X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

এ দেশে আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য বিপজ্জনক স্তরে

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৫:০১আপডেট : ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৫:০২

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা চীন ও আমেরিকাকে পেছনে ফেলে দ্রুত সম্পদ বাড়ানো বা ধনীর উত্থানে সবার শীর্ষে এখন বাংলাদেশ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সম্পদ গবেষণা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্স  বলছে, বাংলাদেশ গত পাঁচ বছরে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির বিবেচনায় শীর্ষে রয়েছে। এ তালিকায় ভারত ও হংকংও রয়েছে। উল্লেখিত দেশের ধনীদের সম্পদের পরিমাণ দ্রুত বাড়লেও বাংলাদেশি ধনীদের সম্পদ বেড়েছে তার চেয়েও বহুগুণ দ্রুতগতিতে। ওয়েলথ-এক্সের গেলো সপ্তাহে প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট ২০১৮’ বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ধনকুবেরদের সামগ্রিক সম্পদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ।
খবরটি চমকে দেওয়ার মতো, কিন্তু তা আসলে চমকে দেয় না। গত প্রায় এক দশকে ব্যাংকিং খাতে, শেয়ারবাজারে লুটপাট, সামগ্রিককভাবে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার, অর্থপাচার করে বিদেশে বেগমপাড়া বা সেকেন্ড হোম কেনার হিড়িক থেকেই বেঝা যাচ্ছিল, একদিন এদেশের একটা শ্রেণি সবাইকে টেক্কা দেবে সম্পদ বৃদ্ধিতে। এই একশ্রেণির হাতে বড় অংশের সম্পদ ও অর্থবিত্ত কুক্ষিগত হওয়ায় সমাজে বৈষম্য বাড়ছে আরও দ্রুতগতিতে।

বাংলাদেশে বৈষম্যের ছবিটি ঠিক কেমন তা খুব একটা আলোচিত হয় না। কারণ, ভূমিকাটা রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের ভেতর একটা হিংস্রতা থাকে– যে করেই হোক এগুতে হবে। আর এই এগুনোর প্রক্রিয়ায় শাসকগোষ্ঠী ক্রমশ অধিকাংশ জনগণের মঙ্গল সম্পর্কে উদাসীন হতে শুরু করে। ক্ষমতা মুষ্টিমেয়দের হাতে সংহত হয় এবং রাষ্ট্র ক্রমাগত সেই ক্ষুদ্র শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার এক যন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। জনসাধারণের ইচ্ছা এবং স্বপ্নের সঙ্গে রাষ্ট্রের ব্যবধান কেবল বাড়তেই থাকে।

মুক্তবাজার অর্থনীতি সমাজ এবং মানুষ উভয়কেই পণ্যে পরিণত করে। কিন্তু এর ভেতরেও যেসব কল্যাণমূলক কর্মসূচি থাকে তার ছিটেফোঁটাও পায় না দরিদ্র জনগোষ্ঠী। আমরা দেশকে উন্নত করতে চাই। কিন্তু অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য যদি বেশিরভাগ মানুষকে পায়ের তলায় চেপে রাখে, তাহলে দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক সংস্কার কোনও সুফল বয়ে আনবে না। কিছুদিন আগে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেছেন, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হতে চললেও দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে, যা নিয়ে উদাসীন থাকলে চলবে না। তিনি বলেন, ‘আমরা দারিদ্র্য বিমোচনে অনেক চেষ্টা করছি। এটা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু আমরা এখনও দারিদ্র্য শেষ করতে পারিনি।’

উন্নয়ন শব্দটি শুনলেই মানুষের মনে প্রথম যে কথাটি জেগে ওঠে তা হলো তার নিজের উন্নয়ন। অর্থাৎ সমাজের সব শ্রেণির মানুষই নিজের মতো করে কিছু প্রত্যাশা করে। উন্নয়ন শব্দটির তাই আসল মাজেজা হলো সুষম উন্নয়ন। এর বিপরীতেই থাকে বৈষম্য। আমরা এগিয়ে চলেছি, আমরা আরও এগিয়ে যাবো, আমাদের জিডিপি বাড়বে, মাথাপিছু আয় বাড়বে, আয় ও ব্যয় সক্ষমতা বাড়বে। কিন্তু প্রশ্ন হলো কাদের বাড়লো এই সবকিছু? ওয়েলথ-এক্স যাদের কথা বলেছে, তারাই বাংলাদেশ নয়। বাংলাদেশের এই নব্য ধনিক শ্রেণি সরাসরি জননিপীড়ক না হলেও এরাই কৌশলে জনগণের ওপর বড় নির্যাতন চালাচ্ছে। এরা রাজনীতি দখলে নিয়েছে, এরা আমলাতন্ত্রকে জনসেবক থেকে শোষক বানিয়েছে, এরাই সংস্কারের নামে ব্যাংক ও প্রকল্প অর্থ লুট করছে।

যে বিরাট জনগোষ্ঠী কৃষিকাজে জড়িত, যাদের সৃজনশীলতায় এই বিশাল জনসংখ্যা খেয়ে পরে আছে, তারাও লড়াই করে দামটুকু পেতে। অন্তহীন দুর্নীতি, সরকারি উপহারে একটি ক্ষুদ্র কিন্তু শক্তিশালী সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণি হওয়ায় তারা প্রভুত্ব করছে আর সবার ওপর। আর এভাবে বৈষম্য বেড়ে চলেছে লাগামহীন।

এই যে ক্ষুদ্র কিন্তু অতি শক্তিশালী শ্রেণির কথা বলছি, এরা একজোট হয়ে বিপুল জনগোষ্ঠীর খাটুনির ফল বিনাশ্রমে উপভোগ করছে। আর এর ফলে তাদের শ্রমের বেতন কমতে কমতে তলানিতে গিয়ে ঠেকছে।

তাই উন্নয়ন আর নানা সূচক বৃদ্ধির ছবি দিয়ে বলা যাবে না দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের তাণ্ডব কমছে। এই যে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বৈষম্য বাড়ে, সেখানে আমরা কি পেরেছি বৈষম্য নিরসনকেই উন্নয়নের দর্শন হিসেবে গ্রহণ করে এগুতে? না পারিনি। বাজার অর্থনীতির ডামাডোলে ব্যক্তি খাত ও বাজারীকরণের নীতিকে আঁকড়ে ধরার ফলে এ দেশে আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য বেড়ে বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে গেছে।

শুধু ‘উন্নয়ন’ এর উত্তর হতে পারে না। উত্তর হবে বহুমুখী। হিংসার রাজনীতি এবং প্রতিশোধস্পৃহামূলক কার্যকলাপ যদি চলতে থাকে তাহলে তা মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে, যাদের নেতৃত্বের উৎস নিপীড়িত মানুষের সম্পদ লুটের সংস্কৃতিতে।

সমাজে যে নানা অস্থিরতা, সংঘাত– এসবের উদ্ভবের আর্থ-সামাজিক কারণ হলো অত্যাচার, বঞ্চনা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, শিক্ষা বৈষম্য, স্বাস্থ্য বৈষম্য, পারস্পরিক আস্থার অভাব ইত্যাদি। যদি সত্যিকারের উন্নয়ন চাই তবে শোষণ, অত্যাচার, বৈষম্য দূর করা, পারস্পরিক আস্থা জাগানো, রোজগারের পথ দেখানো, সর্বোপরি মানুষের মানবিক মর্যাদার পুনরুদ্ধারের অর্থনৈতিক কর্মসূচি আসুক।

সরকারি প্রকল্পই হয়ে উঠেছে দুর্নীতির আসল জায়গা। এসব প্রকল্প জনমত দ্বারা সমর্থিত কিনা, তা নিয়মিত যাচাই করা প্রয়োজন। স্বচ্ছতার বিকল্প নেই। রাষ্ট্রের কাছ থেকে জনগণের প্রত্যাশা স্বচ্ছতা। কত টাকা খরচ করে, কত দিনে আমরা কী ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প সম্পন্ন করছি, তার অর্থনৈতিক মান কেমন সবকিছুরই স্বচ্ছতা প্রয়োজন। দাবি করা প্রয়োজন বিচার ব্যবস্থা সংস্কারের, যাতে দ্রুত এবং স্বল্পতর খরচে ন্যায় বিচার পাওয়া যেতে পারে। দাবি করা যেতে পারে পুলিশি ব্যবস্থাকে মানবিক, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ করে তোলার। ক্ষমতাকে কি ভাববেন এমন করে? বেশি উন্নয়ন মানে বেশি করে মানুষের ক্ষমতায়ন, তা কি পারছি আমরা?

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গরমে বেড়েছে অসুখ, ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি রোগী হাসপাতালে
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগরমে বেড়েছে অসুখ, ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি রোগী হাসপাতালে
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৪)
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ