরা যে একটা মহৎ কাজ করছে, তারাও যে পারে এই আত্মবিশ্বাস বড়দের দেখিয়ে আনন্দ পাচ্ছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে তারা মোড়ে মোড়ে যানবাহনের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনছে। আবার গাড়ির কাগজপত্রও দেখেছে ঠিক আছে কিনা। সিনিয়র সিটিজেন অনেকে তাদের বাহবা দিচ্ছেন। নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করছেন। চারদিকে তাদের ঘিরে ক্যামেরা। মোটকথা এই বয়সে এমন স্বীকৃতি মাথা খারাপ করে দেওয়ার মতো। তাদের কিশোর আন্দোলন স্বীকৃতি পেতে চলছে রোল মডেল হিসেবে।
কিন্তু আমাদের খুদে ট্রাফিকরা এটা ভাবতে পারেনি যে লোকজন তাদের রাস্তায় ধীরগতির চেকিংয়ের জন্য টানা পাঁচ দিন সহ্য করলেও পরে চরম বিরক্ত হতে পারে। এই নাবালক কিশোর-কিশোরী ভাবেনি যে তাদের নিষ্পাপ, মহৎ একটি আন্দোলনে ঢুকে যাবে স্বার্থান্বেষী সাবালকরা। এখানে আসবে ফেসবুক সেলেব্রিটিরা লাইক আর ফলোয়ার বাড়াতে। সুখন-সালমানের মতো ইউটিউবাররা আসবে সাবস্ক্রাইবার বাড়তে। কারণ, তাদের যত সাবস্ক্রাইবার তত আয়। তারা ভাবেনি সাকিব খানের মতো তারকা সমর্থন দিয়ে বাজার ঠিক রাখলেও মাঠে নামবে না কিন্তু বাজার পড়ে গেছে এমন টিভি অভিনেতা অভিনেত্রী, গায়ক গায়িকারা আসবে তাদের সঙ্গে সেলফি তুলে বাজারে ‘রেট’ বাড়াতে।
যে ভয়াবহ বিষয়টি তারা একদমই বুঝেনি তা হচ্ছে তাদের আন্দোলনের এই ফুলবাগানে প্রবেশ করবে শিবির নামের বিষধর একটি সাপ, যেটি আবার কোটা আন্দোলনে ঢুকে বিভ্রান্ত করছে ডান-বাম-নিষ্পাপ সম্মিলিত ছাত্রসমাজের বড় একটা অংশকে। শিবিরের বি-টিম হিসেবে থাকবে ছাত্রদল। আর ক্ষমতালোভী এসব চক্রকে প্রতিহত করার জন্য পাল্টা হেলমেট নিয়ে নামবে ক্ষমতাসীন মাথামোটা ছাত্রলীগ।
আমি ফার্মগেট এলাকায় দীর্ঘ জ্যামে পড়ে উবার ছেড়ে পায়ে হেঁটে রওনা হয়ে ২ আগস্টই বুঝেছিলাম সেদিনই মনের আনন্দে বিনা বাধায় রাজপথ আন্দোলনের শেষ দিন তাদের। যে পুলিশকে তারা ‘চ্যাটের বাল’ বলছে কাল ‘বাটে’ পড়লে পুলিশ তাদেরকে পায়ে ধরিয়ে ছাড়বে। যে পুলিশকে কাগজপত্রের বৈধতা নেই বলে চ্যালেঞ্জ করছে, গাড়ি থেকে নামিয়ে দিচ্ছে, তারা এটা হজম করছে কিন্তু সেখান থেকে যে লাইভ ভিডিও যাচ্ছে সেটা তারা সহ্য করবে না।
হজম না করার কারণটা বুঝে গেলাম রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে। যখনই কোনও লোককে কাগজপত্রের জন্য আটকাচ্ছে নানা লোক তা লাইভ করছে। এরা বেশিরভাগই স্কুলছাত্র না। তারমধ্যে সিংহভাগ বয়সে তাদের চেয়ে অনেক বড়। সন্দেহজনক চেহারার। আর ইতোমধ্যে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ইনবক্স পুরে যাচ্ছিল সেসব লাইভ ভিডিওর লিংকে। সঙ্গে নির্দেশ- ‘এটিকে ভাইরাল করো’। ভিডিও চলে যাচ্ছে শিবিরের ফেসবুক পাতা বাঁশেরকেল্লাতে। হাজার হাজার শেয়ার হচ্ছে। লক্ষণীয় ছিল সেসব ভিডিওতে শিশুদের চেহারা কর্মকাণ্ড আর  ‘অপরাধীর’ চেহারা দেখানো হচ্ছে ভালো করে। একবারও ভিডিও যে করছে, যে ধারাবর্ণনা দিচ্ছে তার চেহারা নেই। পাক্কা শিবিরের প্রচারণা স্টাইলে। শিশুরা তো জানে না, সময় সুযোগে ভিকটিম অথবা প্রশাসন তাকেই অপরাধী করবে ভিডিও ফুটেজ ধরে ধরে।
বিবেকের টানে দুই দিন শিশু-কিশোরদের এই আন্দোলনকে সমর্থন দিলেও সে রাতেই মানে ২ আগস্ট রাত ১০টায় ঘটনা বুঝে আমি ফেসবুকে শিশুদের ঘরে ফেরার আহ্বান জানিয়ে লিখেছিলাম- ‘বাচ্চারা যা দেখানোর দেখিয়েছো। এবার দেখানোর কাজ সরকারের। এটাকে নিয়ে বিষধর সাপ শিবির রাজনৈতিক খেলা শুরুর আগে সুখস্মৃতি নিয়ে ঘরে ফিরে যাও’। পরদিন তারা ঘরে ফিরে যায়নি সবাই। আসলে তাদেরকে সংগঠিত করা, নির্দেশ দেওয়ার, সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে জানানোরও কেউ ছিল না। আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।
পরদিন শুক্রবার সরাসরি সেই সুযোগটা নিয়েছে অনুপ্রবেশকারীরা। সাদা শার্ট সংগ্রহ করে নেমে গেছে ‘কোমলমতি’ সেজে। সারাদেশ থেকে শিবির তাদের দাগী সন্ত্রাসীদের ঢাকায় এনে মিশিয়ে দেয় এই আন্দোলনে। শনিবার তার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ঝিগাতলাতে ছাত্রলীগের সঙ্গে এই শিশু-কিশোর এবং অনুপ্রবেশকারীদের। স্কুল ছেলেদের ড্রেস পরে মুখে কালো কাপড় বেঁধে তারা আক্রমণ করতে আসে ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ অফিসে। সংঘর্ষের মধ্যে ফেসবুক লাইভ চালায়। হাজার হাজার শেয়ার চলে এসব ফেসবুক লাইভের, ফেসবুক স্ট্যাটাসের। তারমধ্যে বেশি ভাইরাল হয় দুটি ভিডিও ক্লিপ।
একটি অভিনেত্রী নওশাবার। আরেকটি মুফতি হান্নানের কথিত ভাগ্নি এবং কোটা আন্দোলনের এক নেত্রীর, যিনি এসেছেন আবার নেকাব পরে। দু’জন ছাত্র হত্যা, ছাত্রী ধর্ষণের গুজব এতো নিখুঁতভাবে অভিনয় করেন যে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া না থাকলে দেশে হাঙ্গামায় যে কতজন মারা যেত বলা যায় না। নওশাবা লাইভ করেন উত্তরা থেকে কিন্তু দর্শকদের বুঝাতে চেয়েছেন তিনি ঝিগাতলা বা আশপাশে আছেন। কোটা আন্দোলনের নেত্রী লাইভ করেন ধানমন্ডির আনোয়ার মেডিক্যাল কলেজের পাশ থেকে, আশপাশ দিয়ে শান্তভাবে মানুষ চলাচল করছে দেখা যাচ্ছে অথচ তার অভিনয় ছিল সেখানে যেন কেয়ামত নেমেছে।
পরদিন রবিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বের হয়ে সাইন্স ল্যাবের কাছে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় প্রতিপক্ষের সাথে। ছাত্রলীগ অস্বীকার করলেও বুঝা যায় হেলমেটধারী আক্রমণকারীরা ছিল তারা, যাদের হাতে আহত হয় বেশ ক’জন সাংবাদিকও। অন্যদিকে সাংবাদিকদের ক্যামেরায় ধরা পড়ে স্কুল ড্রেস পরে শিবিরের কাণ্ড। ধাওয়া খেয়ে স্কুল ড্রেস পরা যুবক ব্যাগ থেকে বের করছে চাপাতি। তরুণরা সাধারণ ড্রেস ছেড়ে স্কুলের বাচ্চাদের ড্রেস পরছে। আর গোয়েন্দারা মিছিলে আবিষ্কার করেন শিবিরের পালিয়ে থাকা দাগী আসামিদের, মাদকের মামলায় পালানো যুবকদের। বের হয়ে পড়ে বিরোধী নেতাদের আন্দোলনে লোক জোগাড়ের ষড়যন্ত্রের ফোনালাপ। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে নিরাপদ বিদ্রোহের মাধ্যমে ক্ষমতার যেতে চাওয়ার স্বপ্ন ভেস্তে গেছে তাদের।
এই আন্দোলনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশেষ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে কোটা আন্দোলনের মতো জমজমাট করার চেষ্টা এখনও অব্যাহত থাকলেও শেষ পর্যন্ত বলা চলে এটি দীর্ঘায়ু পাবে না। ২৯ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট ২০১৮- নিরাপদ সড়কের জন্য নাবালক শিশুদের সাবালক আন্দোলনের আয়ুকাল ইতিহাসের হিসাবে লেখা হবে আট দিন। তবে নাবালক শিশু কিশোরদের সাবালক আন্দোলন, যেটি চোখে আঙুল দিয়ে জনগণ ও সরকারকে দেখিয়ে দিয়েছে রাস্তায় কতটা অনিয়ম চলছে, তা ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে লেখা থাকবে।
কারণ, তারা দেখিয়েছে এই দেশে সড়কে মানুষের জীবন কতটা জিম্মি হয়ে পড়েছে একটি দুর্বৃত্তচক্রের হাতে। সড়কে জীবনের মূল্য যেই সরকারের কাছে অর্থহীন ও অবহেলার বিষয় ছিল দিনের পর দিন– তারাও বাধ্য হয়েছে শিশুদের সব দাবি মেনে নিতে, মন্ত্রিসভায় সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নতুন আইন পাস করতে।
অবশ্য শেষটা আরও ভালো হতো যদি তারা ২ আগস্ট ঘরে ফিরে যেত। কারণ, তাদের যা দেখানোর তারা তা দেখিয়েছে, এখন ট্রাফিক-পুলিশের কাজ পুলিশকেই করতে হবে, শিশুদের সেটা কাজ নয়। ফুলের বাগানে অনুপ্রবেশকারী সাপ মারতে গিয়ে ফুলের মতো শিশুদের গায়ে হাত তোলা হয়েছে, সেটিরও বোধহয় প্রয়োজন পড়তো না সরকারের।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]


/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ধান শুকানোর জমি নিয়ে দুই গ্রামবাসীর সংঘর্ষ, আহত অর্ধশতাধিক
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ধান শুকানোর জমি নিয়ে দুই গ্রামবাসীর সংঘর্ষ, আহত অর্ধশতাধিক
দুই চিকিৎসকের ওপর হামলার প্রতিবাদে হাসপাতালে কর্মবিরতির ঘোষণা
দুই চিকিৎসকের ওপর হামলার প্রতিবাদে হাসপাতালে কর্মবিরতির ঘোষণা
১৯টি সামরিক সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ, ২৭টি নিয়ে আলোচনা চলছে
১৯টি সামরিক সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ, ২৭টি নিয়ে আলোচনা চলছে
সালাউদ্দিনের ছেলের অভিষেকের দিনে প্রাইম ব্যাংকের বড় জয়
সালাউদ্দিনের ছেলের অভিষেকের দিনে প্রাইম ব্যাংকের বড় জয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ