X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি কেন জামায়াত ছাড়তে পারে না?

আমীন আল রশীদ
১৯ আগস্ট ২০১৮, ১৫:০৯আপডেট : ১৯ আগস্ট ২০১৮, ১৫:১৬

 

আমীন আল রশীদ বিএনপিকে যখনই যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে বলা হয় বা জামায়াত ছাড়ার বিষয়ে তাদের ওপর চাপ বাড়ে, তখন তাদের তরফে বরাবরই একটি ক্লিশে জবাব আসে যে জামায়াতের সঙ্গে তাদের আদর্শিক কোনও ঐক্য নেই, বরং এটি নির্বাচনি জোট। প্রশ্ন হলো, আদর্শিক ঐক্য ছাড়া নির্বাচনি জোট হয় কিনা?
বছর কয়েক আগে বিএনপির একজন নীতিনির্ধারক, বিশেষ করে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে পরিচত এক সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনারা কেন জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে বেগম জিয়াকে কনভিন্স করেন না বা করতে পারেন না? জবাবে তিনি বলেছিলেন, জামায়াতের মতো একটি বিতর্কিত এবং উগ্র ডানপন্থী দলের সঙ্গে সংসার করতে হয়তো বেগম জিয়া নিজেও চান না। কিন্তু দলের ভেতরে একটি প্রভাবশালী অংশই মনে করে, জামায়াত ছাড়া রাজপথে আওয়ামী লীগের মতো অত্যন্ত শক্তিশালী দলকে মোকাবিলা করা কঠিন। কারণ, বিএনপি তার মাঠের শক্তি, বিশেষ করে তার ছাত্র ও যুব সংগঠনের শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে জানে। সুতরাং বিএনপি যখন সরকারে থাকে, তখন সরকারের বাইরে থাকা দল, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের আন্দোলন মোকাবিলা করতে এবং যখন সরকারের বাইরে থাকে তখন সরকারবিরোধী আন্দোলন জমাতে তাকে জামায়াতের মতো ক্যাডারভিত্তিক দলের আশ্রয় নিতে হয়।
অতীতের বিভিন্ন নির্বাচনি পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে বলা হয়, এককভাবে জামায়াতের ভোট বেশি না হলেও যখন তারা বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করে তখন সেই শতাংশ অনেক বেড়ে যায়। এতে বিএনপির সরকার গঠনে যতটা না লাভ হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা পায় জামায়াত নিজে। অর্থাৎ বিএনপি তার নির্বাচনি জোট বা ভোটের মাঠে শক্তিশালী আওয়ামী লীগকে মোকাবিলার জন্য জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলেও তাতে আখেরে লাভবান হয় জামায়াত।

তবে আন্দোলনের নামে সহিংসতা অথবা সহিংসতা মোকাবিলা—যাই বলা হোক না কেন, জামায়াতকে বিএনপির প্রয়োজন হলেও নির্বাচনি মাঠে যে তাকে ছাড়াই বিএনপি জিততে পারে তার সবশেষ উদাহরণ সিলেট সিটি নির্বাচন। কেন্দ্রের অনুরোধ সত্ত্বেও সিলেটে মেয়র পদে জামায়াতের প্রার্থী ছিলেন। অথচ সেখানে শেষ মুহূর্তে জাতীয় পার্টির প্রার্থীও আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও এখানে বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী জয়লাভ করেন। জামায়াত মাঠে না থাকলে তিনি হয়তো আরও হাজার দশেক বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়ী হতেন। কিন্তু জামায়াত তার বিরুদ্ধে থাকার পরও আওয়ামী লীগের বদরুদ্দিন কামরানের মতো শক্তিশালী প্রার্থী—যিনি এর আগে দুবার সিটি মেয়র ছিলেন, তার বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছেন এবং তাও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়। সুতরাং ভোটের মাঠে জামায়াতকে ছাড়াই বিএনপির চলে—এমন একটি উপসংহারে এখনই পৌঁছানো না গেলেও সিলেটের এই ঘটনাটি জামায়াত ছাড়ার ব্যাপারে বিএনপিকে নতুন করে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এরইমধ্যে বিএনপির তৃণমূল থেকেও জামায়াত ছাড়ার ব্যাপারে শক্তভাবে চাপ দেওয়া হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে।

সিলেট সিটি নির্বাচনে জামায়াত দাবি করেছিল তাদের প্রায় ৫০ হাজার ভোট আছে। কিন্তু দেখা গেলো, জামায়াতের প্রার্থী ভোট পেয়েছেন ১১ হাজারেরও কম। শুধু তাই নয়, তিনি জামানতও হারিয়েছেন। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, জামায়াত যে ৫০ হাজার ভোটের দাবি করেছিল, সেই ভোটগুলো কোথায় গেলো? আবার নির্বাচনে সরকারি দল কারচুপি করেছে—এমন অভিযোগও ওঠেনি। কারণ, কারচুপি হলে সরকারি দলের প্রার্থীই জয়ী হতেন। সুতরাং এখানেও একটি বিষয় পরিষ্কার যে বিএনপি বা অন্য কোনও বড় দলের বাইরে গিয়ে এককভাবে জামায়াত ভোটের মাঠে খুব বেশি সুবিধা করতে পারবে না। তাছাড়া হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী তাদের নিবন্ধনও স্থগিত রয়েছে। ফলে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের দল ও দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশও নিতে পারবে না। বরং তাদের দলের কেউ নির্বাচন করতে চাইলে হয় তাকে সিলেটের মতো স্বতন্ত্র অথবা অন্য কোনও দলের প্রতীকে দাঁড়াতে হবে।

দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি ও কারাদণ্ড হওয়া এবং জামায়াতের আর্থিক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় জামায়াত ক্রমশই একটি আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টিতে পরিণত হচ্ছে। যদিও এরকম একটি চরমপন্থী দলের আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়া দেশের রাজনীতির জন্য কতটা শুভ হবে, সেটি অন্য তর্ক।  কিন্তু একটা সময় পর্যন্ত দেশের রাজনীতিতে বড় দলের সহায়ক হিসেবে জামায়াতের যে গুরুত্ব বা শক্তি ছিল, সেটি এখন ক্ষয়িষ্ণু। তাছাড়া যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে সাধারণ মানুষের মনেও এই দলটির ব্যাপারে সচেতনতা বেড়েছে। একটা সময় পর্যন্ত সাধারণ মানুষের একটি অংশ যেমন ইসলামিক শক্তি হিসেবে তাদের ভোট দিতেন, তাদের অনেকেরই এখন চিন্তায় পরিবর্তন এসেছে। (মাঠপর্যায়ের রিপোর্টিং এবং রাজনীতি নিয়ে নানাবিধ আলাপচারিতায় এটি অন্তত আমার কাছে মনে হয়েছে। ভিন্ন মত থাকতে পারে।)

একটু পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। ১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট ডেমোক্রেটিক পার্টি, নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফতে রব্বানী পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ নামে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলেন এবং ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। ওই নির্বাচনে বিএনপি ২০৭টি, আওয়ামী লীগ ৩৯টি এবং মুসলিম লীগ ১৪টি আসনে বিজয়ী হয়। আর ইসলামিক ডেমোক্রেটি লীগ থেকে মনোনীত জামায়াতে ইসলামীর ৬ জন সদস্য নির্বাচিত হন। জাতীয় সংসদে জামায়াতের এটিই প্রথম উপস্থিতি।

তবে এককভাবে জামায়াত জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয় ১৯৮৬ সালে। তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা ৭৬টি আসনে মনোনয়ন দেয় এবং ১০টিতে জয়ী হয়। ১৯৮৮ সালের চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিরোধী দলগুলো বর্জন করে। ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি এবং ১৯৯৬ সালের ৩টি আসন লাভ করে। ১৯৯৯ সালে বিএনপি, ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী মিলে চারদলীয় জোট গঠন করে এবং ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ১৭টি আসনে জয়ী হয়। সবশেষ ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত দুটি আসনে জয়ী হয়। তবে বিএনপির জোটভুক্ত দল হিসেবে তারা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জন করে।

বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের ঐক্য আদর্শিক নয় বরং নির্বাচনি—এমন দাবি করা হয়। কিন্তু এ কথা অস্বীকারের তো সুযোগ নেই যে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির আদর্শের মিল রয়েছে। বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ও অনুভূতি নিয়ে রাজনীতি। জামায়াতের সঙ্গে আদর্শিক ঐক্য না থাকলে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি বিরোধিতাকারী একটি দলের একাধিক লোককে বিএনপি কী করে তাদের মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেয়?

তবে নির্বাচনি হোক আর আদর্শিক—জামায়াতের সাথে কোনও বড় দলের ঐক্য হতে পারে না। এবং এটির প্রয়োজনও নেই। বিএনপি এমনিতেই এখন নানারকম সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। দলের চেয়ারপারসন দুর্নীতি মামলায় কারাগারে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লন্ডনে। তিনিও সাজাপ্রাপ্ত। দেশে এলেই গ্রেফতার হবেন। আবার আমাদের দেশে বড় দুই দলের রাজনীতির চাবি যেহেতু এখন পর্যন্ত দুটি পরিবারের হাতে—সুতরাং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বা অন্য কেউ যে দলের হাল ধরবেন, সেই সম্ভাবনাও কম। ফলে এরকম একটি সংকটের মুহূর্তে জামায়াতের মতো একটি ক্ষয়িষ্ণু দলের বোঝা বিএনপি কেন বইবে—হোক সেটা আদর্শিক কিংবা নির্বাচনি জোট?

জামায়াত ছাড়লে বরং বিএনপির কিছু নগদ লাভ আছে। যেমন তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশই জামায়াতের অংশীদার বলে বিএনপিকে পছন্দ করে না। জামায়াত ছাড়লে তাদের অনেকেই হয়তো বিএনপিকে সমর্থন দেবে। জামায়াতের মতো স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধীদের দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ থেকে বিএনপি বস্তুত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খুব বেশি কিছু বলতে পারে না। যদিও বিএনপির ভেতরে অনেক খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। এই দলের প্রতিষ্ঠাতাও একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। ফলে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়লে মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে বিএনপির কথা বলার নৈতিক ভিত শক্ত হবে। বিএনপির ভেতরে যারা চান না জামায়াতের সঙ্গে তাদের ঐক্য থাকুক, তারা দলের প্রতি আরও একনিষ্ঠ হবেন এবং বিএনপি সবসময়ই যুদ্ধাপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়—এই অভিযোগ থেকেও তারা মুক্তি পাবে।

তবে খালেদা জিয়ার পরে বিএনপি যদি ভেঙে যায় তখন আওয়ামী লীগের ‍বিরোধী শক্তি হিসেবে জামায়াত নতুন নামে নতুন কর্মসূচি নিয়ে দেশের রাজনীতিতে নতুন কোনও মেরুকরণ তৈরি করতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করেন। এ কারণে মাঝে মধ্যে মনে হয়, বিএনপির কি এই আশঙ্কায় আছে যে তারা জামায়াতকে ছেড়ে দিলে এককভাবে জামায়াত দেশে আওয়ামীবিরোধী নতুন কোনও শক্তি হয়ে উঠবে, যা একসময় বিএনপির জন্যই হুমকি তৈরি করবে? অর্থাৎ জামায়াত যদি বিএনপির রাজনীতিটাই করে দেয়, তাহলে আর বিএনপিকে কী দরকার—এরকম একটি দূরবর্তী ভীতি কি বিএনপির মধ্যে কাজ করছে? কিন্তু একথা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত এই দেশে জামায়াতের মতো দল কখনোই এককভাবে কিছু করতে পারবে না। এককভাবে তারা বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের চেয়েও গৌণ।

লেখক: সাংবাদিক

 

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ