X
মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪
৩১ বৈশাখ ১৪৩১

কিছু নিষ্ঠুরতা মৃত্যু কামনা করতে শেখায়

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২৯ আগস্ট ২০১৮, ১৬:১৮আপডেট : ২৯ আগস্ট ২০১৮, ১৬:২২

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন, অন্য নীতিনির্ধারকরাও বলছেন– নিরাপদ সড়কের দাবিতে সম্প্রতি স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সবার চোখ খুলে দিয়েছে। সরকারের ভেতর কিছুটা সিরিয়াসনেসও দেখছি আমরা। দ্রুততার সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সভায় সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া অনুমোদিত হয়েছে (যদিও এই আইনের নানাদিক নিয়ে প্রশ্ন আছে), সড়কে শৃঙ্খলা আনয়নে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সচিবের নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠিত হয়েছে এবং সড়কে মহাসড়কে ধীরগতির যান চলাচলের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
কিন্তু পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের মনোজগতে এই আন্দোলন, এই সরকারি উদ্যোগ, সাধারণ মানুষের উদ্বেগ কোনও প্রভাব রেখেছে বলে মনে হয় না। এখনও সড়কে চলছে লক্কর-ঝক্কর গাড়ি, মালিকরা সেসব পথে নামাচ্ছেন। পরিবহন শ্রমিকরা এখনও বেপরোয়া। এতসব আলোচনার মাঝেই চট্টগ্রামে চলন্ত বাস থেকে ফেলে দিয়ে রেজাউল করিম নামের এক যুবককে হত্যা করা হয়েছে। সোমবার ঘটনা ঘটলেও মঙ্গলবার পর্যন্ত কোনও মামলা হয়নি, গ্রেফতার হয়নি লুসাই পরিবহন নামের বাসটির চালক ও সহকারী। ঈদের আগে চট্টগ্রামেই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র পায়েলকে বাস থেকে ফেলে, মাথা ও মুখ থেঁতলে দিয়ে নদীতে ফেলে হত্যা করেছিল হানিফ পরিবহনের চালক ও তার সহকারী।

দৃষ্টান্ত দিতে গেলে মহাকাব্য রচিত হবে। বাংলাদেশের পরিবহন খাতের শ্রমিকরা এমনটা করে, করে চলেছে এবং এতে তাদের কোনও অনুশোচনা কখনও দেখা যায়নি।

সড়কে শৃঙ্খলা আনতে গেলে এই মন-মানসিকতার পরিবর্তন দরকার সবার আগে। পরিবহন শ্রমিকরা কেন অপরাধী হয়ে উঠলো, তার সহস্র কারণ আছে নিশ্চয়ই। সমস্যা হলো এদের ভেতর অপরাধ প্রবণতা যতটা প্রবল, সংশোধনযোগ্য আচরণ ততটা নয়। হিংস্রতা থেকে উত্তরণের পথেই মানবসভ্যতার জয়যাত্রা। কিন্তু আমরা বাংলাদেশের পরিবহন খাতে তা আশা করতে পারছি না। কোনও কোনও নিষ্ঠুরতা মৃত্যু কামনা করতে শেখায়, এ কথা ক্ষমা ও মানবিকতার পরিপন্থী হলেও, সততার সঙ্গে স্বীকার করা ভালো। সত্যি বলতে কী, বাংলাদেশের পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আচরণ সে পর্যায়েই গিয়েছে। দেশের মানুষ আজ এদের দ্বারা নিপীড়িত, নির্যাতিত। এদের দ্বারা বাংলাদেশের রাজপথ আজ নিয়ত রক্তাক্ত।

ক্ষমতার কেন্দ্রে তাদের পেশি আছে, তাই তারা বারবার মাফ পেয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি ক্ষমার চেয়ে বড় কিছু নেই, সুন্দর কিছু নেই। কিন্তু যখন সমষ্টির প্রশ্ন, সমাজের সংকট, সেখানে ভাবনার জগতে পরিবর্তন দরকার।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর নিরাপদ সড়ক বা সড়কে শৃঙ্খলার বিষয়টি অনেক বেশি আলোচিত। সরকারের দিক থেকে নানা ধরনের প্রচারও চলছে, জনগণ নানা আশ্বাসও পাচ্ছে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা এবং তার জেরে প্রাণহানি এড়ানো যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনার এই ধারাবাহিকতা নিয়ে দেশজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই সাধারণ মানুষের ক্ষোভ রয়েছে।

সমাজকে নাড়া দেওয়া এতবড় একটা আন্দোলন হয়ে গেলো, প্রশাসনিক নানা আশ্বাসের পরেও অবস্থার কোনও পরিবর্তনই আসেনি, দুর্ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে বলেই মনে হচ্ছে। দুর্ঘটনার জেরে অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর সবই চলছে। কখনও কখনও দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাগুলোতে কড়া নজরদারি চালু করে পুলিশ, কিন্তু আবার সেই নজরদারি শিথিল হয়ে যায়।

পুলিশ নজরদারি বাড়াবে, সরকার নানা উদ্যোগ নেবে, হয়তো নতুন আইনও পাস হবে। কিন্তু সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে কী? বড় প্রশ্ন এখানেই।

চালকের খামখেয়ালিপনা ও নিয়ম না মেনে গাড়ি চালানোর কারণেই অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। আর বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো সত্ত্বেও বারবার পার পেয়ে যাওয়া চালকের কারণে একের পর এক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে যাত্রী ও পথচারী। বলার অপেক্ষা রাখে না সড়ক ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দুর্ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ জানা সম্ভব। সব দুর্ঘটনার প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটন করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে সড়ক দুর্ঘটনা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে। পরিবহন খাতের কোনও কোনও শাখার দুর্নীতির বিষয়টি বহুল আলোচিত। দুর্নীতির কারণে রাস্তায় চলে ফিটনেসবিহীন গাড়ি, গাড়ি চালায় লাইসেন্সবিহীন বা ভুয়া লাইসেন্সের চালক। অদক্ষ চালকের হাতে দেওয়া হয় লাইসেন্স। এভাবে মূলত যাত্রীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে।

এসব অনিয়ম রোধে কর্তৃপক্ষ এতদিন কঠোর ছিল না, চরম শৈথিল্য দেখিয়েছে। দুর্নীতি রোধে যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নেওয়া অনেক পদক্ষেপই কোনও কাজে আসবে না। বেপরোয়া ড্রাইভিং বা রেষারেষি পথ-নৈরাজ্যের এক বড় কারণ। এভাবেই রাজিব, রোজিনা আর রমিজ উদ্দিনের দুই ছাত্রছাত্রীর প্রাণ গেছে। হিংসায় উন্মত্ত পরিবহন শ্রমিকরা চলন্ত গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে মানুষ হত্যা করছে। সরকারের কাছে মানুষ জানতে চায়, এসব হিংসা, রেষারেষি বা বেপরোয়া গাড়ি চালানো বন্ধ হবে কবে?

দেশের দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সড়ক ও মহাসড়কে ধীরগতির যান চলাচলের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদ। সম্প্রতি এক সভায় সড়ক মহাসড়কে নসিমন, করিমন, ভটভটি, ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও লেগুনা চলাচল বন্ধে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এছাড়া জাতীয় মহাসড়কে লেগুনাজাতীয় ধীরগতির গাড়ি চলাচলেও নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়া সভায় রাজধানীর গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা রুট বিভাজন করে নির্দিষ্টসংখ্যক কোম্পানির আওতায় আনতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মেয়রকে দায়িত্ব দেওয়াসহ ১৮টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বেশিরভাগ পরিবহন এখন রাজনৈতিক দলের নেতাদের। এরমধ্যে আছে ক্ষমতাসীন দলও। এ প্রেক্ষাপটে সড়ক দুর্ঘটনা বা ট্রাফিক আইন না মানার ক্ষেত্রে দণ্ড দেওয়া হলে রাজনৈতিক প্রভাববিস্তার করা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা, মেয়র, চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মালিকানায় পরিবহন হলে তো কথাই নেই। এমনকি পুলিশ, সাবেক সেনা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাংবাদিকরাও পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

এ ধরনের অরাজকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন এবং যারা আইন প্রয়োগ করেন সকলকেই আইন মানতে হবে। সকলের সমন্বয়ের মাধ্যমে রাস্তাসহ রাষ্ট্রের সর্বত্র আইনের প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। অন্যথায় পরিবহন খাতের মতো দেশের সর্বত্রই আইন অমান্য করার প্রতিযোগিতা চলতে থাকবে। সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো প্রায় সবই জানা। এখন জরুরি হলো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।

সভ্য সমাজের মূল লক্ষণ দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন প্রশাসন, ন্যায়পরায়ণতা, সমদর্শিতা এবং দুর্নীতি মুক্তি। এগুলো সমাজের মান নির্ণয় করে। এগুলো অপরাধ প্রতিষেধক। এগুলো প্রতিষ্ঠিত না হলে সড়কে আর কখনও শৃঙ্খলা ফিরবে না। কথা হবে, আশ্বাস হবে, কিন্তু দিনশেষে রাজনীতির পেশি সব ফসল ঘরে তুলবে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লিগ্যাল এইড পরিচালনায় অসামঞ্জস্য তুলে ধরলেন প্রধান বিচারপতি
লিগ্যাল এইড পরিচালনায় অসামঞ্জস্য তুলে ধরলেন প্রধান বিচারপতি
ডিআইইউ’তে বুধবার জেএমসি মিডিয়া বাজের পঞ্চম আসর
ডিআইইউ’তে বুধবার জেএমসি মিডিয়া বাজের পঞ্চম আসর
কোহলির রেকর্ড ভেঙে পাকিস্তানকে সিরিজ জেতালেন বাবর
কোহলির রেকর্ড ভেঙে পাকিস্তানকে সিরিজ জেতালেন বাবর
প্রার্থীর অভিযোগে পাল্টানো হলো নির্বাচন কর্মকর্তা
প্রার্থীর অভিযোগে পাল্টানো হলো নির্বাচন কর্মকর্তা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ