X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

খেলার ময়দানেও জরুরি ‘রাজনৈতিক লড়াই’

জোবাইদা নাসরীন
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৬:২৩আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৬:২৫

জোবাইদা নাসরীন ইউএস ওপেনের মঞ্চ। নিউ ইয়র্ক সিটির কুইন্সের আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়ামে ফাইনাল খেলার স্কোরকার্ড ৬-২, ৬-৪। হেরে গেছেন সেরেনা উইলিয়ামস। তাকে হারিয়ে বছরের শেষ গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছেন জাপানের নাওমি ওসাকা। কিন্তু এই স্কোরবোর্ড দেখে সেদিনের খেলার অনেক কিছু বোঝা সম্ভব নয়। ওই ম্যাচ এখনও আলোচনায়। একইসঙ্গে আলোচনায় আছেন সেরেনা ও চেয়ার আম্পায়ার কার্লোস রামোস। তাদের দ্বৈরথ হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক এজেন্ডা।
সেরেনা উইলয়ামসের ঝুলিতে আছে ২৩টি গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপা। তিনি আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ নারী খেলোয়াড়। আমেরিকার টেনিস অঙ্গনে ঝেঁকে বসা বর্ণবাদ ও লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে সবাইকে নতুন একটা ভাবনায় ফেলে দিয়েছেন ৩৬ বছর বয়সী এই তারকা। দীর্ঘদিনের এই টেনিস তারকা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, আমেরিকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলায় কীভাবে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য কাজ করে এবং তিনি কীভাবে এর ভুক্তভোগী হয়েছেন।

সেরেনার সেদিনের অভিযোগ পুরো বিশ্বের ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট অনেককে নাড়া দিয়েছে। চেয়ার আম্পায়ার কার্লোস রামোসের বিরুদ্ধে ‘লিঙ্গবৈষম্যে’র অভিযোগ তোলেন তিনি। সেদিন তিনি চিৎকার করে আম্পায়ারকে বলেন, ‘আপনি মিথ্যাবাদী। জীবনে আর কখনোই আমার ম্যাচে আম্পায়ারিং করতে আসবেন না।’ পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী সেদিন তিনি আরও বলেন,“এই আম্পায়ার কখনো ছেলেদের কাছ থেকে ম্যাচ কেড়ে নিতে পারে না। কারণ ওরা তাকে ‘চোর’ বলে।”

ফাইনাল খেলা চলাকালে গ্যালারিতে বসেছিলেন সেরেনার কোচ। খেলা চলাকালীন তার কাছ থেকে নির্দেশনা নিয়েছেন সেরেনা— এই অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ আনেন ওই ম্যাচের রেফারি। তিনি বলেন, ‘খেলা চলাকালীন কোচের পরামর্শ নেওয়া গ্র্যান্ড স্লামে আচরণবিধি ভঙ্গের মধ্যে পড়েছে।’ এ কারণে সেরেনার একটি পয়েন্ট কেটে নেন আম্পায়ার। ম্যাচেই আম্পায়ারের উদ্দেশে সেরেনা বলেন, ‘জয়ের জন্য কখনোই প্রতারণা করি না। প্রয়োজনে হেরে যাবো।’

ব্যাপারটার নিষ্পত্তি হয়তো সেখানে হতে পারতো, কিন্তু তা ঘটেনি। বরং প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছ থেকে পিছিয়ে পড়ে সেরেনা ক্ষোভে-দুঃখে নিজের র‍্যাকেট কোর্টে ছুড়ে মারলে এটি আরও রাজনৈতিক চরিত্র পায়। এ কারণে আবারও আম্পায়ার তার বিপক্ষে অবস্থান নেন। কোর্টে র‍্যাকেট ছুঁড়ে মারাকে আচরণবিধি ভঙ্গ হিসেবে তুলে ধরে শাস্তিস্বরূপ পুরো ম্যাচই সেরেনার কাছ থেকে কেড়ে নেন তিনি।

আমরা জানি, বিভিন্ন দেশে গিয়ে লিঙ্গ সমতা মাপামাপি করে থাকে আমেরিকা। অথচ যুক্তরাষ্ট্রেই একটি বড় টেনিস আসরে বিখ্যাত একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী খেলোয়াড় দীর্ঘদিনের চর্চিত পুরুষ আধিপত্যকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। এটি সমসাময়িক দুনিয়ায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ অভিঘাত। পুরুষতন্ত্র ও বর্ণবাদ এখনও কতটা দাপটশালী, সেরেনা সেই বিষয়ও স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন।

প্রশ্ন ওঠতে পারে, সেরেনার অভিযোগ নিয়ে কেন এত তোলপাড় গোটা টেনিস দুনিয়া? কারণ যে অভিযোগে সেরেনার পয়েন্ট কেটেছেন আম্পায়ার; সেই আচরণ অর্থাৎ হতাশা বা ক্ষোভ প্রকাশে কোর্টে র‍্যাকেট ছুড়ে মারার ঘটনা অহরহই করে থাকেন পুরুষ খেলোয়াড়েরা। তখন কিন্তু আম্পায়াররা পয়েন্ট কাটেন না। তারা মনে করেন, হারলে ছেলেদের এমন রাগ হতেই পারে। কিন্তু সেরেনার এ ধরনের রাগ দেখতে অভ্যস্ত নয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। তার ওপর তিনি কৃষ্ণাঙ্গ নারী। মেয়েরা খেলতে এলেও তাকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছে ‘নৈতিক’ নারী হিসেবেই হাজির হতে হবে। যেন তার রাগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করা চলবে না এবং তাকে সেগুলো দমিয়ে খেলা চালিয়ে যেতে হবে।

আম্পায়ারের এই বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতি সেরেনার অভিযোগ ও প্রতিবাদকে সমর্থন করেছেন অনেকেই। কিংবদন্তি বিলি জিনন টুইটারে লিখেছেন, ‘কোনও মেয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে গেলে তাকে বলা হয় হিস্টিরিয়াগ্রস্ত। কিন্তু পুরুষেরা যখন একই আচরণ করে তখন বলা হয়, বাহ্! ছেলেদের কোনও শাস্তিও হয় না। এটি পরিষ্কার দ্বিমুখী আচরণ। ধন্যবাদ সেরেনা উইলিয়ামস, এই দ্বিমুখীতাকে সামনে নিয়ে আসার জন্য।’

পুরুষ তার সমগ্র আচরণ দেখাবে অকপটে আর নারী বহিঃপ্রকাশ করবে রেখেঢেকে— এটাই হয়তো সব পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্র চায়। নারীর আবেগী চরিত্রকে পরিবারের বাক্সে বন্দি করেছে সমাজ বা রাষ্ট্র। পাবলিক পরিসরে পুরুষেরা তাদের রাগ ও ক্ষমতা দেখাবে। কারণ এটাই রাষ্ট্র ও সমাজে চর্চিত হয়েছে।

একথা হয়তো ঠিক, যেকোনও ধরনের খেলাধুলায় ব্যক্তিগত রাগ ও ক্ষোভ প্রকাশকে আচরণবিধি ভঙ্গ কিংবা অপেশাদারিত্ব হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু সেটি যদি শুধু নারী খেলোয়াড়ের জন্যই প্রযোজ্য হয়, তাহলে লিঙ্গবৈষম্যের অভিযোগ ওঠা খুবই ন্যায্য। আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়ামের ফাইনালে সেরেনা এ অসামঞ্জস্যই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। তার প্রতিবাদের পর ব্যাপারটি নিয়ে নড়েচড়ে বসছে ডব্লুটিএ। আশার কথা হলো, সংস্থার ট্যুর চিফ স্টিভ সিমনস টেনিস কোর্টের এমন বৈষম্য স্বীকার করে নিয়েছেন কোনও বিতর্ক ছাড়াই। তবে এতদিন তিনি এটি জানতেন না কিংবা এটি তার চোখ এড়িয়ে গেছে, তা বিশ্বাস করা বড় কঠিন। তবে তিনি এটি সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করার কথা জানিয়েছেন।

অন্যান্য দেশের ক্রীড়াঙ্গনের মতো বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে নারীরা ফুটবল ও ক্রিকেট খেলছে। তবে এর পেশাদারি বয়স বেশিদিনের নয়। বাইরের দেশগুলোতে নারীরা এই ধরনের খেলাধুলায় নিশ্চিতভাবেই বেশ খানিকটা এগিয়ে আছে। কিন্তু বিশ্বজুড়ে ক্রীড়া ব্যবস্থাপনা যেভাবে এটিকে নিয়ন্ত্রণ করছে ও এগিয়ে নিচ্ছে এবং সেটি খুবই পুরুষতান্ত্রিক উপায়ে চলছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

টেনিস জগতের চলমান পৌরুষদীপ্ততাকে সত্যিকারভাবেই বড়সড় ঝাঁকুনি দিয়েছেন সেরেনা উইলিয়ামস। এটা হয়তো অন্য খেলার ক্ষেত্রেও একটি উল্লেখযোগ্য রেফারেন্স হিসেবে পরিগণিত হবে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সেরেনার এই প্রতিবাদ সব দেশে তথা পুরো ক্রীড়াবিশ্বে সব ধরনের লিঙ্গবৈষম্যের পরিসমাপ্তি ঘটাতে অনেক সহায়ক হবে। 

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ইমেইল: [email protected]

 

 

/এসএএস/জেএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ