X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

নির্বাচনে বিএনপির আসা, না আসা

বিভুরঞ্জন সরকার
২৩ আগস্ট ২০১৮, ১২:৪২আপডেট : ২৩ আগস্ট ২০১৮, ১২:৪৪

বিভুরঞ্জন সরকার একাদশ সংসদ নির্বাচনের আর বেশি দিন বাকি নেই। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে আগামী চার মাসের মধ্যে নির্বাচন হওয়ার কথা। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনি তৎপরতা শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক মাস আগে থেকেই প্রকাশ্য সভা-সমাবেশে আগামী নির্বাচনে আবারও নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও প্রচারণায় নেমে পড়েছেন। গরু কোরবানি দেওয়ার মধ্য দিয়ে নির্বাচনি প্রচারণা নতুন মাত্রা পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। আগামী নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে আওয়ামী লীগ সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হবে বলে শোনা যাচ্ছে। বিতর্কিত মন্ত্রী, এমপি, নেতারা এবার মনোনয়ন বঞ্চিত হবেন— এটা বলা হচ্ছে। ক্লিন ইমেজের অনেকেই নাকি এবার মনোনয়ন পাবেন। নানা কারণে যারা সমালোচিত হয়েছেন, বিতর্কিত হয়েছেন, তাদের মনোনয়ন দেওয়া না হলে আওয়ামী লীগের জন্য ভালো হবে। এবার একতরফা নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা কম। আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হওয়ারই কথা। শাসক দল আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার সুযোগ এবার পাবে বলে মনে হয় না। তবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া না-নেওয়ার বিষয়টি বিএনপি এখনও স্পষ্ট করেনি। নির্বাচন নিয়ে নানা কথা চালু আছে। বাজারে যেসব কথা ছড়ায়, তার সবটুকুই স্রেফ গুজব বলে মনে করারও কোনও কারণ নেই। যা রটে তার কিছু না কিছুতো বটে!

বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত আগামী নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে কী হবে? সরকার কি আরও একটি একতরফা নির্বাচনের ঝুঁকি নেবে? আবার উল্টো এ প্রশ্নও আছে, বিএনপি কি আরেকবার নির্বাচন বর্জনের বোকামি করবে? এই দুটি প্রশ্নের উত্তরের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। সরকার তথা আওয়ামী লীগ যেমন আরেকটি বিতর্কিত নির্বাচন করতে চায় না, তেমনি বিএনপিও আর নির্বাচনের বাইরে থেকে দলকে অস্তিত্ব সংকটের মুখে ঠেলে দিতে চায় না। সেই হিসেবে বলা যায়, সরকার বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে চাইবে, আবার বিএনপিও নির্বাচন থেকে দূরে থাকতে চাইবে না।

বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার জন্য কিছু শর্ত উল্লেখ করছে। আগে তাদের দাবি ছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি। বিএনপি যদি এসব শর্ত নিয়ে অনমনীয় মনোভাব দেখায়, তাহলে সরকার কী করবে, তা স্পষ্ট নয়। আবার এটাও দেখার বিষয়, বিএনপি কতটুকু দৃঢ় থাকবে বা থাকতে পারবে? বিএনপির পক্ষে আন্দোলন করে সরকারের কাছ থেকে কোনও দাবি আদায় করা সম্ভব কিনা সে প্রশ্নও আছে। বিএনপির আন্দোলনের প্রতি আওয়ামী লীগ বরাবরই উপেক্ষার মনোভাব দেখায়। আগামীতেও তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না।

সংবিধানে এখন আর নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান নেই। তাই  আগামী নির্বাচন যে দলীয় সরকার তথা শেখ হাসিনার অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিএনপি যদি সরকারের ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করতে না পারে, তাহলে বর্তমান ব্যবস্থাতেই তাদের নির্বাচনে যেতে হবে। বাকি থাকলো খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রশ্ন। এটা এক দিকে যেমন আইনি বিষয়, তেমনি আবার রাজনৈতিক বিষয়ও। আর মাত্র দুটি মামলায় জামিন পেলেই খালেদা জিয়া মুক্তি লাভ করবেন। তাকে নতুন কোনও মামলায় না জড়ালে তিনি হয়তো শিগগিরই জেল থেকে বের হবেন। খালেদা জিয়া মুক্তি পেলে বিএনপির পক্ষে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়তো সহজ হবে। তবে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থার বাইরে যাবে না আওয়ামী লীগ।

নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে নেওয়ার প্রশ্নেও আওয়ামী লীগ ছাড় দেবে কিনা, তাও এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বর্তমান সংসদে প্রতিনিধিত্ব না থাকলে নির্বাচনকালীন সরকারে থাকা সম্ভব নয়। বর্তমান সংসদে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব নেই। সে হিসেবে নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপির থাকার কথা নয়।

সরকার যদি বিএনপিকে সুযোগ দিতে চায় এবং বিএনপিও যদি সহযোগিতার মনোভাব দেখায়, তাহলে নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপির থাকার একটি উপায়ও বের হতে পারে। কথায় আছে, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। সংবিধানে টেকনোক্রেট কোটায় শতকরা ১০ ভাগ মন্ত্রী নিয়োগের বিধান আছে। এই বিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্য না হয়েও মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ আছে। নির্বাচনকালীন সরকারে বিএনপিকে এই সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।

আগামী নির্বাচনেই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিএনপি মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিএনপি মনে করছে, দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তারা জয়লাভ করবে। তাই তারা দলীয় সরকার এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে যেতে চায় না। বিএনপিকে শুধু জয়ের মনোভাব থেকে সরে আসতে হবে। জয়-পরাজয় যাই হোক, নির্বাচন থেকে দূরে নয়– এই স্পিরিটে মাঠে নামলে বিএনপির জন্য ভালো হবে। কারণ, আওয়ামী লীগ বা সরকার পরাজিত হওয়ার জন্য নির্বাচন করবে বলে মনে হয় না। বিএনপি যদি বিরোধী দলে বসতে রাজি থাকে, তাহলে সরকার তাদের প্রতি মনোভাব বদলাতে পারে। আর বিএনপি যদি সরকার পতনের আন্দোলনের চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকে, তাহলে রাজনীতির পরিবেশ সংঘাতময় হয়ে উঠতে পারে। বিএনপির আন্দোলন হুমকির জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপি অচিরেই টের পাবে ‘কত ধানে কত চাল’! অর্থাৎ বিএনপি নমনীয়তা না দেখালে সরকারও কঠোরতাই দেখাবে।

আগামী নির্বাচন নিয়ে রাজনীতির নেপথ্য কুশীলবরা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘দেশে-বিদেশে গোপন বৈঠক হচ্ছে'। তিনি আর একটি এক/এগারোর ষড়যন্ত্রের কথাও বলেছেন। এসব আশঙ্কা অমূলক নয়। ড. কামাল হোসেনকে সামনে রেখে একটি তৎপরতা আছে। আবার আওয়ামী লীগ বিরোধী একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ার চেষ্টাও আছে। ওবায়দুল কাদের এটাও বলেছেন যে, ‘সরকার যথেষ্ট সতর্ক ও প্রস্তুত রয়েছে'। তবে সরকারের সাম্প্রতিক কিছু কার্যক্রম দেখে কারও কারও মনে হচ্ছে— সরকারের সতর্কতা ও প্রস্তুতিতে ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে, তাতে সংকট মোকাবিলায় সরকারের দক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বল প্রয়োগ করে, মামলা দিয়ে ছাত্রদের গ্রেফতার করার কৌশলটি অনেকের কাছেই সঠিক বলে মনে হচ্ছে না।

রাজনৈতিক শক্তি অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন এবং ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন একইভাবে মোকাবিলা করতে গেলে ফল ভিন্ন হবে। পথ পিচ্ছিল, কাজেই পা ফেলতে হবে দেখেশুনে, হিসাব করে। সরকার নিজেদের যতটা নিরাপদ ভাবছে, ততটা নিরাপদ তারা কিনা তা ভালোভাবে যাচাই করে দেখা দরকার। আবার বিরোধী শক্তিকে যতটা দুর্বল ভাবা হচ্ছে, সত্যি তারা ততটা দুর্বল কিনা সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নয়।

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নেতারা কথার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। ওবায়দুল কাদের এবং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের প্রতিদিনের বাহাস শুনে যেকারও এটা মনে হতে পারে যে, আমাদের দেশে বুঝি যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। যেকোনও শুভ সকালে যুদ্ধ শুরুর ঘোষণা শোনা যাবে। নেতারা কথার বোমা ফাটিয়ে পরিবেশ গরম করছেন। এগুলো বন্ধ হওয়া দরকার। অহেতুক কথার উত্তাপ ছড়িয়ে রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত করে তোলার কোনও প্রয়োজন নেই। দেশে নির্বাচন আসছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার পরিবর্তনের একমাত্র পথ নির্বাচন। কাজেই নির্বাচন যাতে ভালোভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে সে লক্ষ্যেই সবার কাজ করা উচিত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জানতেন, মানুষ তার পক্ষে আছে। তাই নির্বাচনে অংশ নিতে তিনি বাহানা করেননি। ইয়াহিয়ার সামরিক আইনের কাঠামোর মধ্যেই তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, আগামী নির্বাচনে মানুষ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে কিনা? জোর জবরদস্তির নির্বাচন হবে কিনা? এসব প্রশ্নের উত্তর একটাই— মানুষ যদি অধিকার বঞ্চিত হয়, তাহলে পথ বেছে নেওয়ার দায়িত্বটা মানুষের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত। রাজনৈতিক নেতৃত্ব পিছিয়ে থাকেন, ভুলও করেন কিন্তু জনতা ভুল করে না। বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নিয়ে জনতার শক্তির ওপর আস্থা রেখে দেখতে পারে, তাদের দুঃসময় কাটলে কাটতেও পারে।

/এপিএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ