X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

হজ অভিজ্ঞতা: সৌদি আরব এখন...

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৫:৪৬আপডেট : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৬:৪৪


বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী গত মাসে দু’সপ্তাহ নির্ধারিত কলাম লিখতে পারিনি। কারণ ওই সময় হজের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব ছিলাম। সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজের আমন্ত্রণে রাজকীয় মেহমান হওয়ার সুভাগ্য হয়েছিল। ১৭ দিনের সফর। ১৩ আগস্ট সৌদি এয়ার লাইন্সের উড়োজাহাজে করে জেদ্দা গিয়েছিলাম। মক্কা-মদিনা হয়ে দেশে ফিরেছি ২৯ আগস্ট শেষ রাতে। মূলত হজের আনুষ্ঠানিক ব্যস্ততার কারণে দুই সপ্তাহ লিখতে পারিনি।
ইমাম গাজ্জালি বলেছেন এবাদতগুলোর মধ্যে হজ কঠিন এবাদত। তার সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল প্রাচীন পদ্ধতির। সুতরাং হজ তো কঠিন হবেই। আমার মামা সুফি ইব্রাহিম ১৯৫৬ সালে হজে গিয়েছিলেন। তার মুখে শুনেছি জাহাজ থেকে জেদ্দা বন্দরে নেমে তারা কাফেলা গঠন করে মঞ্জিল মঞ্জিল করে পদব্রজে মক্কায় পৌঁছেছিলেন। জেদ্দা থেকে মক্কার দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। আর মক্কা থেকে মদিনা গিয়েছিলেন উটে। উটকে বলা হতো মরুভূমির জাহাজ। মক্কা থেকে মদিনার দূরত্ব চারশত কিলোমিটারের বেশি। সুতরাং অনুরূপ যানবাহন ব্যবহার করে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে হজ করা তো খুবই কঠিন ব্যাপার ছিল।
আধুনিক যুগে যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ হলেও মূল হজের আনুষ্ঠানিকতা একেবারেই সহজ নয়। শুদ্ধ করে হজ করতে হলে খুবই কঠিনভাবে সব কিছু সম্পন্ন করতে হয়। মক্কাকে ঘিরেই হজের কর্মকাণ্ড আবর্তিত।


মিনা-মুজদালিফা-আরাফাত-মক্কা। মদিনা সফর হজের অংশ নয়। তবে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর প্রতি সম্মান দেখাতে গিয়ে হাজিরা মদিনা গিয়ে কয়েকদিন অবস্থান করেন। আর রাসুলুল্লাহ (স.)-এর একটি হাদিস আছে, যারা মদিনায় তার মসজিদে চল্লিশ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবেন, তারা তার সঙ্গে বেহেশতে প্রবেশ করবেন।আমাদের সঙ্গে সাধারণ হাজিদের মতো এজেন্ট মোয়াল্লেম কিছু ছিল না। সৌদি বাদশাহের নিয়োজিত কর্মকর্তারাই আমাদের এজেন্ট মোয়াল্লেম সব। ঢাকা এয়ারপোর্টে ঢাকাস্থ সৌদি রাষ্ট্রদূত আমাদের বিদায় জানিয়েছেন আর জেদ্দা এয়ারপোর্ট থেকে রাজপ্রতিনিধিই আমাদের সড়ক পথে মক্কার ক্যাসাব্লাংকা হোটেলে নিয়ে গিয়েছিলেন। ক্যাসাব্লাংকা হোটেল পাঁচ তারকা মানের। এখানে ৫৯ দেশের ১ হাজার ৪০০ আমন্ত্রিত রাজকীয় মেহমানের থাকার ব্যবস্থা করেছে সৌদি সরকার। আরও একটি হোটেলেও ছিলেন কিছু।

দেখেছি আমাদের পরও কয়েকটি দেশের মেহেমান এসেছেন। থাকা-খাওয়ার বিলাসের ছিল রাজকীয়। মদিনাতেও রাখা হয়েছিল ৫ তারকা হোটেল ক্রাউন প্রিন্সে। বেশি বিলাসের মাঝে এবাদত বিঘ্নিত হয়। হজ তো পরিপূর্ণ একটা এবাদত। ‘লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক’-এর মাতম। গোলাম হাজির, হাজির বলে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের কর্মযজ্ঞ।

হজ হচ্ছে মুসলিম উম্মার ঐক্য ও সংহতির বহিঃপ্রকাশ। বছর বছর আল্লাহর ঘরে সবাই মিলিত হয়ে এই ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করে। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘এটাই নিশ্চিত ধর্ম। ধৈর্য ও সংযম সহকারে এর গভীরে প্রবেশ করতে হবে। অধৈর্য অশ্বারোহী কোনও দূরত্বই অতিক্রম করতে পারে না।’

আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ মানুষ। মানুষের কোলাহলের মাঝে নিজেকে সুদৃঢ় রাখার জন্য একটা লাঠি নিয়েছিলাম। ‘তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান’-এর মতো লাঠি আমাকে সম্মান এনে দিয়েছিল। লাঠি নিয়ে উপুড় হয়ে বিরাট কাফেলার সামনের পড়লেও তারা আমাকে পথ করে দিয়েছেন, রাস্তা পাড়ি দেওয়ার সময় দেখেছি দ্রুতগামী গাড়িও দাঁড়িয়ে গেছে। আসলে দুঃস্থ মানুষকে সাহায্য করাই মানবতা আর মানবতাই ধর্ম। রাসূল (স.)এর দেশে রাসুলের (স.) এর সুন্নত এখনও কঠিনভাবে পালন করা হয়। আমি অভূতপূর্ব সহানুভূতি পেয়েছি সর্বত্র।

রাসুলুল্লাহ্ (স.) দয়ার সাগর ছিলেন। দয়া ছাড়া মানুষের উপাসনা নিরর্থক। দয়াহীন রাষ্ট্র বা ধর্ম প্রতারণাও অত্যাচারের রূপান্তরিত হতে বাধ্য। মানুষের উপকার করার অর্থ হচ্ছে আল্লাহর উপকার করা। মানুষের কাজ থেকে উপকার পাওয়ার আল্লাহ’র কোনও প্রয়োজন নেই। তবু মানুষ একে অন্যকে সাহায্য করলে তিনি খুশি হন এই ভেবে যে, এ উপকার যেন তার প্রতিই করা হলো।

আমাদের হোটেলটা ছিল মক্কার হারাম থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। তাই জোহর নামাজের পরে খাওয়া দাওয়া সেরে গাড়িতে করে আমাদের হারাম শরিফে নিয়ে যেতো। আসর, মাগরিব, এশার নামাজ শেষে আবার নিয়ে আসতো। ফজরের জন্যও নিয়ে যেত রাতের শেষভাগে। সকাল থেকে জোহর পর্যন্ত ১৪ শত মেহমানের মিলন মেলা ছিল ক্যাসাব্লাংকা হোটেলের বিশাল ডাইনিং হল। ৫৯টি দেশের মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আলাপচারিতার বিরাট সুযোগ।

এত দেশের মানুষের মিলনমেলা আগে দেখার সুযোগ হয়নি আমার। বহুদেশের মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। তারা বাংলাদেশের মানুষ শুনলে খুশিই হয়। অনেক সময় জড়িয়েও ধরে। তাতে বুঝলাম, সম্ভবত বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বে জনপ্রিয় দেশ। তুরস্কের এক পার্লামেন্ট সদস্য, ভারতের রাজ্যসভার তেলেঙ্গানা থেকে নির্বাচিত প্রাক্তন সদস্য পির আব্দুস ছাত্তার, মরক্কোর এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন–আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেমন আছেন। খুব আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তাতে বুঝলাম বিশ্ব-মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে আমাদের প্রধানমন্ত্রী জনপ্রিয় এবং তার গ্রহণযোগ্যতা আছে।

এসব ঘটনার কারণে মক্কায় পুলকিতবোধ করেছি। মক্কা মদিনায় কখনও নিঃসঙ্গ মনে করেনি। হোটেল কর্মচারীদের মাঝে বহু বাংলাদেশি পেয়েছি। আর সমগ্র মক্কা-মদিনায় ১০ হাজারের ওপরে ক্লিনার রয়েছে তার মাঝে ৬০ শতাংশ হবে বাংলাদেশি। অবশিষ্টরা হচ্ছেন পাকিস্তানি ও ভারতীয় মুসলমান যুবক। মক্কার হারামের সামনে মিসফালা। মিসফালার প্রায় ৫০ শতাংশ দোকানদার চট্টগ্রামী।

মদিনায় বেলাল মসজিদের পাশে বেলাল সুপার মার্কেট। বেলাল সুপার মার্কেটে কয়েকটি পাকিস্তানি দোকান আছে অবশিষ্টরা সবাই বাঙালি। দোকানদার হলো বেশিরভাগ চট্টগ্রামী। তারপর লক্ষ্মীপুর ও মুন্সীগঞ্জ। এক হক চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হলো তার দোকান নাকি ১৪টা।

রোহিঙ্গাদের অবস্থাও খুবই ভালো। বাদশাহ ফয়সাল আর বাদশাহ খালেদ রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিয়েছিলেন, আর কেউ সে উদ্যোগ নেননি। বহিরাগত অভিবাসীদের মাঝে মিয়ানমার রোহিঙ্গা ও আফ্রিকার কালো মানুষই বেশি। দেখলাম হজ মৌসুম উপলক্ষে বহু রোহিঙ্গা ও কালোদের বিভিন্ন অস্থায়ী কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা নিয়োগ পেয়েছে স্বেচ্ছাসেবক আর নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে। কালোরা, রোহিঙ্গারা আবার টেক্সি ড্রাইভার হিসেবেও কাজ করছে। রিকশা, সিএনজি কিছুই নেই, সাধারণের ব্যবহারের জন্য বাস, প্রাইভেট টেক্সিই অবলম্বন। দূরবর্তী এলাকার জন্য আছে বিলাস-বহুল বাস আছে।

তুরস্কের ওসমানিয়া খেলাফত দীর্ঘ ছয়শত বছর হারামাইনের খাদেম ছিল। তাদের হাতেই হারামাইনের প্রভূত উন্নয়ন হয়েছিলো। কন্যাদায়গ্রস্ত আবিদ আলী ফকিরের মেয়ে মালখাতুনকে বিয়ে করে লাঠিয়াল সর্দার বিশাল ওসমানিয়া খেলাফাতের পত্তন করেছিলেন বলে তারা অনেকটা ফকিরভক্ত ও মুসলিম জগতের সব মনীষীর কবরে মনোরম মাজার তারাই তৈরি করেছিলেন। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইবনে সউদরাই আরব উপত্যকায় ক্ষমতা দখল করে। তারা আরবি, তারা শিরিক ও বেদায়াত থেকে ইসলামকে মুক্ত করতে গিয়ে আরব উপত্যকায় রাসুল (স.)-এর মাজার ছাড়া সব মাজার ভেঙে দেয়।

মদিনায় জান্নাত আল-বাকি গোরস্তানে শত শত সাহাবায়ে কেরামের কবর রয়েছে। ইবনে সউদরা সব স্মৃতিচিহ্ন নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। সাহাবাদের কবরের ওপর একটা একটা কালো পাথর বসানো হয়েছে। কালো পাথরের স্থলে নামফলক হলেই উত্তম হতো। প্রতীকী চিহ্ন বসালে ভয় আছে সত্য কিন্তু আত্ম-প্রকাশের জন্য প্রতীকী চিহ্নের প্রয়োজনও আছে। আল্লাহ আত্মপ্রকাশের জন্য প্রথম নিজের কাবাগৃহের নিশানা ঠিক করেছিলেন। শিরিক নিকৃষ্টতম পাপ সত্য তার থেকে বাঁচারও পথ আছে। মনে হয়েছে, শিরিকের ভয়ে সব অতীত ইতিহাস নিশ্চিহ্ন করা ঠিক হয়নি সৌদি সরকারের।

সৌদি আরব সরকারিভাবে নানা পরিবর্তন হচ্ছে। সরকার নাগরিকদের অনেক স্বাধীনতা নিশ্চিত করছে। সিনেমা হল চালু হয়েছে (মক্কা-মদিনায় দেখিনি)। মেয়েরা গাড়ি চালাচ্ছে, এমনকি পাইলট হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করছে। মেধায় ওরা পিছিয়ে নেই সেটা সুযোগ পেলেই প্রমাণ দিচ্ছে। ভিশন ২০৩০-এর প্রচার চলছে খুব যেখানে তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে চাচ্ছে নতুন সরকার। তবে দেশটি রাতারাতি পশ্চিমা সংস্কৃতিতে চলে যাচ্ছে ভাবার কারণ নেই, জনগণ ইসলামি সংস্কৃতি, মূল্যবোধে অভ্যস্ত। রাতারাতি সেটা পরিবর্তন সম্ভব নয়, প্রয়োজনও নেই।

সৌদি আরবের আবহাওয়া ভয়ঙ্কর রকমের গরম। দিনে চল্লিশ ডিগ্রি, রাতে ৩০/৩২ ডিগ্রি হাজিদের জন্য অনেক কষ্টকর ছিল। মিনা-আরাফাতে হজের আগের রাতে ভয়ঙ্কর রকম ঝড় বয়ে যায়। বৃষ্টি আর বাতাসের ভয়াবহতা সুনামির মতো ভীতিকর ছিল। তবে বাংলাদেশে বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত যেভাবে হয়, তা দেখা যায়নি। দিন দিন আবহাওয়ার এই পরিবর্তন, সন্দেহ নেই হজের ফরজ আনুষ্ঠানিকতা পালনকে আরও কঠিন করে তুলবে আগামীতে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
দুবাই হয়ে ট্রানজিট ফ্লাইট স্থগিত করলো এমিরেটস
ঢাকা শিশু হাসপাতালে আগুন
ঢাকা শিশু হাসপাতালে আগুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ