X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

এক-এগারোর গন্ধ!

আমীন আল রশীদ
২৭ আগস্ট ২০১৮, ১৭:৫৫আপডেট : ২৭ আগস্ট ২০১৮, ১৯:৩০

আমীন আল রশীদ দেশের রাজনীতির বহুল আলোচিত/বিতর্কিত টার্ম ‘ওয়ান ইলেভেন’ বা ‘এক-এগারো’। এই টার্মটি আবারও আলোচনায়। ১১ বছর আগে, অর্থাৎ ২০০৭ সালের এই দিনে ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার—যা সেনাসমর্থিত বলে আখ্যায়িত হয়। প্রায় দুই বছর তারা ক্ষমতায় থাকে এবং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর তাদের অধীনে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।
বেশ কিছুদিন ধরেই আবার রাজনীতিকদের মুখে মুখে ফিরছে এই ওয়ান ইলেভেন বা এক-এগারো। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে তারা আবারও এক-এগারোর গন্ধ পাচ্ছেন। মানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন। এই গন্ধ সৃষ্টির পেছনে তারা বিএনপি, কিছু কূটনীতিক এবং কোনও কোনও গণমাধ্যমকেও দায়ী করছেন। পক্ষান্তরে বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকারই এক-এগারোর পরিস্থিতি তৈরি করছে।
২০০৭ সালে এক-এগারোর পরিস্থিতি কারা তৈরি করেছিল? বিএনপির ক্ষমতা ছাড়তে না চাওয়া এবং নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতে পছন্দের বিচারকের বয়স বাড়ানো ইত্যাদি নানাবিধ তৎপরতা কি তারা চালায়নি? এর প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠার আন্দোলন, রক্তক্ষয়—তারপরই তো এক-এগারো। অর্থাৎ এক দলের ক্ষমতায় থাকতে চাওয়া এবং আরেক দলের ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াই—যার পরিণতি ওয়ান-ইলেভেন।

যদি নির্মোহ প্রশ্ন করা হয় যে, কাদের কারণে ওয়ান-ইলেভেন এসেছিল? জবাব—বিএনপি। আর যদি প্রশ্ন করা হয়, কারা এর সুবিধা ভোগ করেছে? জবাব—আওয়ামী লীগ। মাঝখানে দুই বছর আরাম-আয়েশ করেছেন কিছু অনির্বাচিত ব্যক্তি।

ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনকে কেউ দাওয়াতে করে আনেনি। বরং রাজনীতিকরাই তাদের আগমনের পথ তৈরি করে দিয়েছেন। তাদের দুর্নীতি-লুটপাট-সংবিধান লঙ্ঘনসহ নানা কারণেই এক-এগোরোর পথ প্রস্তুত হয়। এখন আবার সেই একইরকম বাস্তবতা রাজনীতিকরাই তৈরি করছেন। রাজনীতিকরা ওয়ান-ইলেভেন আনেন এবং আখেরে তারাই এর সুবিধা ভোগ করেন।

সৈয়দ আবুল মকসুদের ভাষায়, ‘তিন উদ্দিন’ (ফখরুদ্দিন, ইয়াজউদ্দিন, মঈনুদ্দিন) সরকারের দুই বছরের কর্মকাণ্ড যাই হোক—ওই সময়ে মাঠেঘাটে মানুষের মুখে একটা কথা শুনেছি যে, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এরকম একটা পরিবর্তন দরকার। তাহলে রাজনীতিকদের মুখোশ উন্মোচন যেমন হয়, তেমনি কিছু দুর্নীতিবাজ—যারা নিজেদের আইন-কানুনের ঊর্ধ্বে মনে করেন, তাদের কেউ কেউ ফাঁদে পড়েন। যদিও এটি গণতান্ত্রিক নয়। রাজনীতিকরা অগতান্ত্রিক আচরণ করেই বলে অগণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসে। সুতরাং দায়টা তাদেরই।

আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে যদি আবারও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংঘাতময় হয় এবং কোনও অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসে—সেই দায়ও রাজনীতিকদেরই নিতে হবে। যদিও নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা আগামী অক্টোবরেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে। কিন্তু বিএনপি বলছে, সমঝোতা না হলে তারা তফসিল মেনে নেবে না। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের তরফে বলা হচ্ছে, অক্টোবরে নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠিত হবে—যার আকার হবে ছোট। তারা নির্বাচনের আগ পর্যন্ত কেবল রুটিন কাজ করবে। সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনাই সেই সরকারের প্রধান থাকবেন।

শুরু থেকেই বিএনপির দাবি, নির্বাচনকালীন এমন একটি সরকার গঠন যার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা থাকবেন না। কিন্তু বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী সেটি সম্ভব নয়। কারণ, নির্দলীয় কাউকে দিয়ে অন্তর্বর্তী বা নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। আবার শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কারও নেতৃত্বে সরকার গঠিত হবে—তারও সম্ভাবনা ক্ষীণ।

সুতরাং যদি শেখ হাসিনাই সরকারের প্রধান থাকেন এবং নির্বাচন কমিশন যদি তফসিল ঘোষণা করে—বিএনপির ঘোষণা অনুযায়ী তারা সেটি মানবে না। না মানলে কী হবে? তারা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো এবারও নির্বাচন বর্জন করবে? দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে সরকার যদি ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন করতে চায়, তাহলে সেই নির্বাচনে বিএনপি কেন যাবে? যদিও বিএনপি এবারও নির্বাচন বর্জন করলে সেটি রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে কতটা সুবিধা বা অসুবিধায় ফেলবে—তা এ মুহূর্তে বলা কঠিন। আবার যদি তারা তফসিল না মেনে রাজপথে দাবি আদায়ের জন্য তৎপর হয় এবং রাজনীতি যদি সংঘাতময় হয়ে ওঠে, তখন যে ওয়ান-ইলেভেন বা এক-এগারোর গন্ধ পাচ্ছেন রাজনীতিকরা—সেটির আশঙ্কাও তো থেকে যায়।

তবে শুধু নির্বাচনকালীন সরকারই নয়, খালেদা জিয়ার মুক্তিও বিএনপির সামনে এখন বড় সমঝোতার ইস্যু। আপাতদৃষ্টিতে খালেদা জিয়ার জামিন ও মুক্তি আদালতের বিষয়। সুতরাং তাদের আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

এখন কথা হচ্ছে বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগ এমন কোনও সমঝোতায় আসবে যেন আওয়ামী লীগ নির্বাচনে হেরে যায় বা রাজনৈতিকভাবে বিএনপি সুবিধা পায়? আবার আওয়ামী লীগকে এরকম সমঝোতায় রাজি করানোর মতো শক্তি কি এ মুহূর্তে বিএনপির আছে? 

শুল্কমুক্ত সুবিধায় এমপিদের গাড়ি ও তাদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বাইরে আর কোনও ইস্যুতে সরকারি ও বিরোধী দলের সমঝোতা বা ঐক্যর নজির নেই। তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক সমঝোতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন। যদিও সেই সমঝোতায় আসতে বাধ্য হয়েছিল বিএনপি।

১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের তীব্র আন্দোলনের মুখে নির্বাচনকালীন এই নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেওয়া হয় এবং সংক্ষিপ্ততম ওই সংসদে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস হয়। কিন্তু তারপরও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা বড় সমঝোতা হিসেবেই বিবেচনা করা যায়; যে সমঝোতার কথা এখন বিএনপি বলছে। তারা যে নির্বাচনকালীন একটি অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা চালু করেছিল, পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সেটি বাতিল করে দেয়। এখন সেই বিএনপিই আবার এই ব্যবস্থা চালু করার দাবি জানাচ্ছে। অথচ এই পদ্ধতির দাবিতে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের সময় তৎকালীন সরকারপ্রধান খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়।’ নির্মম পরিহাস এই যে, বিএনপি এখন নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে কোনও একজন পাগল বা শিশুকেই চায়—যিনি ‘নিরপেক্ষ’।

এ রকম পরিস্থিতিতে সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ইঙ্গিত দিয়েছেন, সেপ্টেম্বরেই একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় হতে পারে। এই মামলার অন্যতম প্রধান আসামি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান—যিনি এরইমধ্যে দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। গ্রেনেড হামলা মামলার রায়েও যে তার বড় ধরনের সাজা হবে—সে বিষয়ে সন্দেহ কম। ফলে জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে-সঙ্গে দেশের রাজনীতিতে নিত্য নতুন ঘটনা ঘটতে থাকবে এবং পরিস্থিতি বেশি জটিল হলে তখনই তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নেয়। আবার কখনও রাজনীতিকরা নিজেরাই পরিস্থিতি ঘোলা করে তৃতীয় পক্ষকে সুযোগ দেন। তখন সেই তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে তাদের গোপান আঁতাতও হতে পারে। কারণ, তৃতীয় পক্ষও জানে, তারা বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। কিছু সময় থাকবে এবং সেই সুযোগে অনির্বাচিত কিছু লোকের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়বে। অনেকে সারা জীবনে যা কল্পনা করেন না, তাই হয়ে ওঠেন। মূলত রাজনীতিবিদদের এই আত্মবিধ্বংসী প্রবণতাই বারবার দেশকে পিছিয়ে দেয়। কিন্তু তারা যদি বারবার এক-এগারোর গন্ধ পাওয়ার কথা বলতে থাকেন, তাতে একদিন সত্যি সত্যিই এরকম একটি পরিস্থিতি তৈরি হবে এবং সেই মিথ্যাবাদী রাখালের গল্পেরই পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।

লেখক: সাংবাদিক।

 

/এসএএস/এমএনএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ