অংকটা কিছুতেই মিলাতে পারছেন না সোবহান সাহেব। বেশ জটিল অংক। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে একজন সামান্য মুচি নাকি এখন শতকোটি টাকার মালিক। একসময় একটি জুতা তৈরির কারখানায় পিয়নের কাজ করতেন। সে কারণে ‘মুচি জসীম’ বলে তাকে ডাকতো সবাই। সেই মুচি জসীম নাকি এখন শতকোটি টাকার মালিক। কীভাবে সম্ভব? তিনি কি আলাউদ্দিনের চেরাগ ধরনের কোনও কিছু পেয়েছেন? চেরাগে ঘষা দিলেই দৈত্য এসে হাজির হয়। তারপর বলে ‘হুকুম করুন মালিক’। মুচি জসীম তাকে হুকুম করে আর সঙ্গে সঙ্গেই তার ঘরে শত শত কোটি টাকা এসে হাজির হয়। ঘটনাটি সে রকম কিছু? কিন্তু এটাতো রূপকথার গল্প। বাস্তবে ধরা দিলো কী করে? অংকটা তো আসলেই জটিল। সারা জীবন ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে অংক পড়িয়েছেন সোবহান সাহেব। যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগের বাইরেও অনেক জটিল অংক শিখিয়েছেন। কিন্তু জসীম মুচির শতকোটি টাকার মালিক হওয়ার অংকটা কিছুতেই মিলাতে পারছেন না। অনেকেই কঠোর পরিশ্রম করে জিরো থেকে হিরো হয়। নাটক, সিনেমায় এমন অনেক গল্প চোখে পড়ে। কিন্তু জসীম মুচির গল্প যে নাটক সিনেমাকেও হার মানিয়েছে। কীভাবে এত টাকার মালিক হলেন তিনি? সোবহান সাহেব যখন এই ভাবনায় আচ্ছন্ন তখনই পত্রিকায় আরেকটি খবর তাকে আরও অস্থির করে তুললো। খবরের শিরোনাম ছাপা হয়েছে ‘২২ একর লেক দখল’। শিরোনামের চেয়ে ভয়াবহ দেখাচ্ছে পত্রিকাটিতে প্রকাশিত একটি বড় ছবি। ছবির নিচে ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ‘মাঝের সবুজ কুচরিপানা লেকের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। বিশাল লেকের প্রায় পুরোটাই দখল করে কয়েক হাজার ঘর তুলেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। ছবিটি মিরপুরের রূপনগর আবাসিক এলাকার।’
ছবিটির দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন সোবহান সাহেব। এ তো দেখি আরও এক জটিল অংক। ২২ একর মানেই বিশাল এলাকা। একদা এখানে বিশাল লেক অর্থাৎ জলাধার ছিল। এখন নেই। অবৈধ দখল হয়েছে। সেখানে এখন মানুষ বসবাস করে। এতবড় একটা জায়গা দখল হলো। মানুষের জন্য ঘরবাড়ি নির্মিত হলো। মানুষ সেখানে বসবাস শুরু করলো। এত কিছু তো আর রাতের অন্ধকারে হয়নি। প্রকাশ্যে সবকিছু হয়েছে। লেকের জমিতে প্রকাশ্যে মাটি ভরাট হয়েছে। সেখানে ঘরবাড়ি তোলার জন্য বড় বড় গাড়িতে করে নির্মাণসামগ্রী পাঠানো হয়েছে। অর্থাৎ রীতিমত শোরগোল করে বাড়িঘর তোলা হয়েছে এবং শোরগোল করেই মানুষ সেখানে বসবাসও করছে। কাজেই এটাকে কি ‘দখল’ বলতে পারি আমরা? ধরা যাক এটি দখল প্রক্রিয়ার অংশ নয়। কিন্তু জলাধার ভরাট করে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা তো ন্যায়সঙ্গত নয়। এক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আছে। পানির জমি ভরাট করে ঘর তুলে জনবসতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কি এই বিধিনিষেধকে?
সোবহান সাহেব পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিটি থেকে চোখ ফেরাতে পারছেন না। তিনি এই শহরে থাকেন না। কাজেই শহরের হালচাল নিয়ে তার দুশ্চিন্তা হওয়ারও কথা নয়। তবু সোবহান সাহেব বেশ অস্থির। শহরটার ওপর প্রতিদিন অনেক অত্যাচার হচ্ছে। আজ থেকে ৪০ বছর আগে প্রথম এই শহরে আসেন তিনি। আহারে কি শান্তই না ছিল শহরটা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে বেড়াতে যেতেন সদরঘাটের দিকে। বুড়িগঙ্গার স্বচ্ছ পানি দেখে মনটা জুড়িয়ে যেতো। একবার রমজান মাসে সন্ধ্যায় বুড়িগঙ্গা নদী পার হচ্ছিলেন। পথেই ইফতারের সময় হয়ে যায়। বুড়িগঙ্গার পানি খেয়েই ইফতার করেছিলেন। আর এখন তো বুড়িগঙ্গার পানির দুর্গন্ধে টেকা মুশকিল। তখনকার দিনে ঢাকা শহরের বুকে অনেক খাল ছিল। ধোলাই খালে বড় বড় নৌকা চলতো। মতিঝিল পাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে বিরাট লেকে মানুষ পারাপার করার জন্য নৌকা ব্যবহার করা হতো। অথচ বর্তমান সময়ে কোনও খালেরই অস্তিত্ব নেই। খালের জমি ভরাট করে বড় বড় অফিস আদালত, দালানকোঠা বানানো হয়েছে। এসব কি বৈধ উপায়ে হয়েছে? নিশ্চয়ই না। তার মানে অবৈধ উপায়ে গড়ে উঠেছে। ফলে শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে। অল্প বৃষ্টিতে ডুবে যায় শহরটি। পথচারীদের সে কী দুর্ভোগ। পত্র-পত্রিকা, টিভি চ্যানেলে ফলাও করে এসব দুর্ভোগের খবর প্রকাশ ও প্রচার হয়। সবাই আহা! উহু! করে। ব্যস ওই পর্যন্ত শেষ! এটা কেমন অংক? একটা দেশের রাজধানী সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবে থাকবে? কেন ডুবে থাকে? অতীতকালে তো ডুবতো না। এখন কেন ডোবে? তার মানে অতীতকালে ঢাকা শহরের বুকে যে খালগুলো ছিল বৃষ্টির পানি সেই খালে গিয়ে জমা হতো। আর এখন খাল না থাকায় বৃষ্টির পানি যাওয়ার জায়গা পায় না। ফলে রাস্তাঘাট সয়লাব করে। সামান্য বৃষ্টিতেই শহরের রাস্তাঘাট হয়ে যায় খরস্রোতা নদীর মতো। কিন্তু এর থেকে পরিত্রাণের কি কোনও উপায় নেই?
কোথায় পাবেন এর উত্তর? প্রচার মাধ্যমেই নিশ্চয়? পরের দিন যে কাগজটিতে ‘২২ একর লেক দখল’ শিরোনামে ভয়াবহ খবরটি ছাপা হয়েছিল তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন সোবহান সাহেব। নিশ্চয়ই ফলোআপ স্টোরি ছাপা হয়েছে। পত্রিকায় ভয়াবহ একটা খবর ছাপা হলো। নিশ্চয়ই দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ শুরু হয়েছে অথবা উদ্যোগ শুরু হতে যাচ্ছে... এমন খবরেরই আশা করছিলেন সোবহান সাহেব। কিন্তু পত্রিকায় এ ব্যাপারে আর কোনও খবরই পেলেন না। ভেবেছিলেন মুচি জসীমের শতকোটি টাকার মালিক হওয়ার খবরের ব্যাপারেও নিশ্চয়ই ফলোআপ স্টোরি পাবেন। কোনও পত্রিকায় তাও নেই। তার মানে কি এতবড় অন্যায় কর্মকাণ্ড দেশের শীর্ষ মানের পত্রিকায় প্রকাশের পরও প্রশাসন পর্যায়ে কারও নজরে পড়েনি? ভয়াবহ এই খবর দুটির ব্যাপারে কাউকে প্রতিবাদ করতেও দেখলেন না। তার মানে ঘটনা সত্য। বিশাল লেক অন্যায়ভাবে দখল করা হয়েছে। মুচি জসীম অবৈধ পন্থায় শতকোটি টাকার মালিক হয়েছে। এই অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা জরুরি। সঙ্গে-সঙ্গে দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করাও সময়ের দাবি। কিন্তু এই দাবি মিটাবে কে?
সোবহান সাহেব ঢাকায় বড় ছেলের বাসায় থাকেন। সরকারি চাকরিতে অবসর গ্রহণের পর গাইবান্ধায় গ্রামের বাড়িতেই আবাস গেড়েছিলেন। ছেলেমেয়েরা কেউ ঢাকায়, কেউ চট্টগ্রামে, কেউ রংপুর শহরে থাকে। তাদের পরিবার বড় হয়েছে। সোবহান সাহেব পালা করে ছেলেমেয়েদের বাসায় বেড়াতে যান। অনেক দিন পর এবার ঢাকায় এসেছেন বড় ছেলের বাসায়। বড় ছেলে এবার তাকে গ্রামে যেতে দিতে চাইছে না। আলাদা ঘর দিয়েছে। কিন্তু সোবহান সাহেবের মন কিছুতেই টিকছে না। ছেলের বাসায় বেশক’টি দৈনিক পত্রিকা রাখা হয়। প্রতিদিন বিভিন্ন পত্রিকার খবর পড়েন আর সময়ের অংক মিলাতে চেষ্টা করেন। এই তো কয়েকদিন আগে ঢাকায় একঘণ্টার বৃষ্টিতেই পথঘাট ডুবে গেলো। নগরবাসীর সে কী দুর্ভোগ। তখনই ঢাকার বিভিন্ন স্থানের খালগুলোর কথা মনে পড়ছিল সোবহান সাহেবের। এই যে খাল দখল করে নানান ধরনের বৈধ, অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে, ফলে বৃষ্টির পানি যাওয়ার তো জায়গা পাচ্ছে না, ভবিষ্যতে খালগুলো যদি উদ্ধার করা না যায় তাহলে তো বর্ষা মৌসুমে ঢাকার পরিবেশ দিনে দিনে আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। কিন্তু আদৌ কি ঢাকার খালগুলো উদ্ধার হবে? একথা ভাবতে গিয়ে হঠাৎ যেন মনে সাহস পেলেন সোবহান সাহেব। ঢাকায় সোনারগাঁও হোটেলের পাশে খালের ওপর বিজিএমইএ’র ভবন গড়ে তোলার পরও তা সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বিজিএমইএ দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সংগঠন। তাদের গড়া স্থাপনা যদি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় তাহলে অন্য ক্ষেত্রের অবৈধ স্থাপনাও তো ভেঙে ফেলা সম্ভব। তবে এই অংকটা বোধকরি অনেক জটিল।
সোবহান সাহেব ভাবলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি চিঠি লিখবেন। চিঠিতে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের ব্যাপারে আরজি জানাবেন। কিন্তু চিঠিখানি লিখতে গিয়ে আরও অনেক সংকট ও সমস্যা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। বিশেষ করে সড়ক ব্যবস্থার নানা অনিয়মের চিত্র মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আন্দোলন করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর পরও সড়ক ব্যবস্থার কোনোই উন্নতিই হচ্ছে না। না পথচারী না চালক, কেউই আইন মানছেন না। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। চিঠিতে এ ব্যাপারেও আরজি জানাবেন বলে ভাবলেন সোবহান সাহেব। হঠাৎ পত্রিকায় একটি ছোট্ট খবর দেখে চমকে উঠলেন তিনি। দারুণ এক আনন্দের খবর ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। “দেশের বিজ্ঞানীদের অসাধ্য সাধন। ৫ মিনিটে ৫০০ টাকা দিয়ে রক্ত পরীক্ষায় শনাক্ত হবে ক্যান্সার”। এই শিরোনামের খবরটিতে উল্লেখ করা হয়েছে- শুধু রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই আগে থেকে শনাক্ত করা যাবে ক্যান্সার। এই পরীক্ষায় খরচ হবে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা আর সময় লাগবে মাত্র ৫ মিনিট...।
আনন্দে হৈ চৈ শুরু করে দিলেন সোবহান সাহেব। মনে মনে ভাবলেন যে দেশের বিজ্ঞানীরা এত বড় সাফল্য দেখাতে পারেন সেই দেশের মানুষ কেন এত দুর্নীতিবাজ হবে। কেন অন্যের জমি দখল করবে। কেন শহরের জলাভূমি দখল করে শহরের মানুষকে ডুবিয়ে মারবে? কেন অবৈধ পন্থায় অর্থের পাহাড় গড়বে? দেশের এই গুণী বিজ্ঞানীদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য হলেও তো আমরা নিজেদের বদলাতে পারি। প্রিয় পাঠক, কী বলেন? সবার জন্য রইলো অনেক শুভ কামনা।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো।