X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘নোট অব ডিসেন্ট’

আমীন আল রশীদ
০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৫:৫৩আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৭:২০

আমীন আল রশীদ তিন মাসের মাথায় দুই দফা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। ২৪ মে সিটি নির্বাচনে এমপিদের প্রচারণার বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার পর এবার জাতীয় নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম ব্যবহারে আপত্তি জানিয়ে তিনি কমিশনের সভা বর্জন করেন। ৩০ আগস্ট বুধবার তিনি ইভিএম ব্যবহারের জন্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে বসা নির্বাচন কমিশনের বৈঠক থেকে বেরিয়ে যান।
নির্বাচন কমিশন সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। সে হিসেবে বাকি চারজন কমিশনার যেহেতু জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমের পক্ষে, সুতরাং এখন আইনত এটি আইন মন্ত্রণালয়ে যাবে, ভেটিং হবে, মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের পরে সংসদে উঠবে। তারপর সংসদ যদি পাস করে তাহলে জাতীয় নির্বাচনে ভোটগ্রহণের পদ্ধতিতে ইভিএম যুক্ত হবে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের একজন কর্তাব্যক্তির এভাবে পরপর দু’বার নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার ঘটনা দেশের ইতিহাসে বিরল।
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১০ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর জন্য গঠিত বিশেষ কমিটির বৈঠকে ‘বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি’ ইস্যুতে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছিলেন কমিটির দুই সদস্য। তারা হলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সংদস সদস্য রাশেদ খান মেনন ও জাসদের হাসানুল হক ইনু। যদিও পরবর্তী সময়ে এটি বিলে উল্লেখ করা হয়নি।

এ প্রসঙ্গে তখন মেনন বলেছিলেন, ‘ওই তিনটি বিষয় সংবিধানে থাকলে রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে ধর্ম প্রধান বিষয় হিসেবে চলে আসবে। এর ফলে ৭২’র সংবিধানের মূল চেতনা থেকে দেশ অনেক দূরে সরে যাবে’।  এই বিষয়ে হাসানুল হক ইনুর বক্তব্যও ছিল প্রায় একইরকম।

এই দুই সদস্যের নোট অব ডিসেন্টের ব্যাপারে তখন সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটির কো-চেয়ারপারসন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক চিন্তা-আদর্শ আর বাস্তবতার সমন্বয় ঘটাতে গিয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে কমিটির সদস্যদের মধ্যে মতদ্বৈততা ছিল। তবু, যতটা সম্ভব, মতদ্বৈততা সমন্বয়ের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক সংসদ।’

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের সবশেষ নোট অব ডিসেন্টের সাংবিধানিক বা আইনি গুরুত্ব যাই থাকুক, (যেহেতু একজন কমিশনারের নোট অব ডিসেন্ট মানতে ইসি বাধ্য নয়—এর একটি রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। কেননা, আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে-বিপক্ষে মত আছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইভিএমের পক্ষে। কিন্তু বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল এর বিপক্ষে। তাদের আশঙ্কা, ভোটচুরির জন্যই সরকার ইভিএম ব্যবহার করতে চায়। আবার একইসঙ্গে সরকারের অংশ এবং সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে। তবে তারা এই মেশিনের স্বচ্ছ প্রয়োগ চায়। দলের মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার গণমাধ্যমকে বলেছেন, বিশ্বের অনেক দেশেই এই পদ্ধতির প্রয়োগ হচ্ছে।) এটি সময়োপযোগী। তাই জাতীয়ভাবে এর ব্যবহারের আগে এ নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা উচিত হবে না।

সুতরাং একজন নির্বাচন কমিশনার যখন এই ইস্যুতে নোট অব ডিসেন্ট দেন বা ইভিএমের বিপক্ষে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে কমিশন বৈঠক থেকে বেরিয়ে যান, সেটি একটি আলাদা গুরুত্ব বহন করে। যেদিন তিনি এই নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে কমিশন বৈঠক থেকে বেরিয়ে যান, সেদিনই সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের জন্য সার্চ কমিটির কাছে মাহবুব তালুকদারের নাম প্রস্তাব করেছিল বিএনপি। তোফায়েল আহমেদের এই মন্তব্যের অর্থ কি এই, কমিশনার মাহবুব তালুকদার বিএনপির লোক? তবে তোফায়েল আহমেদ এও মনে করেন যে, নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বৈঠক করে। তাতে মতবিরোধ হতেই পারে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তারা যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটিই চূড়ান্ত। সরকার সেটি মেনে নেবে।

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার কেন ইভিএম বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিলেন? তার ব্যাখ্যা, ‘আমি মনে করি স্থানীয় নির্বাচনে ধীরে ধীরে ইভিএমের ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ সমর্থন করি না।’ তিনি মনে করেন, যেহেতু ইভিএম ব্যবহারের ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐক্য নেই এবং ভোটারদের মধ্যেও অনীহা আছে, তাই আগামী জাতীয় নির্বাচনেই এই যন্ত্রের ব্যবহার সমীচীন নয়। এছাড়া এখনই বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহারের মতো প্রস্তুতি, বিশেষ করে দক্ষ জনবল ইসির নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার উল্লেখ করেন, পরিকল্পনা কমিশন এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করেনি। যে ইভিএম বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি থেকে বিনা টেন্ডারে কেনা হচ্ছে, তার কারিগরি বিষয় বুয়েট বা অনুরূপ কোনও সংস্থা থেকে যাচাই করা হয়নি। কারিগরি দিক থেকে এ যন্ত্র সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত কিনা, তা পরীক্ষা করা হয়নি। ফলে তার আশঙ্কা, জনমত বা সর্বসম্মত রাজনৈতিক মতের বিরুদ্ধে ইভিএম ব্যবহৃত হলে তা নিয়ে আদালতে অসংখ্য মামলার সূত্রপাত হবে। এছাড়া অন্য কারণ ছাড়া কেবল ইভিএম ব্যবহারের কারণেই সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলেও তিনি মনে করেন।

এখন প্রশ্ন হলো, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের এই কথা যদি যৌক্তিক হয়, তাহলে কমিশনের বাকি সদস্যরা এই ইস্যুতে কেন চুপ? অন্য কেউ কেন এ বিষয়ে আপত্তি দিচ্ছেন না? নাকি মাহবুব তালুকদার বিরুদ্ধস্রোতের যাত্রী? ৫ সদস্যের কমিশনে তিনি একাই কি ভিন্নমত পোষণ করে যাবেন? এর আগে গত মে মাসে নির্বাচনি আচরণবিধি সংশোধন করে যখন সিটি নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রচার-প্রচারণায় অংশ নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়, তখনও নোট অব ডিসেন্ট বা ‘আপত্তি’ দিয়েছিলেন এই কমিশনার। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি সংসদ সদস্যদের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রচারে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হবে। এতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরির উদ্যোগ নস্যাৎ হবে।’

দেখা যাচ্ছে, যে দু’বার মাহবুব তালুকদার নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছেন, সেগুলো যৌক্তিক এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির অনুকূল। কিন্তু এই নোট অব ডিসেন্ট বা আপত্তি আখেরে কী ফল দেবে?

জাতীয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের পক্ষে-বিপক্ষেও মত আছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে-সঙ্গে এই বিষয়টিও আলোচনায় আসবে। তখন এই ইস্যুতেও কি নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার নোট অব ডিসেন্ট দেবেন?

এক অর্থে এটিকে আমরা গণতন্ত্রের চর্চা বলে মনে করতে পারি। রাষ্ট্রের বিভিন্ন দল ও প্রতিষ্ঠানে যেখানে গণতন্ত্র ক্ষয়িষ্ণু, সেখানে নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে যদি এরকম ভিন্নমতের চর্চা হয়, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আলোচনা-তর্কবিতর্ক হয়, সেটি বরং ইতিবাচক হিসেবে দেখাই বাঞ্ছনীয়।

‘নোট অব ডিসেন্ট’কে মূল্যহীন মনে করা হলেও এর একটি অ্যাকাডেমিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। কেননা, কোনও একটি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার অর্থ হলো সেই বিষয়টি বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। অর্থাৎ সবাই হাততালি দিলেও কেউ কেউ বিরোধিতা করেছেন। যে ভিন্নমতকে বলা হয় গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত, সেটি প্রকাশের একটি বড় উপায় এই নোট অব ডিসেন্ট। ফলে মাহবুব তালুকদার সিটি নির্বাচনে এমপিদের প্রচারে অংশ নেওয়ার বিরোধিতা করে এবং এবার জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করে যে নোট অব ডিসেন্ট দিলেন, তাতে বাকি ৪ কমিশনারের সঙ্গে তার সুস্পষ্ট পার্থক্য রচিত হলো। এরকম ভিন্নমতের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাক আমাদের দেশ ও গণতন্ত্র।

তবে সবশেষ খবর, ইভিএম নিয়ে চলমান বিতর্কের মধ্যে রবিবার গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগ তিনি সমর্থন করলেও এ নিয়ে তাড়াহুড়া করা ঠিক হবে না বলে মনে করেন। আর এর পরদিনই প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, আইন প্রণয়ন, অংশীজনের সমর্থন ও সক্ষমতা অর্জনসহ পরিবেশ অনুকূলে থাকলেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার করা হবে। এসব বিবেচনায় মনে হচ্ছে, ইভিএম নিয়ে চলমান বিতর্ক হয়তো আর বেশিদূর এগোবে না। তবে সামগ্রিক বাস্তবতায় নির্বাচন কমিশন আগামী জাতীয় নির্বাচনে ১০০ আসনে না হলেও গোটা পঁচিশেক আসনেও যদি ইভিএম ব্যবহার করতে চায়, সেক্ষেত্রে ডিসেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রগুলোর ভোটারদের অবহিত করাও বেশ কঠিন হবে।

লেখক: সাংবাদিক 

/এসএএস/এমএনএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
দুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টিদুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ