X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হোক কোরবানি

প্রভাষ আমিন
২২ আগস্ট ২০১৮, ১২:২৯আপডেট : ২২ আগস্ট ২০১৮, ১২:৩৫

প্রভাষ আমিন মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দু’টি- ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আযহা। দুই ঈদের দুইরকম তাৎপর্য। ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ আসে এক মাসের সিয়াম সাধনার পর আনন্দের বার্তা নিয়ে। আর ঈদুল আযহা বা কোরবানির ঈদ আসে ত্যাগের মহিমা নিয়ে। ছেলেবেলায় আমাদের কাছে কুরবানির ঈদ আসতো একই সঙ্গে আনন্দ আর শঙ্কা নিয়ে। চার হাজার বছর আগে আল্লাহ হযরত ইব্রাহীম (আ.)কে বলেছিলেন তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কোরবানি করতে। হযরত ইব্রাহীম ভেবে দেখলেন, তার সবচেয়ে প্রিয় আসলে সন্তান ইসমাইল। ইব্রাহীম আল্লাহর জন্য ইসমাইলকে কোরবানি দিতে নিয়ে গেলেন। শেষ মুহূর্তে আল্লাহ ইব্রাহীমের কোরবানি কবুল করলেন এবং ইব্রাহীমের ছুরির নিচ থেকে ইসমাইলকে সরিয়ে একটি দুম্বা দিয়ে দিলেন। এই হলো ছেলেবেলায় শোনা কোরবানির গল্প। আমাদের শঙ্কাটা ছিল, যদি ইসমাইলকেই কোরবানি দিতে হতো, তাহলে আমাদের বাবা-মাও আমাদের কোরবানি দিয়ে দিতো। তখন আমাদের কী হবে। অনেকে ক্ষেপাতো, তোকে তো সবাই অনেক ভালোবাসে, এবার তোকে কোরবানি দেবে। ভয়ে কুকড়ে যেতাম। ভয়ে ভয়ে দুয়েকবার আম্মাকে জিজ্ঞাসাও করেছি, আমাকে কোরবানি দিয়ে দেবে না তো? কোরবানি  দেবে না, এটা নিশ্চিত হওয়ার পরই মেতে উঠতাম ঈদের আনন্দে।

দুই ঈদের আনন্দও দুইরকম। এক মাসের সিয়াম সাধনার পর আসা ঈদুল ফিতর মানে রোজার ঈদে নতুন নতুন জুতা-পোশাক মিলতো। ঈদুল আজহার মূল বাজেট কোরবানির পশু কেনায়, তাই পোশাক-জুতার বাজেট থাকতো না। তবে ঈদুল আজহার মূল আনন্দ কোরবানির গরু কেনা, কয়েকদিন লালন-পালন করা এবং কোরবানি দেওয়ায়। সকালে ঈদের নামাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঈদগাহ ময়দানেই চলতো পশু জবাই। তারপর সবাই মিলে চলতো কাটাকুটি। মধ্যবিত্তের টানাটানির সংসার। তাই ছেলেবেলায় আমাদের কোরবানি হতো সাত শরিকে মিলে। মানে সাত জন মিলে একটা গরু কেনা হতো। কাটাকুটির পর হতো ভাগাভাগি। তবে মাংসের একটা অংশ চলে যেতো 'সমাজের তহবিলে'। সমাজের মাংস পেতো যারা কোরবানি দিতে পারেনি তারা। তার মানে কোরবানি ঈদে প্রত্যেকের ঘরে ঘরেই পৌঁছে যেতো মাংসের ভাগ। আমার বিবেচনায় কোরবানির ঈদের সবচেয়ে চমৎকার মনে হতো 'সমাজের মাংস'র এই ধারণাটি। এখন অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন কোরবানি না দেওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। কিন্তু ছেলেবেলায় আমাদের গ্রামে অনেকেই ছিলেন যাদের কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। সবার ঘরে মাংস পৌঁছে দেওয়ার এই সাম্যের ধারণার চেয়ে চমৎকার আর কী হতে পারে? অনেক মানুষ ছিলেন বা এখনও আছেন, যাদের জীবনে বছরে একবারই মাংস খাওয়ার উপলক্ষ আসে, কুরবানির ঈদে। এই সবার ঘরে ঘরে আনন্দ পৌঁছে দেওয়াটাই কোরবানির ঈদের মূল চেতনা। ত্যাগেও যে পাওয়ার আনন্দ আছে, ঈদুল আজহা আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেটাই। 

ছেলেবেলার সেই আনন্দ আর নেই। কিন্তু এখন ঈদুল আজহায় ত্যাগের চেয়ে দেখনদারির চেতনাই বেশি। কার গরু কার চেয়ে বড়, কার গরুর দাম বেশি- এই নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। কিন্তু গরুর সাইজের সঙ্গে আল্লাহর সন্তুষ্টির কোনও সম্পর্ক নেই, সেটা মনে হয় সবাই ভুলে যান। এবার দেখছি, ওজন করে গরু বিক্রি হচ্ছে। কত মণ মাংস হবে, মাংসের স্বাদ কেমন হবে, গরু দেশি না বিদেশি ইত্যাদি ইত্যাদিই দেখি আলোচনায়। মাংস সংরক্ষণের জন্য এই সময় ফ্রিজের বাজারও থাকে জমজমাট।   সর্বত্রই উৎসবের আমেজ। কোথাও ত্যাগের বেদনার ছোঁয়া দেখি না। দেখনদারির আড়ালে হারিয়ে যায় ত্যাগের চেতনা, আল্লাহর সন্তুষ্টির ভাবনা।

শুনলাম এবার নাকি টেক্সাস থেকে গরু উড়িয়ে আনা হয়েছে। না, গরুর পাখা গজায়নি। সৌভাগ্যবান গরু মহাশয় বিমানে চড়ে এসেছেন। একটি গরু নাকি বিক্রি হয়েছে ২৮ লাখ টাকায়। যিনি ২৮ লাখ টাকায় কোরবানি দেন, তার টাকা সৎ পথে উপার্জিত বলে মনে হয় না। একটা মজার কথা শুনলাম। একজন ঘুষখোর  নাকি কোরবানির গরু কেনেন বৈধ বেতনের টাকা দিয়ে। সেখানে ঘুষের টাকা মেশান না। তিনি হয়তো জানেন না এক মণ দুধ নষ্ট করার জন্য এক ফোটা চোনাই যথেষ্ট। এই ঘুষখোরের কথা শুনে আমার দু’টি গল্প মনে পড়ে গেল। এক মাতাল অনেক কসরত করে মদ খাচ্ছিল। পাশের জন জানতে চাইলো, সমস্যা কী? মাতালের উত্তর, পানি খাওয়ার সময় গোঁফে লাগলে সেটা হারাম হয়ে যায়। তাই গোঁফ বাঁচিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করছি। দ্বিতীয় গল্পটি শুনেছিলাম ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় গৌরিপুর সুবল আফতাব উচ্চ বিদ্যালয়ের হুজুর স্যারের কাছ থেকে। সেবার কুরবানির ঈদের আগে হুজুর স্যার বলেছিলেন, ধর তুই একটা গুরু চুরি করলি, তাতে তোর গুনাহ হলো। সেই গরু কুরবানি দিলি তাতে তোর সওয়াব হলো। গুনাহ আর সওয়াবে কাটাকাটি। মাঝখানে তোর লাভ হলো মাংস। শিশু মনে স্যারের সেই গল্প দারুণ প্রভাব  ফেলেছিল। আজো চারপাশে মাংসলোভীদের ভিড়ই বেশি দেখি। সারাবছর দুর্নীতি করে, ঘুষ খেয়ে, মানুষ ঠকিয়ে, প্রতিহিংসা করে, মিথ্যা বলে, প্রতারণা করে বিশাল একটা গরু কোরবানি দিলে কয়েক মণ মাংস হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু আল্লাহর কৃপা পাওয়া যাবে না। আগে আমাদের ভালো মানুষ হতে হবে, ভালো মুসলমান হতে হবে। আমাদের কথায়, কাজে, আচরণে যেন অপর মানুষের ক্ষতি না হয়, কারো মনে কষ্ট না হয়।

আপনি গরু না ছাগল? গত ক’দিন এ প্রশ্ন শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। তবে ফেসবুকে আপনি কিছু গরুর দেখা পেয়ে যাবেন। জবাই করা গরুর ওপর বসে সেলফি তোলার মত গরুর সংখ্যাও কম নয়। ফেসবুকেই আবার কিছু জ্ঞানী মানুষ ত্যাগের মহিমাকে আড়াল করে কোরবানির নিষ্ঠুরতা, রক্ত, জবাই ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেন। অবলা প্রাণীদের নির্বিচার নিধন নিয়ে আবেগাপ্লুত হই। একদিনে দেশে পশুসম্পদের বিশাল ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, ইত্যাদি বলে কোরবানি বিরোধী একটা জনআবেগ তৈরির চেষ্টাও দেখি কারো কারো মধ্যে। কোরবানি ১৪শ’ বছরের পুরোনো ধর্ম ইসলামের অন্যতম বিধান। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ তা অনুসরণ করে। তাই নিজেকে স্মার্ট প্রমাণ করতে কোরবানিকে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা মানে বিশালসংখ্যক মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া। সব কুরবানির চাহিদা মেটাতে দেশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য খামার। গতবছর দেশে কোরবানি হয়েছে ১ কোটি ৫ লাখ পশু। এবার চাহিদা আরও বেশি। এবং পুরো চাহিদা দেশি গরুতেই মেটানো সম্ভব। নিষ্ঠুরতার বিবেচনায় কয়েকবছর কোরবানি বন্ধ রাখলে আর খামার চালু রাখলে গরু আর মানুষ সমান সমান হয়ে যাবে। অবশ্য জবাই করা গরুর সঙ্গে সেলফি তোলার মত গরুর সংখ্যাও কম নয়।

তবে নিষ্ঠুরতার বিষয়টি  একদম উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়। 

আল্লাহ কিন্তু সবাইকে দেখিয়ে কোরবানি দিতে বলেননি। ছেলেবেলায় শুধু আমাদের বাড়ির মসজিদের মাঠে কোরবানি হতো। কিন্তু ঢাকায় পাড়া-মহল্লায়, রাস্তার মোড়ে, বাসার সামনে চলে অবাধে কোরবানি। অথচ দু’দিন আগে পত্রিকায় দেখেছি জবাইয়ের জন্য শুধু ঢাকায় ৬০২টি স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে কোরবানি দিলেই কিন্তু কারও কাছে সেটাকে নিষ্ঠুরতা মনে হবে না। অথচ আমরা নারী, শিশু, ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক, ধর্ম- কোনও কিছু বিবেচনা না করে নিজের বাসার সামনে গরু জবাই করি। রক্তটা দিনভর সেখানে থাকে, বর্জ্যও আমরা আশপাশে ফেলে রাখি। দুর্গন্ধ ছড়ায়, জীবানু ছড়ায়। আমাদের কোনও পরোয়া নেই। নিজের মাংসটা নিয়ে ফ্রিজ ভর্তি করতে পারলেই আমার কাজ শেষ। বাকি কাজ যেন সিটি করপোরেশনের। পরিচ্ছন্নতাটাও কিন্তু ঈমানের অঙ্গ। 

ইদানিং ফেসবুকে একটা স্লোগান দেখি 'বনের পশুকে নয়, মনের পশুকে করো জবাই'। স্লোগানটি আমার অর্ধেক ভালো লাগে। বনের পশুকে জবাই করার পাশাপাশি যদি আমরা মনের ভেতরে থাকা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ যদি আমরা জবাই করতে পারতাম; তাহলে পৃথিবীটা আরও বেশি বাসযোগ্য হতো, সৃষ্টিকর্তা আরও বেশি খুশি হতেন।

 

লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এসএসএ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রজন্মের জন্য দুই মহাবিপদ!
প্রজন্মের জন্য দুই মহাবিপদ!
বরিশালে ঈদে বেড়াতে এসে দুই চাচাতো বোনসহ ৩ জন লাশ
বরিশালে ঈদে বেড়াতে এসে দুই চাচাতো বোনসহ ৩ জন লাশ
রুশ হামলা ঠেকানোর ক্ষেপণাস্ত্র ফুরিয়ে গেছে: জেলেনস্কি
রুশ হামলা ঠেকানোর ক্ষেপণাস্ত্র ফুরিয়ে গেছে: জেলেনস্কি
পাকিস্তানের বিশ্বকাপ জয়ী মুশতাক বাংলাদেশের স্পিন বোলিং কোচ
পাকিস্তানের বিশ্বকাপ জয়ী মুশতাক বাংলাদেশের স্পিন বোলিং কোচ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ