X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

আসামের মুসলমানদের বিজেপি কী করতে চায়?

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৫:২৭আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৭:২২

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী আসামে আসামি ও অ-আসামি বিভাজন করতে গিয়ে ৪০ লাখ মানুষকে অ-আসামি বলে স্থির করেছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ১৯ সেপ্টেম্বর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই ৪০ লাখ লোককে নাগরিত্ব প্রমাণ করতে আরও দুই মাস সময় দিয়েছে। এরফলে দশ রকমের প্রমাণপত্র দিয়ে দেখাতে হবে, তারা ভারতের নাগরিক আর প্রমাণপত্রগুলো হতে হবে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগের। এটি সুস্পষ্ট যে, আসামিদের বাংলাদেশি সিল দিয়ে গোলযোগ সৃষ্টি করা। আসামের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আনোয়ারারও অ-আসামিদের লিস্টে নাম উঠেছে। রাজ্য সরকার ধীরে ধীরে অ-আসামিদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
ক্ষমতাসীন বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাদব দিল্লিতে বলেছেন এই ৪০ লাখ লোক বাংলাদেশি। তাদের নাকি বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আবার গত ১০ সেপ্টেম্বর বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ বিজেপির সর্বভারতীয় কার্যকরী কমিটির সভায় রাম মাদবের কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন। আমিত শাহ হচ্ছেন এখন ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পর দ্বিতীয় শক্তিশালী ব্যক্তি। আসামের রাজ্য সরকার এখন বিজেপির।

পশ্চিম বাংলাও বাংলাদেশের অংশ ছিল। এখন পশ্চিম বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী। তিনি একটা সংসদীয় প্রতিনিধি দল আসামে পাঠিয়ে ছিলেন সরেজমিন বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করার জন্য। কিন্তু আসামের রাজ্য সরকার প্রতিনিধি দলকে আসামে কাজ করতে দেয়নি। ৪০ লাখ লোকের মাঝে সাড়ে ১৩ লাখ লোক নাকি হিন্দু। নরেন্দ্র মোদি আইন করেছেন কোনও হিন্দু ভারতে গেলেই নাগরিকত্ব পাবে। সুতরাং এই সাড়ে ১৩ লাখের নাগরিকত্ব নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। যেহেতু তারা বাঙালি তাদের হয়তো পশ্চিম বাংলায় যেতে হবে। সাড়ে ১৩ লাখ লোক উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিম বাংলায় গেলে পশ্চিম বাংলার জন্য বিরাট সমস্যা সৃষ্টি হবে। তাই মমতা এই ৪০ লাখ লোকের ব্যাপারেই সোচ্চার।

গত মাসে কাঠমান্ডুতে বিসমটেক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করেছেন। নরেন্দ্র মোদি আসামের লোকপঞ্জি বা নাগরিক তালিকা নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে উদ্বিগ্ন না হতে বলেছেন। তাহলে বিজেপির দুজন শক্তিশালী নেতা রাম মাদব আর অমিত শাহ বাংলাদেশে লোক পাঠানোর কথা বলছেন কেন? আসামের রাজ্য সরকার ও লোকপঞ্জি কার্যকর করার ব্যাপারে শক্ত অবস্থানে রয়েছেন। আবার আরএসএস-এর প্রধান মোহন্তও একই কথা বলেছেন।

আরএসএস  মুসলমানকে ধর্মান্তরিত করে ‘ঘর ওয়াপসি’ কর্মসূচিও সচল রাখার কথা বলছে। ২২/২৩ কোটি মুসলমানকে হিন্দু বানিয়ে ভারতকে ধর্ম-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কি সম্ভব? হিন্দু বৌদ্ধ মুসলমান খ্রিস্টান বহু ধর্মের লোক বাস করে ভারতে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে কি সবাইকে হিন্দু হতে হবে। আরএসএস নিশ্চয়ই জানে যেকোনও ধর্মের কাণ্ডারিরা যখন অন্য ধর্মের প্রতি তার উদারতা হারিয়ে ফেলে, দুরভিসন্ধি নিয়ে চলতে থাকে, মানবিক আদর্শগুলোকে বিসর্জন দিয়ে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে, তখন সে ধর্ম সবার কাছেই ধিকৃত হয়।

রাজা রামমোহনও হিন্দু ছিলেন। তিনি আরবি, ফারসি, সংস্কৃতিতে পণ্ডিত ছিলেন। আদি বাইবেল পড়ার জন্য তিনি হিব্রু ও গ্রিক ভাষা শিখেছিলেন। কারণ, আদি বাইবেল প্রথম লেখা হয়েছিল হিব্রু ও গ্রিক ভাষায়। তার সময়ে মাদ্রাজি পণ্ডিত সুব্রণ্যম শাস্ত্রী আরএসএসের মতো এক ধর্মের ভারত করার আন্দোলন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু রাজা রামমোহন রায় তার জ্ঞান, গরিমা আর প্রচারণা দিয়ে সুব্রণ্যম শাস্ত্রীর প্রচারণাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন।

একবার রামমোহনের স্ত্রী উমাদেবী তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, তুমি তো বহু ধর্মের বিশেষজ্ঞ। বলতো কোন ধর্ম শ্রেষ্ঠ? রাজা রামমোহন বলেছিলেন, কোনও গাইয়ের রঙ কালো, কোনোটার রঙ সাদা, কোনোটার রঙ লাল কিন্তু সব গাইয়ের দুধ সাদা। ধর্মের রূপ রঙ যাই হোক না কেন সর্ব ধর্মই মানুষের কল্যাণ কামনা করেছে।

রামমোহনের এ বার্তাটিই প্রচার করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্বব্যাপী। রাজা রামমোহন বেদান্তকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে হিন্দুধর্মকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরে ছিলেন। রামমোহন থেকে গান্ধী ভারতের বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য চেয়েছিলেন। তারা জানতেন ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলে হানাহানি হবে। কিন্তু আধুনিক যুগে এসে বিজেপি ভারতে কী করতে চাচ্ছে? লোকপঞ্জি, ঘর ওয়াপসি তো ভারতকে অস্থির করে তুলবে। ভারতের এক বিজেপি নেতাই বলেছেন, ২০৪৭ সালের দিকে ভারত আরেক বিভক্তির মুখে পড়বে। বিজেপি এমন সব পথে হাঁটছে। যার মানচিত্র সম্ভবত বিজেপিরই জানা নেই।

যাক, লিখছিলাম লোকপঞ্জির কথা। আসাম জয় করার পর ব্রিটিশরা আসামকে কমিশনার শাসিত এলাকা হিসেবে রেখেছিলেন বহুদিন। ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশেরা যখন আসামকে পৃথক রাজ্যের মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন, তখন রাজস্ব ঘাটতির কারণে তা সম্ভব হচ্ছিল না। পরে ব্রিটিশরা বাংলা থেকে গোয়ালপাড়া, কাছাড় ও সিলেট জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে পৃথক রাজ্য গঠন করেছিলেন। বাংলার মানুষ তখনও এটার প্রতিবাদ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো তার কবিতায় বলেছেন ‘মমতা বিহীন কালস্রোতে, বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে, নির্বাসি তুমি, সুন্দরী শ্রী ভূমি।’ রবীন্দ্রনাথ সিলেটকে শ্রীভূমি বলে উল্লেখ করেছেন।

গোয়ালপাড়া জেলায় ময়মনসিংহ জেলা থেকে আসা লোকই বেশি। তারা কোন কারণে জানি না আসামিয়া ভাষা রপ্ত করে নিজেদের আসামিয়া বলে পরিচয় দেয়, যে কারণে গোয়ালপাড়া জেলা আসামিয়া ভাষাভুক্ত জেলায় রূপান্তর হয়। কিন্তু শ্রীহট্টও কাছাড় সে পথে পা বাড়ানি। তারা নিজেদের বাংলাভাষী হিসেবে অব্যাহত রাখে।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় সিলেটে গণভোট হয়েছিল। গণভোটে পাকিস্তান পক্ষ ৫৭ হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতেছিল। সিলেটের ৪ মহকুমা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত হয় কিন্তু বৃহত্তম মহকুমা করিমগঞ্জ ভারতকে দেওয়া হয়। করিমগঞ্জ না হলে ভারতের সঙ্গে ত্রিপুরা মেঘালয় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। করিমগঞ্জ এখন আসামের একটা জেলা। দেশ বিভক্তির সময় আসামের গভর্নর ছিলেন স্যার আকবর হায়দরী। তিনি সিলেট চলে যাওয়ার পর আসাম রাজ্য পরিষদের সদস্যদের উদ্দেশে বলেছিলেন, আসাম এখন বাংলামুক্ত (সিলেট) হলো, আসমিরা এখন স্বস্তিতে থাকতে পারবে। এখন তারা পার্বত্য ভাইদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে থাকতে পারবে।

কিন্তু অদৃষ্টের এমননি পরিহাস যে পার্বত্য ভাইয়েরা আসামের আধিপত্য মানেনি। রাজীব গান্ধীর সময়ে মীমাংসার উদ্যোগ নেওয়া হলে নাগাহিলস হলো ন্যাগল্যান্ড প্রদেশ, লুসাই হিলস জেলা হলো মিজোরাম প্রদেশ, খাসিয়া জয়ন্তিয়া হিলস হলো মেঘালয় প্রদেশ, অরুণাচল হল স্বতন্ত্র। এমনকি পার্বত্য ভাইদের প্রদেশের মর্যাদা দিতে গিয়ে আসাম রাজধানী পর্যন্ত হারালো। মূল রাজধানী শিলং মেঘালয়ের রাজধানী হলো। মূলত আসাম একভাষী কোনও রাষ্ট্রের নয়।

বিচারপতি ফজল আলীর নেতৃত্বে স্টেট রি-অর্গানাইজেশন কমিশন যখন হয় তখন কমিশন আসামকে দ্বিভাষিক রাষ্ট্র ঘোষণা করেছিলেন, কিন্তু আসামের রাজ্য সরকার তা মানেনি। অথচ আসামিয়া বাঙালি, ভিন্ন ভিন্ন জনজাতি উপজাতি অধ্যুষিত। শেষ পর্যন্ত আসাম রাজ্য সরকার উপজাতিদের প্রদেশের মর্যাদা দেওয়ার কথা স্বীকার করলেও বাঙালিদের স্বতন্ত্র সত্তা স্বীকারে অস্বীকৃতি জানায়। অথচ বাংলা হলো আসামের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা।

১৯৬১ সালে বাংলা ভাষার দাবিতে কাছাড় হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জের বাঙালিরা মিছিল করেছিল। তাতে রাজ্য সরকার গুলি চালিয়ে ১১ জন্য বাঙালিকে হত্যা করে। বাংলা ভাষার জন্য এটি দ্বিতীয় শহীদ হওয়ার ঘটনা। বাংলাভাষী লোকজনকে জমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্রিটিশ সরকার, আসামিয়া জোদ্দারো জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য আসামে যেতে অনুপ্রাণিত করেছিল। বাঙালিরা আসামে গিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে জমির মালিক হয়েছে। উপরন্তু বাংলার তিনটি জেলাও আসামের রাজ্য মর্যাদা প্রদানের সময় আসামে যুক্ত হয়েছে।

সুতরাং আসাম শুধু আসামিয়াদের এ দাবি কখনও যুক্তিসঙ্গত দাবি নয়। আসাম বাঙালিরও। বারাক উপত্যকায় ৭০ শতাংশ লোক সিলেটি। সিলচর পৌরসভার মেয়র কাউন্সিলরসহ বরাক উপত্যকার সব বিধায়ক হলো সিলেটি। বর্তমানে বোরো কাউন্সিল ও নর্থ কাছাড় কার্ধি-আংলাং কাউন্সিল স্বায়ত্তশাসিত। তারাও আসাম থেকে বেরিয়ে আলাদা প্রদেশের মর্যাদা দাবি করছে। বোরোল্যান্ড এবং নর্থ কাছাড় কার্বি আংলাং স্বতন্ত্র প্রদেশ হলে বঙ্গভাষী বরাক উপত্যকায় ভৌগোলিকভাবে আসামিয়া ভাষী ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

করিমগঞ্জও নাগাল্যান্ড, মেঘালয়ের মতো স্বতন্ত্র প্রদেশের মর্যাদার দাবি উত্থাপন করা উচিত। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত গোয়ালপাড়া, কাছাড় ও সিলেট জেলা আসামে সংযুক্ত হলেও কখনও আসাম রাজ্য কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এই তিন জেলা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ছিল বাংলা কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত। পূর্বভঙ্গ থেকে মুসলমানেরা আসামিয়া জমিদার ও মৌজাদারদের প্ররোচনায় আসাম গিয়েছিল এবং জঙ্গল পরিষ্কার করে জমির মালিক হয়েছে। ১৯৪৬ সালে যখন কংগ্রেস নেতা গোপিনাথ বরদোলাই আসামের মুখ্যমন্ত্রী হন তখনও বাঙাল খেদাওয়ের আওয়াজ তুলেছিল। তখন কিন্তু তারা সফল হননি।

বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলা অভিন্ন মত পোষণ করলে আসাম রাজ্য সরকার বা বিজেপির পক্ষে এক কোটি ৩০ লাখ বাঙালি হিন্দু মুসলমানের গায়ে হাত দেওয়া সম্ভব হবে না। আসাম রাজ্য সরকার তবু যদি চায় যে, ১ কোটি ৩০ লাখ লোক আসাম থেকে চলে যাবে। তবে গোয়ালপাড়া, কাছাড়, করিমগঞ্জ জেলা বাংলাকে প্রত্যর্পণ করতে হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইসরায়েলি হামলায় হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতার মৃত্যু: যুক্তরাষ্ট্র
ইসরায়েলি হামলায় হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতার মৃত্যু: যুক্তরাষ্ট্র
ম্যারেজ কাউন্সেলিং সম্পর্কে যা কিছু জানা জরুরি
ম্যারেজ কাউন্সেলিং সম্পর্কে যা কিছু জানা জরুরি
নিজ বাড়ির সামনে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
নিজ বাড়ির সামনে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
কয়রায় সুইডেনের প্রিন্সেস ক্রাউন ভিক্টোরিয়া
কয়রায় সুইডেনের প্রিন্সেস ক্রাউন ভিক্টোরিয়া
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ